ঝিনাইদহ থেকে মনিরুল ইসলামের নেতৃত্বে ছয়জনের একটি দল ঢাকায় এসেছে। সারাবছর অন্য কাজ করলেও কোরবানির দিন তারা পুরোদস্তুর কসাই হয়ে যান। নিজেদের পারিশ্রমিক নির্ধারণ করেন কোরবানির পশুর মোট দামের ভিত্তিতে। পশুর দামের প্রতি হাজারে তারা পারিশ্রমিক নেন ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত। রাজধানীবাসীর কাছে তারা ‘একদিনের কসাই’ হিসেবে পরিচিত।

ঈদের দিন যত গরু-ছাগল, মহিষ কোরবানির করা হয়, তার তুলনায় পেশাদার কসাইয়ের সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। তাই ঈদে ‘একদিনের কসাইয়ের’ চাহিদা থাকে আকাশচুম্বী। তবে পেশাদার কসাইয়ের তুলনায় একদিনের কসাইয়ের কাজে সময় লাগে একটু বেশি। অনেকে কসাইয়ের কাজের অভিজ্ঞতার অভাবে নিজের হাত-পা কেটে ফেলাসহ নানা দুর্ঘটনা ঘটান।

খিলগাঁও ফ্লাইওভারের নিচে গোখাদ্যের দোকানে কথা হয় মনিরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে জানান, গত তিন বছর ধরে কোরবানির ঈদের আগে ঢাকায় আসেন। ঈদের দিন কসাইয়ের কাজ করেন। আর এই কাজে ব্যবহারের জন্য এলাকা থেকে আসার সময় ছুরি-চাপাতিসহ মাংস ও হাড় কাটার প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে আসেন।

কতজন এসেছেন– জানতে চাইলে মনিরুল বলেন, এবার ৬ জন এসেছি। তার মধ্যে চারজনের কসাইয়ের কাজের অভিজ্ঞতা আছে। বাকি দুইজন নতুন। তারা জোগালি (সহায়ক) হিসেবে কাজ করবে।

সারা বছর কী কাজ করেন– জানতে চাইলে তিনি বলেন, এলাকায় কৃষিকাজ, মাটি কাটাসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করি। এক ভাইয়ের পরামর্শে গত তিন বছর ধরে কোরবানিতে ঢাকায় কসাইয়ের কাজ করি। এবারও এসেছি এ কাজ করার জন্য।

পারিশ্রমিক কীভাবে ঠিক করেন– জানতে চাইলে মনিরুল বলেন, হাজারে ২০০ টাকা করে নিই। গরুর দাম ১ লাখ টাকা হলে আমরা ২০ হাজার টাকায় কসাইয়ের কাজ করে দিই। তবে অনেক সময় মানুষ গরুর সঠিক দাম বলে না। দেখা যায় ২ লাখ টাকা দিয়ে গরু কিনে বলে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। সেই হিসাব করলে ১ লাখ টাকার গরুতে আমাদের ১৫-১৬ হাজার টাকার বেশি দেয় না। আবার অনেকে চুক্তিতে কাজ করায়। সেক্ষেত্রে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা দরদাম করে নিতে হয়।

শুধু মনিরুল দল নন, এরকম কয়েক হাজার লোক একদিনের কসাইয়ের কাজ করতে ঢাকায় এসেছেন। রাজধানীর সেগুনবাগিচা কাঁচা বাজারের সামনে গোখাদ্য ঘাস বিক্রি করছিলেন জনি। তার কাছে একদিনের কসাইয়ের সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি পাশের একটি চায়ের দোকানির সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। কথা হলে চা দোকানি জাকির জানান, তার জানাশোনা আটজনের একটি কসাইয়ের টিম আছে।

তারা কী কী কাজ করবে এবং কত টাকা নেবে– জানতে চাইলে জাকির বলেন, চামড়া ছাড়ানো থেকে মাংস ও হাড় কাটাসহ সবই করে দেবে। গরু মাংস ছোট করে কেটে দেবে। ছুরি-চাপাতি কিছুই দিতে হবে না তাদের। শুধু মাংস কাটার জন্য কাঠ ও চাটাই দিতে হবে। ২ থেকে ৩ ঘণ্টার মধ্যে সব কাজ শেষ করে দেবে।

