টানা ৩২ বছর কারাগারে থাকা আলোচিত জল্লাদ শাহজাহান ভূঁইয়া মারা গেছেন। বিভিন্ন মামলায় এত বছর সাজা খেটে বাইরে বেরিয়েও জীবনটা সহজ ছিল না তার। স্ত্রী ও ভাগনেসহ একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে প্রতারণার শিকার হয়েছেন তিনি। এছাড়া, এত বছর সাজাভোগের কারণে আর্থিকভাবে বেশ অস্বচ্ছল ছিলেন জল্লাদ শাহজাহান।

কারাগার সূত্রে জানা যায়, শাহজাহান ভূঁইয়া নরসিংদীর পলাশ উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের ইছাখালী গ্রামের বাসিন্দা। তার বাবার নাম হাছেন আলী ভূঁইয়া। নানান অপরাধে গ্রেপ্তারের পর শাহজাহানকে ১৯৯১ সালের ১৭ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জ জেলা কারাগারে নেওয়া হয়। ২০২৩ সালের ১৮ জুন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি।

৭৪ বছর বয়সী শাহজাহান কারাভোগ শেষে মুক্তি পাওয়ার পর এক তরুণীকে বিয়ে করেন। কিন্তু তার এই সংসার বেশি দিন টিকেনি। তার নববিবাহিত তরুণী স্ত্রী টাকা-পয়সা নিয়ে পালিয়ে যায় বলে অভিযোগ ওঠে। ওই ঘটনার পর শাহজাহান অনেকটা ভেঙে পড়েন। কারাগারের বাইরের জীবন তার কাছে আরও অনেক কঠিন মনে হয়েছে বলেও গণমাধ্যমকে জানান তিনি।

এ বিষয়ে গত ১ এপ্রিল জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জল্লাদ শাহাজাহান বলেন, জীবন এত কঠিন হবে জানলে কারাগারেই থেকে যেতাম। জেল থেকে বের হয়ে নানাভাবে প্রতারিত হয়েছি। সাথী আক্তার নামের ২৩ বছরের একটি মেয়েকে বিয়ে করে প্রতারিত হয়েছি। মেয়েটি আমার সব টাকা আত্মসাৎ করে উল্টো আমার নামে মামলা দিয়েছে।

তিনি বলেন, জেল থেকে বেরিয়ে দেখছি, এ সমাজে চলতে গিয়ে প্রতারণার মধ্যে পড়তে হচ্ছে আমাকে। আমি কল্পনাও করতে পারিনি। বাইরের লোকের সম্পর্কে আমার এমন ধারণা ছিল না, তারা এতটুকু নির্দয় হতে পারে আমার জানা ছিল না। আমি জানতাম না এত প্রতারক বাংলাদেশে রয়েছে। আমি ২৩ বছর বয়সে জেলে গিয়েছি, কারাভোগ শেষে এসে এক অন্যরকম দেশ দেখছি।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে শাহজাহান বলেন, মানুষের বেঁচে থাকার জন্য দরকার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা। এগুলোর কোনোটিই আমি পাচ্ছি না। আমি আমার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। আমার মা-বাবা নেই, দায়িত্ব নেওয়ার মতো ভাই-বোন নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিত্তবানদের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, আমাকে থাকার ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিন।

তিনি বলেন, আমি চরম অর্থনৈতিক সংকটে আছি। আমার কাজ করার মতো ক্ষমতা নেই, আয়-রোজগার নেই, অর্থের যোগানদাতা নেই, নিজের থাকার জায়গা নেই। কারাভোগ শেষ করে এসে আমি এখন বাইরের মানুষদের বুঝতে পারছি না। যেখানেই যাচ্ছি প্রতারণার খপ্পরে পরছি। গত বছরের ২১ ডিসেম্বর বিয়ে করে সেখানেও সর্বস্বান্ত হয়েছি। বিয়ের কাবিন পাঁচ লাখ টাকা হলেও আমার কাছে থাকা ১০ লাখ টাকা স্ট্যাম্পে লিখিত দিয়ে আমার স্ত্রী সাথী আক্তার ফাতেমা ৫৩ দিনের মাথায় পালিয়ে গেল। পালিয়ে গিয়ে আমার নামে যৌতুকের মামলা দিল। আমি থানায় মামলা দিতে গেলেও বউয়ের নামে মামলা করা যায় না বলে আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। পরে আইনজীবীর সহযোগিতায় রোববার (৩১ মার্চ) আদালতে আমার স্ত্রী, শাশুড়িসহ ছয়জনের নামে মামলা করেছি।

জল্লাদ শাহজাহান বলেন, কারাবন্দি থেকে বাইরে এসে নানা প্রতারণায় পড়ে মনে হচ্ছে কারাগারেই ভালো ছিলাম। কারাগারের বাইরের জীবন এত জটিল কেন? জীবন এত কঠিন হবে জানলে কারাগারেই থেকে যেতাম।

জেল থেকে বের হওয়ার পরের অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি আরও বলেন, কারাগার থেকে বের হলে আমার ভাগনে নজরুল আমাকে অটোরিকশা কিনে দেবে বলে আমার টাকা মেরে দেয়। এরপর অনেক কষ্টে একটা চায়ের দোকান দেই। আমার সঙ্গে যে ছেলেটি দোকানে সময় দিত, সে চার মাস আমার সঙ্গে থাকার পর দোকানে থাকা ৩০ হাজার টাকা ও মোবাইল চুরি করে নিয়ে যায়।

প্রসঙ্গত, সোমবার (২৪ জুন) ভোরে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জল্লাদ শাহজাহানের মৃত্যু হয়। 

ডিএমপির শেরেবাংলা নগর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সজীব দে ঢাকা পোস্টকে জানান, ভোর ৫টার দিকে জল্লাদ শাহজাহানকে হেমায়েতপুর থেকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে আসেন তার বাড়ির মালিক। বুকে ব্যথা অনুভব করায় হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় শাহজাহানকে। হাসপাতালে নিয়ে আসা হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

এমএসি/কেএ