কামারশালায় সারা বছর দা-ছুরি তৈরি হলেও ঈদুল আজহার সময় ব্যস্ততা আরো বেড়ে যায়/ছবি- ঢাকা পোস্ট

আর মাত্র চারদিন পরেই মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের ত্যাগের উৎসব ঈদুল আজহা। পশু কোরবানির মধ্য দিয়ে এই উৎসব পালন করেন মুসলমানরা। ফলে কোরবানির জন্য পশু সংগ্রহের পরই সবচেয়ে প্রয়োজন হয় দা, ছুরি, চাপাতি ও কাঠের গুঁড়ি কেটে তৈরি খাইট্টার। প্রয়োজনীয় এসব জিনিসের জোগান দিতে ঈদের আগে ব্যস্ত সময় পার করছেন কামারশালার কর্মীরা। অন্যদিকে লোহার দাম বাড়ায় বেড়েছে এগুলো দিয়ে তৈরি হাতিয়ারের।

ক্রেতারা বলেছেন- বাজারে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দাম বেড়েছে পশু কোরবানিতে অতি প্রয়োজনীয় হাতিয়ারের। দামের সঙ্গে হাতিয়ারগুলোর মান নিয়েও প্রশ্ন আছে এখন।

অন্যদিকে কোরবানির ঈদ সন্নিকটে হলেও দা-ছুরি-চাপাতি-খাইট্টার ব্যবসায়ীদের দাবি— আগের মতো সাড়া নেই ক্রেতাদের। বিক্রিও তেমন একটা বাড়েনি। চাইনিজ হাতিয়ারের তুলনায় দেশি হাতিয়ারের মান ভালো।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারের টিসিবি ভবনের সামনে দিয়ে বাজারের ভেতরে ঢুকলেই ওয়াসার পাম্প। পাম্পের মোড়ে দাঁড়াতেই কানো ভেসে এলো লোহা কাটার মেশিনের আওয়াজ ও লোহায় হাতুড়ির বাড়ির টাং টুং শব্দ। সামনে তাকাতেই চোখে পড়ল গোটা দশেক দোকান। দোকানগুলোতে ঝুলছে দেশি ও চাইনিজ কুড়াল, দেয়ালে সাজানো পশু জবাইয়ের বড় ছুরি (ডেউ)। এছাড়া সাজানো আছে দা, বটি, নানা সাইজের ছুরি। এলইডি লাইটের আলোতে হাতিয়ারগুলোর ধারালো অংশ চিকচিক করছে। কাছে যেতেই দোকানিদের ডাক— ‘মামা এদিকে আসনে, কি লাগবে?’

মঙ্গলবার (১১ জুন) সন্ধ্যায় কারওয়ান বাজারে হাতিয়ারের দোকানগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, কিছু দোকানের সামনে কয়েকজন ক্রেতার ভিড়, বেশিরভাগ দোকানই ক্রেতাশূন্য। দোকানগুলোর পেছনেই রয়েছে ছোট ছোট কামারশালা। কামারশালায় চলছে নিরবচ্ছিন্ন হাতিয়ার তৈরির কর্মযজ্ঞ। এছাড়া পুরোনো হাতিয়ারগুলো শাণ দিচ্ছেন কর্মীরা।

দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাকিস্তান আমল থেকে এখানে ছুরি-চাপাতির ব্যবসা। এখানের সবাই বেশ পুরোনো ব্যবসায়ী। বছরের অন্য সময় কম চললেও ঈদের আগে ছুরি-চাপাতি-কুড়ালের চাহিদা বাড়ে। তবে এ বছর এখনও ক্রেতার অতটা সমাগম হয়নি।

দোকানগুলোতে বড় ছুরি (ডেউ) প্রতিটি ৬০০ থেকে ১৬০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে; ছোট-মাঝারি ছুরিগুলো প্রতিটি ১০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে; পাকা লোহার তৈরি চাপাতিগুলো কেজি ৬০০ থেকে ৮০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে; দেশি কুড়াল প্রতিটি ৮০০ থেকে ১২০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে; চাইনিজ কুড়াল প্রতিটি ৬০০ থেকে ৯০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে এবং খাইট্টা প্রতিটি ৪০০ থেকে ১২০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে বটি, দা-এর কেজি ৭০০ টাকা এবং প্রতিটির দাম ৫০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকার মধ্যে।

