পিবিআইয়ের তদন্তে বেরিয়ে এলো চাঞ্চল্যকর তথ্য
সন্তান বিক্রির টাকার ভাগ নেন মা, স্বামীকে ফাঁসাতে মামলা
একটি নালিশি মামলা তদন্তে নেমে দুই যমজ শিশুকে উদ্ধার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) চট্টগ্রাম মেট্রো ইউনিট। উদ্ধারের পর সংস্থাটির কর্মকর্তারা ঘটনা সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য জানান।
তারা জানান, উদ্ধার হওয়া যমজ শিশুরা গর্ভে থাকাকালীন সময়ে বিক্রির চুক্তি করেন তাদের মা। পরবর্তীতে পৃথিবীর আলো দেখার সঙ্গে সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী মোট ৩ লাখ টাকা দিয়ে দুই দম্পতির কাছে তাদের বিক্রি করে দেওয়া হয়। যদিও এ ঘটনায় মোট ৪ লাখ টাকা লেনদেন হয়। বাকি এক লাখ টাকা নেন চুক্তির মধ্যস্থতাকারী এক নারী।
বিজ্ঞাপন
উদ্ধার হওয়া শিশু দুটির নাম রায়ান ও ফাহমিদা। শনিবার (৮ জুন) রাঙ্গুনিয়া উপজেলা থেকে একজনকে এবং অপরজনকে নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থেকে উদ্ধার করা হয়। দুই শিশুরই বয়স ৫ মাস ৫ দিন। উদ্ধারের পর আজ (রোববার) দুপুরের পর শিশুদের মানবপাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। কিন্তু আদালতের বিচারক ততক্ষণে এজলাস থেকে নেমে যান। বর্তমানে দুই শিশু, তাদের মা এবং শিশুদের দত্তক নেওয়া দুই নারী নগরীর ডবলমুরিং থানার পাশে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রয়েছেন। আদালতের মৌখিক নির্দেশে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানান পিবিআই কর্মকর্তারা।
আদালতে দায়ের হওয়া নালিশি মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট পিবিআই কর্মকর্তারা ঢাকা পোস্টকে জানিয়েছেন, ৩১ মার্চ মানবপাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে মুন্নী আকতার নামে এক নারী মামলা করেন। তিনি অভিযোগে উল্লেখ করেন, গত ৩ জানুয়ারি নগরের পাঁচলাইশ থানার একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি এক ছেলে এবং এক মেয়ের জন্ম দেন। জন্মের পরপর বাবা হাবিবুর রহমান সন্তান দুটিকে অজ্ঞাতনামা নারীদের হাতে তুলে দেন। বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক রোকসানা আকতার ও মামুন এ কাজে সহযোগিতা করেন।
ঘটনার সময় বিষয়টি নিয়ে মুন্নী আকতারের মেয়ে রুমা আকতার ও ছেলে রেহান প্রতিবাদ করলে হাবিবুর রহমান তাদের বাথরুমে আটকে রাখেন। পরবর্তীতে চিকিৎসকরা জানান, জন্মের পর বাচ্চা দুটি অসুস্থ হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য তাদের চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তবে মুন্নী তার সন্তানদের কোনো খোঁজ না পেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হন বলে আবেদনে উল্লেখ করা হয়। আদালত মামলাটির অভিযোগ শুনে পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো ইউনিটকে তদন্তের আদেশ দেন।
এ মামলার তদন্তে নেমে সম্পূর্ণ ভিন্ন তথ্য পায় পিবিআই। সংস্থাটি জানায় মুন্নী আকতার ও তার স্বামী পটিয়া উপজেলার এক বাবুর্চির সহকারী হিসেবে কাজ করেন। আনুমানিক ১৫ মাস আগে মুন্নী আকতার গর্ভবতী হন। জন্মের আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানতে পারেন তার পেটে এক ছেলে এবং এক মেয়ে রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে তিনি রাশেদা বেগম নামে এক নারীর সঙ্গে আলাপ করেন।
রাশেদার সঙ্গে আগে থেকে শিরু আকতার ও রুনা আক্তার নামে দুই নারী যোগাযোগ করেন। তাদের মধ্যে শিরু আক্তারের তিন মেয়ে ছিল। এ কারণে তিনি একটি ছেলে সন্তান দত্তক নিয়ে দিতে রাশেদাকে অনুরোধ করেন। আবার রুনা আক্তারের এক ছেলে থাকায় তিনি একটি মেয়ে দত্তক নিয়ে দিতে রাশেদাকে অনুরোধ করেন। রাশেদা মামলার বাদী মুন্নী আকতারের পেটে দুই সন্তান আছে জানতে পারেন। এরপর তিনি রুনা এবং শিরু দুজনকে সন্তানের ব্যবস্থা করে দেওয়ার বিষয়ে আশ্বস্ত করেন। কথা চালাচালি করে দরদামও ঠিক করেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো ইউনিটের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. শাহেদুল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাশেদা শিরু আক্তারকে ছেলে সন্তান ম্যানেজ করে দেওয়ার জন্য ৩ লাখ টাকার চুক্তি করেন এবং রুনাকে মেয়ে সন্তান দেওয়ার জন্য ১ লাখ টাকার চুক্তি করেন। আবার রাশেদা বাদী মুন্নীর সঙ্গে ছেলের জন্য ২ লাখ এবং মেয়ের জন্য ১ লাখ টাকা দেওয়ার চুক্তি করেন। মাঝখানে রাশেদার নিজের জন্য ১ লাখ টাকা লাভ রাখেন। পাশাপাশি মুন্নীর চিকিৎসার খরচও রাশেদা বহন করবেন বলে চুক্তি করেন। চুক্তি অনুযায়ী জন্মের পরপরই রাশেদা দুই শিশুকে নিয়ে দুই নারীকে বুঝিয়ে দেন। পাশাপাশি রাশেদা দুই নারী থেকে ৪ লাখ টাকা নিয়ে ৩ লাখ টাকা মুন্নীকে বুঝিয়ে দেন।
এসআই শাহেদুল্লাহ আরও বলেন, যমজ সন্তান দুটির মা মুন্নী সন্তান বিক্রির বিষয়ে স্বামী হাবিবুর রহমানের সঙ্গে আগেই শেয়ার করেছিলেন। এতে রাজিও হয়েছিলেন হাবিবুর। কিন্তু হাবিবুর জানতেন শিশু দুটি বিক্রি হয়েছিল দেড় লাখ টাকা দিয়ে। যদিও মুন্নী মোট ৩ লাখ টাকা দিয়েই তার নাড়িছেঁড়া দুই সন্তানকে দত্তক দিয়ে দেন। পরবর্তীতে টাকা নিয়ে মুন্নী এবং তার স্বামী হাবিবুরের মধ্যে মনোমালিন্য হওয়ায় আদালতে মামলাটি দায়ের করা হয়। মামলার তদন্তে নেমে ভুক্তভোগী দুই শিশুকে উদ্ধার করা হয়। আদালতের নির্দেশে শিশু ও তাদের প্রকৃত মা এবং দত্তক নেওয়া দুই নারীসহ ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রাখা হয়েছে। আগামীকাল (সোমবার) শিশুদের পুনরায় আদালতে হাজির করা হবে। এরপর বিচারকের নির্দেশনা সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এমআর/এসকেডি