ছবি : সংগৃহীত

‘জল্লাদ’ শাহজাহান। টানা ৩২ বছর কারাগারে থেকেও ছিলেন আলোচিত এক নাম। এক সময় ছিলেন কুখ্যাত ডাকাত। পুলিশের কাছে ধরা পড়ে ১৯৯১ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সাজা ভোগ করেন তিনি।

কারাবাসের সময় ২০০১ সালে সহযোগী জল্লাদ হিসেবে গফরগাঁওয়ের নূরুল ইসলামকে ফাঁসি দিয়ে শাহজাহান ‘জল্লাদ’ জীবনের সূচনা করেন। এরপর কারাগারে কারও মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সময় হলেই ডাক পড়তো তার। টানা আট বছর এই কাজ করার পর কারা কর্তৃপক্ষ তাকে প্রধান জল্লাদের স্বীকৃতি দেন।

কারা সূত্রে জানা যায়, মোট ২৬ জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন এই শাহজাহান। তবে তার দাবি ছিল ৬০ জন। এই তালিকায় ছিল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ ঘাতক, ৬ যুদ্ধাপরাধী, কুখ্যাত সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদার, জঙ্গি নেতা বাংলাভাই, আতাউর রহমান সানী, শারমীন রীমা হত্যার আসামি খুকু মনি, ডেইজি হত্যা মামলার আসামি হাসান।

সেই জল্লাদ শাহজাহান ২০২৩ সালে কারামুক্ত হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। সবশেষ রোববার দিবাগত রাতে বুকে ব্যথা অনুভব হওয়ায় সোমবার ভোরে তাকে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আনা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) হয়।

ডিএমপির শেরেবাংলা নগর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সজীব দে ঢাকা পোস্টকে এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, বুকে ব্যথা অনুভব করায় ভোর ৫টার দিকে জল্লাদ শাহজাহানকে হেমায়েতপুর থেকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। হাসপাতালে আনার পরে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

শাহজাহান ভূঁইয়া নরসিংদীর পলাশ উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের ইছাখালী গ্রামের বাসিন্দা। তার বাবার নাম হাছেন আলী ভূঁইয়া। বিভিন্ন অপরাধে গ্রেপ্তারের পর শাহজাহান ১৯৯১ সালের ১৭ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জ জেলা কারাগারে যান। ২০২৩ সালের ১৮ জুন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি। ৭৪ বছর বয়সী শাহজাহান কারাভোগ শেষে মুক্তি পাওয়ার পর এক তরুণীকে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু কয়েক মাস সংসার কর পর তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়।

হত্যা ও অস্ত্র মামলায় শাহজাহান ভূঁইয়ার মোট সাজা হয়েছিল ৪২ বছর। তার মধ্যে তিনি ১০ বছর ৫ মাস ২৮ দিন রেয়াত পেয়েছেন। প্রায় ৩২ বছরের সাজা শেষে তিনি মুক্তি পান।

কারাগার থেকে বের হয়ে যা বলেছিলেন শাহজাহান

গত ২০২৩ সালের ১৮ জুন কারাগার থেকে মুক্তি পান আলোচিত জল্লাদ শাহজাহান। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার (কেরানীগঞ্জ) থেকে বের হয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আমি অপরাধ করেছি। সেজন্য জেলে এসেছি, সাজা ভোগ করেছি। আপনারা এখন আমার প্রতি মায়া দেখাচ্ছেন- লোকটা এত বছর জেল খেটেছে। আমার পেছনের দিকটা যদি আপনারা টান দেন। তাহলে আমি অতীতে কেমন ছিলাম। এখন আমি মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার মতো অতীতের সবকিছু ভুলে গেছি। এখন আমি কীভাবে আগামী দিনে চলব, থাকব সেটা হচ্ছে বিষয়।

এ সময় তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, আমার বাড়ি, ঘর নেই। এত বছর জেল খাটার পর আমার কিছুই নেই। আমি এখন কারাগার থেকে বেরিয়ে নিজের বাড়িতেও যাচ্ছি না। আমি আরেকজনের বাড়িতে গিয়ে উঠছি। আমি এখন কী করে খাব? কোথায় যাব? কী করব? আমার এখন আর কিছু করারও বয়স নেই।

তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার একটিই আবেদন, আমাকে যেন বাড়ি-ঘর ও একটি কর্মসংস্থান দিয়ে চলার মতো কিছু করে দেন। এটিই প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন।

আলোচিত যাদের ফাঁসি দিয়েছেন ‘জল্লাদ’ শাহজাহান

শহীদ বুদ্ধিজীবী কন্যা শারমীন রীমা হত্যা মামলার আসামি মুনিরকে ১৯৯৩ সালে ফাঁসি দেন ‘জল্লাদ’ শাজাহান। বহুল আলোচিত ডেইজি হত্যা মামলার আসামি হাসানকে ১৯৯৭ সালে, এরশাদ শিকদারকে ২০০৪ সালে, জঙ্গি নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাই ও আতাউর রহমান সানিকে ফাঁসি দিয়েছেন শাজাহান।

এদিকে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ৬ আসামি লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর বজলুল হুদা, লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি) ও লে. কর্নেল এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার) ও ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদের ফাঁসিও দেন ‘জল্লাদ’ শাজাহান।

এছাড়া ৪ যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসিও দিয়েছেন ‘জল্লাদ’ শাজাহান। মানবতাবিরোধী অপরাধী আবদুল কাদের মোল্লা, সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ও মীর কাসেম আলীরও ফাঁসি দিয়েছেন তিনি।

এমএসি/এসএম