সীতাকুণ্ড পাতাল মন্দিরে ২৩ দিন আত্মগোপনে ছিল ফয়সাল-মোস্তাফিজ
ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যার ঘটনায় মাস্টারমাইন্ড শিমুল ভুঁইয়ার পর দ্বিতীয় ও তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে জড়িত ছিল ফয়সাল ভুঁইয়া ও মোস্তাফিজুর রহমান। ১৯ মে তারা দেশে ফেরে। শিমুল ভুঁইয়ার কাছ থেকে পায় ৩০ হাজার টাকা। সেই টাকা নিয়ে সীতাকুণ্ড পাতাল কালীমন্দিরে তারা আত্মগোপনে চলে যায়। সেখানে তারা হিন্দু পরিচয়ে আশ্রয় নিয়ে ২৩ দিন অবস্থান করে।
আজ বুধবার (২৬ জুন) ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে তাদের দুজনকে গ্রেপ্তার করে। এরপর হেলিকপ্টারে করে তাদের ঢাকায় আনা হয়।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন
হেলিকপ্টারটি বিকেলে রাজধানীর পূর্বাচলের বঙ্গবন্ধু ট্রাই-টাওয়ারের জমিতে অবতরণ করে। সেখানেই সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশীদ।
তিনি বলেন, আমরা গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যার ঘটনার তদন্ত করছিলাম। গতকাল শুনলাম এ দুই আসামি খাগড়াছড়ি বা সীতাকুন্ডে অবস্থান করছে। আমাদের টিম গতকাল সেখানে সাঁড়াশি অভিযানে যায়। আজ সকালে আরেকটি টিম সেখানে যায়। অনেক উঁচু পাহাড়, সেখানে যাওয়া অনেক কঠিন। হেঁটে পৌঁছাতে ৭/৮ ঘণ্টা লাগে। পরে সেখান থেকে মোস্ট ওয়ানটেড দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তিনি বলেন, যে রুমটিতে সংসদ সদস্য আনারকে হত্যা করা হয়েছে, সেখানে ছিল ফয়সাল ভুঁইয়া। সে হত্যার আগে ক্লোরোফম দিয়ে অজ্ঞান করেছিল আনারকে। আর মোস্তাফিজুর রহমান আনারকে চেয়ারে বেঁধে বিবস্ত্র করেছিল, একই সঙ্গে মৃত্যু নিশ্চিত করেছিল। এরপর তাকে বাথরুমে নেওয়া হয়েছিল। সেখানে মূল মাস্টারমাইন্ড শিমুল ভুঁইয়ার সহযোগী জিহাদ, ফয়সাল ভুঁইয়া ও মোস্তাফিজুর রহমান ছিল।
হারুন দাবি করেন, এই দুজন গ্রেপ্তার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু আমাদের কাছে স্বীকার করেছেন। এরপরও আমরা দুজনকে আরও জিজ্ঞাসাবাদ করব। তারপর তাদের ভূমিকা সম্পর্কে বিস্তারিত বলা যাবে।
খাগড়াছড়ি তো গহীন অঞ্চল, সেখানে তারা কাদের আশ্রয়ে ছিল? জানতে চাইলে হারুন বলেন, সীতাকুন্ড পাহাড়ের নিচে পাতাল কালীমন্দির আছে। সেখানে তারা নিজেদের নাম বদলে ফেলে। ফয়সাল পলাশ রায় আর মোস্তাফিজুর শিমুল রায় নাম ধারণ করে হিন্দু সেজে মন্দিরে অবস্থান করে। বলে, মাকে তারা খুব ভালবাসে। কালীমন্দির ছাড়া থাকতে পারি না। এভাবে তারা ছদ্মবেশ ধারণ করে সেখানে ২৩ দিন অবস্থান করে।
হারুন বলেন, তারা ইন্ডিয়াতে হত্যার কাজ শেষ করে ১৯ মে দেশে ফেরে। তারা শিমুলের সঙ্গে কথা বলে। দুজনকে মাত্র ৩০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। এই টাকা নিয়ে তারা খাগড়াছড়ি চলে যায়। যেহেতু তারা আগে ট্রাক চালাত সেজন্য তারা সীতাকুণ্ডের গহীন এলাকা চিনত। নিরাপদ ভেবে বাঁচার জন্য সেখানে অবস্থান নেয়। হিন্দু নাম ধারণ করে আত্মগোপন করে। বাঁচার জন্য তারা আরও নানা জায়গায় যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে।
আরও পড়ুন