তিনি আরও বলেন, পারিশ্রমিক হিসেবে গরুর মোট দাম যা হবে, সেই হিসাবে হাজারে ২০০ টাকা দিতে হবে।

তারা এখন কোথায়– জানতে চাইলে জাকির বলেন, দুইজন এখন ঢাকায় আছে, বাকিরা আজ রাতে ঢাকায় আসবে। তারা এলাকায় কসাইয়ের কাজ করে। কাজে কোনো সমস্যা হবে না।

রাজধানীর বাসাবোর একটি চায়ের দোকানে কথা হয় বাবুলের সঙ্গে। তিনি ঈদের দিন কসাইয়ের কাজ করবেন। বাবুল বলেন, সারা বছর ঢাকায় রিকশা-ভ্যান চালাই। গত পাঁচ বছর ধরে ঈদের দিন কসাইয়ের কাজ করি। রিকশা চালিয়ে যে টাকা আয় হয় এ কাজ করলে একটু বেশি আয় হয়। তবে খরচও আছে।

কী খরচ হয় জানতে চাইলে বাবুল বলেন, ছুরি-চাপাতি বানাইতে হয়। পুরোনোগুলো ধার দিয়ে নিতে হয়। আর এ কাজ তো একজনে করা যায় না। এলাকা থেকে লোক আনতে হয়। তাদের থাকা-খাওয়ার খরচ আছে। আসা-যাওয়ার ভাড়া আছে। সবমিলিয়ে অনেক টাকা খরচ হয়। তারপরও ঈদের দিন মানুষের মন ভালো থাকে। কাজ সুন্দর মতো কম সময়ে করে দিলে চুক্তির টাকার বাইরে বকশিশ দেয়, কিছু মাংস পাওয়া পায়।

গরু প্রতি কত টাকা নেন– জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেহেতু সব গরু একসঙ্গে জবাই হয়, তাই বড় গরু হলে একটা আর ছোট গরু হলে দুইটার কাজ করা যায়। লোক লাগে ৬ থেকে ৮ জন। আমরা হাজারে ২০০ টাকা চাই। মানুষ ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা পর্যন্ত দেয়। বড় গরু হলে ২৫ হাজার থেকে ২৮ হাজার টাকা পাই। আর ছোট গরু হলে ১৩-১৫ হাজার টাকা দেয়। সবমিলিয়ে দুইটা গরুর কাজ করতে পারলে তখন একজনের ভাগে দেখা যায় ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা পড়ে। আর কাজের পরে বিভিন্ন জায়গা থেকে কিছু মাংসও পাওয়া যায়।

পেশাদার কসাইরা বলছেন, ঢাকায় কমপক্ষে ৩৫ থেকে ৪০ লাখ গরু-ছাগল ও মহিষ কোরবানি হয়। কিন্তু পেশাদার কসাই আছেন ১-৩ হাজার। পেশাদার কসাইরা সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ পশু কাটার কাজ করতে পারেন। বাকি কাজ করে থাকে অপেশাদার কসাই। তাদের অনেকের ন্যূনতম প্রশিক্ষণ না থাকায় সময় যেমন বেশি লাগে, তেমনি অনেক সময় পশুর চামড়াও নষ্ট করে ফেলেন।

খিলগাঁওয়ের একটি মাংস দোকানের কসাই মুরাদ বলেন, আমাদের কাজের অর্ডার ঈদের ১৫ দিন আগে থেকে বুকিং হয়ে যায়। এদিন ছোট গরু হলে ৪-৫টা কাজ করতে পারি। আর বড় গরু হলে ৩টা পর্যন্ত করা যায়। আসলে সবাই চায় সকাল-সকাল কাজ শেষ করতে। তাই চাইলেও বেশি গরুর কাজ নিতে পারি না। তবে ঢাকায় অনেকে ঈদের পরের দিনও কোরবানি দিয়ে থাকে। সবমিলিয়ে এসময় ৭-৮টা গরুর কাজ করতে পারি।

কেমন টাকা নেন– জানতে চাইলে তিনি বলেন, যাদের কাজ করি সবাই পরিচিত। সাধারণ গরুর দামের প্রতি হাজারে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা নিই। এখানে একটু কম-বেশি হয়।

এএইচআর/এসএসএইচ