সুপেয় পানি নিশ্চিত ও লবণ পানি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে

টেকসই বেড়িবাঁধ, সুপেয় পানি নিশ্চিত, লবণ পানি নিয়ন্ত্রণ করে কৃষির উন্নয়ন এবং জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের দাবি জানিয়েছেন খুলনা-৬ (পাইকগাছা-কয়রা) আসনের সংসদ সদস্য মো. রশীদুজ্জামান।

তিনি বলেন, উপকূলীয় জনগণকে প্রকৃতির সঙ্গে নিরন্তর যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই যুদ্ধ কঠিন হয়ে উঠেছে। তাই উপকূলের জীবন-জীবিকা রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সুদৃষ্টি জরুরি।

বৃহস্পতিবার (১৩ জুন) জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে এসব কথা বলেন তিনি। অধিবেশনে ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু সভাপতিত্ব করেন।

তিনি বলেন, কৃষি আমাদের প্রধান উপজীব্য ও চালিকা শক্তি হলেও উপকূলের কৃষি মুখ থুবড়ে পড়েছে। এর প্রধান কারণ লবণ পানিতে বাণিজ্যিক চিংড়ি চাষ। অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষের কারণে এলাকার ভূমিহীন কৃষক, নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী কৃষি পেশা হারিয়ে অন্য পেশা খুঁজে নিতে বাধ্য হয়েছে। এই ঢাকা শহরেও দৈনিক দিনমজুর খেটে জীবিকা নির্বাহ করছে পাইকগাছা-কয়রার কয়েক হাজার মানুষ। অথচ তারা যে এলাকার মানুষ সেখানেই এক-সময় ধানের ফসল ফলতো। সেই ধান কাটার জন্য বাইরে থেকে শ্রমিক নিতে হতো। এখন চিংড়ি চাষের কারণে পরিস্থিতি বদলে গেছে।

এমপি রশীদুজ্জামান বলেন, বর্তমানে চিংড়ি চাষ আগের মতো অর্থকরী নেই। অনেকেই নিরুৎসাহী হয়ে চিংড়ি চাষ বন্ধ করে কৃষির দিকে ঝুঁকেছে। এবারের তরমুজ ফসল পাইকগাছা ও কয়রা উপজেলাতে বাম্পার ফলন হয়েছে। আড়াই মাসের ফসলে যে তরমুজ পেয়েছে, সেগুলো অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। এবার প্রায় ২৫০ কোটি টাকার তরমুজ ক্ষেতের থেকে বিক্রি হয়েছে। তরমুজ ক্ষেতে কাজ করে নারী শ্রমিকেরা এই মৌসুমে প্রত্যেকে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা আয় করেছে। তরমুজের পাশাপাশি একই জমিতে বছরের অন্য সময়ে আরো ফসল ফলানোর সুযোগ আছে। ওই জমিতে মিষ্টি পানিতে সব প্রকার মাছ চাষ সম্ভব হচ্ছে। যা লবণ পানিতে চিংড়ি চাষের থেকে অনেক বেশি লাভজনক ও পরিবেশবান্ধব।

চিংড়ি চাষের লভ্যাংশ মালিক, অর্থাৎ এককেন্দ্রিক থাকে। আর কৃষি কাজ থেকে প্রাপ্ত অর্থ শুধু কৃষকই নয়, অনেকে ভোগ করতে পারে। যা বেকারত্ব দূরীকরণে সহায়ক।

তিনি আরো বলেন, ওই অঞ্চলের নদী-নালা, খাল আশঙ্কাজনকভাবে ভরাট হয়ে গেছে। তাই কৃষির সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে লবণ পানির প্রবেশ বন্ধ করে এলাকার ভরাটকৃত খালগুলো পুনঃখনন করে মিষ্টি পনির আধার তৈরি করতে হবে। কৃষকরা যেন শুষ্ক মৌসুমে সেচের কাজে ব্যবহার করতে পারে।

সুপেয় পানির সংকটের কথা তুলে ধরে সংসদ সদস্য রশীদুজ্জামান বলেন, সুপেয় পানির অভাবে পাইকাগাছা-কয়রাসহ সমগ্র উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ হাহাকার করছে। এখানে ধনী, দরিদ্রের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বর্তমানে সব পানির আধার লবণ পানিতে ভর্তি, যা পানের অযোগ্য। একমাত্র ভরসা বৃষ্টির পানি। বছরে চার মাস বৃষ্টি হতে পারে, বাকি আট মাসের পানি সঞ্চয় করে না রাখতে পারলে পানির হাহাকার বেড়ে যাবে। পানি সঞ্চয় করে রাখার জন্য সব পরিবারে পানির ট্যাংকি সরাবরাহ করা অতীব জরুরি। তাই আমার দাবি হয় সুপেয় পানির ব্যবস্থা করে দেন, না হয় সাগরের লবণাক্ত পানি পান করে বেঁচে থাকার উপায় বের করে দেন।

