‘বাপুরে আমাগের ঘরদোর ছিল না। কি কষ্টে দিন কাটেছি কতি পারবো না। এহন সে কষ্ট নাই। শেখের বেটি ঘর করি দিছে। এলা (এখন) সারাদিন মাঠত কাজ করি, আর রাইতে নিজ ঘরত সুখ করি ঘুম পাড়ি। খাবার কডা কম আর বেশি জোটে তাতে আক্ষেপ নেই। নিজ ঘরে থাকতি পারি এটিই বড় সুখ। জীবনে কোনোদিন আমার যে একটা ঘর হবি সেটা স্বপ্নেও ভাবিনি’— এভাবেই নিজের আনন্দ প্রকাশ করেন মুজিব শতবর্ষে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় জমি, পাকা ঘর পাওয়া আয়েশা সিদ্দিকা। শুধু তিনিই নন, বরং লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ থানার কাকিনা ইউনিয়নের অসংখ্য হতদরিদ্র, ভূমিহীন, আশ্রয়হীন মানুষের স্থায়ী ঠিকানা হয়েছে এখন মহিষামুড়ি আশ্রয়ণ কেন্দ্রে।

রোববার (৯ জুন) সরেজমিনে এই এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মুজিব শতবর্ষে যেসব ভূমিহীন ও আশ্রয়হীন ঘর পেয়েছিলেন তারা এখন মোটামুটি স্বাবলম্বী। নিজেদের জমির বাড়তি জায়গায় ছোট টিনের ছাউনি করে অনেকেই পাশাপাশি গবাদিপশু লালনপালন করছেন। গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগির পাশাপাশি ভ্যান চালিয়ে, দোকান দিয়ে, মুদিপণ্য বিক্রি করে এবং সেলাই মেশিন চালিয়ে সংসারের হাল ধরেছেন নারী-পুরুষেরা।

মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষ্যে আশ্রয়হীন হিসেবে এই জায়গায় জমি এবং ঘর পেয়েছিলেন বৃদ্ধ বাদল মিয়া এবং কমলা বেগম দম্পতি। জীবন জীবিকার তাগিদে তারা ঘরের সামনে চকি বিছিয়ে খুলেছেন ছোট্ট দোকান। সেখানে প্রতিদিন রুটি, কলা, বিস্কিট আর পান বিক্রি করেন। তা থেকে যে আয় হয় তা দিয়েই খেয়ে পড়ে বেঁচে আছেন তারা। তবে তাতে আক্ষেপ নেই। জীবনের সায়াহ্নে এসে নিজের জমি আর ঘর হয়েছে তাতেই বেজায় খুশি তারা।

বৃদ্ধ বাদল মিয়া বলেন, আমি এবং আমার স্ত্রী দুজনে মিলে জীবনে অনেক কষ্ট করেছি। আমাদের সন্তান-সন্ততি আছে কিন্তু তারা আমাদের কোনো খোঁজ-খবর নেয় না। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে অনেক কষ্ট করছি। সবশেষ এইখানে নিজের জমি ঘর পেয়েছি। সরকার আমাকে এই ঘর দিয়েছে। এখন এই দোকান চালিয়ে আমাদের জীবন চলে যাবে। আমার কোনো কষ্ট নাই।

এই বৃদ্ধ আরও বলেন, আগের চেয়ে এখন আল্লাহর রহমতে অনেক ভালো আছি। ঘরটা হওয়াতে আরো সুখ শান্তি হয়েছে। দোকানে বেচাকেনা তেমন নাই। তবে যা হয় তাতে কোনোরকমে জীবন চালিয়ে নেওয়া যাচ্ছে।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে কমলা বানু বলেন, ঝড় বৃষ্টিতে ভিজে খুব অশান্তিতে ছিলাম। রাস্তায় ঠিকমতো ঘুমাতে পারতাম না। বাসা-বাড়িতে কাজ কাম করে খাইছি। এখন অনেক শান্তিতে আছি।

এছাড়া এই আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর পাওয়া অনেকেই  হাতে কলমে সেলাই মেশিন চালনা শিখে এখন সালোয়ার কামিজ, থ্রিপিস তৈরি করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছেন।

স্থানীয় কালীগঞ্জ থানার উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) জহির ইমাম বলেন, এই প্রকল্পে যারা ঘরবাড়ি পেয়েছেন তাদেরকে হাতে-কলমে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে যাতে করে জীবন জীবিকা নির্বাহের নিজেরাই ব্যবস্থা নিতে পারেন।

অপরদিকে জানা গেছে, লালমনিরহাটের চার উপজেলায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর হস্তান্তর হবে মোট ১ হাজার ২৮২টি। এরমধ্যে কালীগঞ্জ উপজেলায় ৮৭৫ টি, পাটগ্রাম ৯৯টি হাতিবান্ধা ১৬৬টি ও আদিতমারি ১৪২। আগামী মঙ্গলবার বেলা ১১টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে অনলাইনে যুক্ত হয়ে এ প্রকল্প উদ্বোধন করবেন। লালমনিহাটের সঙ্গে আরও উদ্বোধন হবে ভোলা ও কক্সবাজারের আশ্রয়হীন প্রকল্পের ঘর।

পুনর্বাসিত পরিবারগুলোর জন্য বিনামূল্যে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে এবং প্রকল্পের জায়গায় নিরাপদ পানির জন্য নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। প্রার্থনা ঘর এবং কবরস্থান, পুকুর এবং অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের জন্য রাস্তা দিয়ে আবাসন প্রকল্পগুলোকে সহজতর করা হয়েছে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন নোয়াখালী বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি উপজেলার চরপোড়াগাছা গ্রামে ভূমিহীন-গৃহহীন, অসহায় ছিন্নমূল মানুষের পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু হয়। তার ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ১১ জুন, আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের অধীনে পঞ্চম পর্যায়ের দ্বিতীয় ধাপে ১৮ হাজার ৫৬৬টি ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে জমি ও গৃহ হস্তান্তর অনুষ্ঠান গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করবেন।

আরএইচটি/জেডএস