তিনি বলেন, বহুদিন ধরে তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছিল। কখনো খবর পেতাম সুন্দরবনে, কখনো সমুদ্রে, কখনো গহীন বনে আছে। আমি বলেছিলাম, তারা যেখানেই থাকুক, পাহাড়ে থাকুক আর সমুদ্রে থাকুক তাদের ধরে আনব। আজ তাদের ধরতে পেরেছি। সংসদ সদস্য আনারকে হত্যায় যে সাতজন অংশ নিয়েছিল তার মধ্যে এই দুজন ছিল শিমুল ভুঁইয়ার পর দ্বিতীয় ও তৃতীয় ব্যক্তি। এই দুজনকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে কিলিং মিশনে যে সাতজন অংশ নিয়েছিল তারা সবাই গ্রেপ্তার হলো। এর বাইরে বাকি যারা মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করেছে, অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা করেছে, বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছে আমরা মনে করি এসব ব্যক্তিকে এখন গ্রেপ্তার করতে হবে। আমরা ইতোমধ্যে শিমুল ভুঁইয়ার ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দির ভিত্তিতে মিন্টু ও গ্যাস বাবুকে গ্রেপ্তার করেছি। বাংলাদেশের কাছে সাতজন গ্রেপ্তার আছে। ইন্ডিয়াতে আছে সিয়াম ও জিহাদ।
এক প্রশ্নের জবাবে হারুন বলেন, ডিবি পুলিশ শিমুল ভুঁইয়া, শিলাস্তি ও তানভীরকে যখন প্রথম গ্রেপ্তার করে তখন ইন্ডিয়ান পুলিশ এসে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। আমরাও তাদের হাতে গ্রেপ্তার জিহাদকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি, ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। এরপর যখন জানলাম সিয়াম নেপালে তা তাদের জানিয়েছি। নেপালে গিয়েছি, সিয়ামকে গ্রেপ্তারে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করেছি।
তিনি বলেন, আনার হত্যার আরেক মাস্টারমাইন্ড আকতার, যিনি আমেরিকা পালিয়েছেন, তাকে গ্রেপ্তারে আমরা আমেরিকা দূতাবাসে কথা বলেছি। দেখা করে গ্রেপ্তারের অনুরোধ করেছি। ইন্টারপোলের সহযোগিতা চেয়েছি। ইন্ডিয়ার কাছে সে মোস্ট ওয়ানটেড। তাদের সঙ্গে আমেরিকার চুক্তি আছে। তারাও চেষ্টা করছে, আমরাও চেষ্টা করছি।
মাস্টারমাইন্ডদের গ্রেপ্তারের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হারুন বলেন, আজকে গ্রেপ্তার দুজনসহ আগে গ্রেপ্তার সবাইকে আবারো জিজ্ঞাসাবাদ করব। সবকিছু মিলে যদি আরও কেউ থাকে যারা সাহায্য-সহযোগিতা করেছে, অর্থ দিয়েছে, প্ল্যান করেছে, তাদের যদি নাম পাই, তথ্য-উপাত্ত পাই, পারিপার্শ্বিক প্রমাণ পাই, তাহলে তাদেরও গ্রেপ্তার করা হবে।
রাজনৈতিক প্রভাব, বাধা বা চাপ আছে কি না— জানতে চাইলে হারুন বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ডিএমপি কমিশনার একাধিকবার বলেছেন কোনো চাপ নেই। যদি আমাদের উপরে চাপ থাকত তাহলে এত অ্যাচিভমেন্ট করতে পারতাম না। আমরা কিন্তু একজনের পর একজন আসামি গ্রেপ্তার করেছি। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়েছি তাকেই গ্রেপ্তার করেছি। যারা সরাসরি ক্লিন মিশনে জড়িত সুস্পষ্ট প্রমাণ আছে, আমরা শুধু তাদেরকেই আইনের আওতায় নিয়ে আসছি। আমরা অনর্থক কোনো দিকে দাপাদাপি করছি না, নির্দোষ কাউকে হয়রানি করছি না। আমি মনে করি যিনি দোষী তাকে কেউ ছাড়াতে পারবে না।
জেইউ/এমজে