আওয়ামী লীগ নেতা রশীদুজ্জামান বলেন, প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে আমার নির্বাচনী এলাকা কয়রা ও পাইকগাছা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুর্যোগের মধ্যে শত শত মানুষ নিয়ে কাজ করেও বাঁধ রক্ষা সম্ভব হয়নি। চোখের সামনে ভেসে গেছে বাঁধ ভেঙেছে, রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ক্ষেতের ফসল, মাছের ঘের সবকিছুই। ক্ষতির একটি তাৎক্ষণিক তালিকা দাখিল করেছি। কিন্তু আঙ্কিক হিসেবে এই ক্ষতি নিরুপণ করা সম্ভব নয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী কয়রা উপজেলাতে গিয়েছিলেন। তিনি দুই উপজেলার ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা গ্রহণ করেছেন। নেত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান করবেন বলে প্রতিশ্রুতিও দেন। জনগণ দ্রুত প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন চায়।

সরকার দলীয় ওই সংসদ সদস্য বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের দুর্যোগ নিত্যদিনের সঙ্গী। এর থেকে রক্ষা পাওয়ার অন্যতম অবলম্বন টেকসই বেড়িবাঁধ। সেই বেড়িবাঁধ নির্মাণে প্রধানমন্ত্রী বরাদ্দ দিয়েছেন, কিন্তু কাজের অগ্রগতি নেই। ষাটের দশকে যে ওয়াপদার বাঁধ তৈরি হয়েছিল, সেই বাঁধ আর সংস্কার হয়নি। মাটি ক্ষয় হয়ে দিনে দিনে বাঁধ নিচু হয়েছে, আর নদীর বুকে পলি জমে জমে পানির উচ্চতা বেড়েছে। ফলে এবারের জলোচ্ছ্বাসে পানি ছাপিয়ে পাইকগাছা ও কয়রার বহু জায়গায় বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে টেকসই বেড়িবাঁধের বিকল্প নেই। বাঁধের তলদেশ দিয়ে পানি সরাবরাহের পাইপ থাকলে বেড়িবাঁধ টেকসই সম্ভব হবে না। কোনো পাইপ ছাড়াই বাঁধ নির্মাণ করতে হবে।

এমপি রশীদুজ্জামান বলেন, ২০০৯ সালের আইলা থেকে ২০২৪ সালের রেমাল পর্যন্ত সব ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে সুন্দরবন লণ্ডভণ্ড হয়েছে। সুন্দরবন নিজে বিপর্যস্ত হয়ে ঝড়ের গতিকে দুর্বল করে দিয়েছে। অতীতের সরকারগুলো সেই সুন্দরবন লুটপাট করেছে। জননেত্রী শেখ হাসিনার সূদুর প্রসারী পদক্ষেপে সুন্দরবনের লুটপাট বন্ধ হয়েছে, সুন্দরবনের শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে। বন্যপ্রাণীদের নিরাপদে বেঁচে থাকার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার দাবি, সুন্দরবন অভন্তরে প্রত্যেকটা দ্বীপে বন্যপ্রাণীর উপযোগী আশ্রয়কেন্দ্র করে দেওয়া হোক। আপদকালীন সময়ে তারা যেন সেখানে আশ্রয় নিতে পারে।

তিনি আরো বলেন, সুন্দরবন আমাদের অক্সিজেন ফ্যাক্টরি। এক শ্রেণির দুস্কৃতিকারীরা চুরি করে বনের গাছ কাটে, বিষ দিয়ে মাছ ধরে এবং সুযোগ পেলে বাঘ মারে ও হরিণ ধরে। এদের কঠোর হস্তে দমন করতে হবে।

আওয়ামী লীগ নেতা রশীদুজ্জামান বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলের দরিদ্র নারীদের জীবিকার জন্য চিংড়ি ঘেরে লবণ পানিতে কাজ করতে হয়। শ্যাওলা ভরা লবণ পানিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শরীর ডুবিয়ে রাখার জন্য তাদের শরীরে বাসা বাঁধে নানা রকম দুরারোগ্য ব্যাধি। তাদের চেহারা নষ্ট হয়ে যায়, চর্মরোগ এবং ক্যান্সারসহ বহুবিধ রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। এক শ্রেণির নারীরা নদীতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গলা সমান পানিতে ঠেলা জাল ঠেলে বাগদা চিংড়ির পোনা আহরণ করায় তারা শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। এই মানবেতর পেশার পরিবর্তে ওই সব দরিদ্র নারীদের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত কর্মসংস্থান সৃষ্টির জোর দাবি জানাচ্ছি।

এসআর/এসএম