মনিপুরী পাড়া থেকে আসা ক্রেতা সোহেল রানা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বেশ কয়েকটি দোকান ঘুরে দেখলাম গতবারের তুলনায় এবার লোহার তৈরি সবকিছুর দাম বেশি। একটা বড় ছুরি (ডেউ) পছন্দ হয়েছে, কিন্তু ১৩০০-১৪০০ টাকার নিচে কেউ দিতে চাইছে না। অথচ এগুলোই এক দুই বছর আগে ৭০০ থেকে ৯০০ টাকার মধ্যেই ছিল। এই একইমানের একটা ডেউ ২০২২ সালে কিনেছিলাম ৮০০ টাকায়। ২০০-২৫০ টাকার গাছের খাইট্টাগুলোও এখন ৪০০-৫০০ টাকার নিচে কেউ দিচ্ছে না।

আরেক ক্রেতা দিনা আক্তার শারমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, একটা বড় বটি খোঁজ করছিলাম। বাজারে দেখলাম কয়েক ধরনের লোহার বটি আছে। মান ভেদে একেক দাম। যেসব পছন্দ হয় সেগুলোর দাম প্রায় ৫০০ টাকা। এই মানের বটিগুলো আগে ৩০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যেত।

মায়ের দোয়া নোয়াখালী হার্ডওয়্যার কামারশালার করিম বাটল জানান, লোহার দাম বাড়ার কারণে পাকা লোহার তৈরি জিনিসের দাম বেশি। আগে আমরাও কম দামেই বিক্রি করেছি। এখন আমাদের পাত কিনে বানানোর খরচ বেশি, তাই বাধ্য হয়ে বেশি দামে বিক্রি করতে হয়। চাইনিজ হাতিয়ারের দাম একটু কম। দেশি ও চাইনিজ দুই ধরনের হাতিয়ারেরই চাহিদা আছে।

তিনি আরও বলেন, এখন ক্রেতারা আসছেন, দেখছেন। এরমধ্যে কেউ কেউ কিনছেন। আগে দূর জেলা থেকে মানুষ আসতো হাতিয়ার কিনতে। এখন আর আগের মতো মানুষ আসে না। এখন শহরের লোকজনই বেশি আসে। এখন ক্রেতা কম, সময়তো আরও চারদিন আছে, হয়ত ক্রেতারা আসবেন।

মা জননী ভোলা কামারশালার প্রোপাইটার জাফর কর্মকার বলেন, এখানে আমাদের হাতিয়ারের পুরোনো ব্যবসা। সারা বছরের পাশাপাশি ঈদে হাতিয়ারের চাহিদা বেশি। আমাদের দোকান কিন্তু সারা বছরই খোলা থাকে। দিনদিন এসব হাতিয়ারের দাম বেড়েছে। যেসব চাপাতি-কুড়াল আমরা একসময় ১০০ টাকায় বিক্রি করেছি, সেসব এখন ১০০০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। এসব নিজের চোখে দেখেছি।

তিনি আরও বলেন, আগে পাকা লোহার দা-চাপাতি পাওয়া যেত, যেগুলো মানে ভালো। এখন পাকা লোহা, মিক্স লোহা সব ধরনের দা-চাপাতি পাওয়া যায়। মান ভেদে একেক হাতিয়ারের একেক দাম। ক্রেতারা তাদের চাহিদা অনুযায়ী কেনেন। দেশীয় তৈরি পাকা লোহার দা-চাপাতি-কুড়ালগুলো এখনও মানে ভালো। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে চাইনিজ হাতিয়ার। এগুলোর দাম দেশি হাতিয়ারের চেয়ে কম এবং দেখতে আকর্ষণীয়। তবে দেশীগুলোর মানের সমান না।

বছর ঘুরে আসে ঈদুল আজহা। প্রতি বছরই ঈদের আগে ডেউ, দা, চাপাতি, ছুরি, বটি, কুড়াল, চট, খাইট্টার চাহিদা বাড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে। তবে প্রয়োজন অনুযায়ী সারা বছর বিক্রি হয় হাতিয়ারগুলো।

এমএইচএন/জেডএস