অধিকাংশ লোকজনেরই ছিল না ঘর-বাড়ি কিংবা কোনো ঠিকানা। আশ্রয়হীন-গৃহহীন হিসেবেই কাটিয়েছেন তারা জীবনের পুরোটা সময়। কেউবা আবার একটু মাথা গোঁজার জায়গার অভাবে জীবনের অর্ধেক সময়ই হাবুডুবু খেয়েছেন নানান সংকটে। রোদে পুড়েছেন, বৃষ্টিতে ভিজেছেন, কেঁপেছেন তীব্র ঠান্ডায়। তবে এসব এখন অতীত দিনের কথা। প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্প পাল্টে দিয়েছে এসব হতদরিদ্র মানুষের জীবন। পাকা বাড়ি, বিনামূল্যের বিদ্যুৎ, দুই শতাংশ জমি, স্বনির্ভরতার হাতে-কলমে শিক্ষায় পরিবর্তন হয়েছে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ থানার কাকিনা ইউনিয়নের সাত শতাধিক পরিবারের এক হাজারেরও বেশি মানুষের জীবন। একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই তাদের দিয়েছে অসীম স্বপ্ন দেখার সাহস।

রোববার (৯ জুন) সরেজমিন মহিষামুড়ি আশ্রয়ণ প্রকল্প ঘুরে দেখা যায় পুরো এলাকাজুড়ে ২৭৩টি পাকা বাড়ি। যার প্রতিটিতেই এখানকার আশ্রয়হীন এবং গৃহহীন মানুষেরা জায়গা পেয়েছেন। ইট বিছানো প্রশস্ত রাস্তা করে পুরো আশ্রয়ণ প্রকল্পে উন্নত যোগাযোগের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিরাপদ খাবার পানির জন্য প্রতি ১০টি পরিবারের জন্য একটি করে গভীর নলকূপ আর স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রতিটি বাড়ির সঙ্গেই উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া মোট ১৬.৪৩ একরের পুরো জায়গাজুড়ে লাল টিন এবং পাকা দালানের সারির মাঝে-মাঝে আম, কাঁঠাল, আমড়া, সুপারিসহ বিভিন্ন ফলফলাদির গাছ লাগানো হয়েছে। ঘর সংলগ্ন পার্শ্ববর্তী জায়গাগুলোতেও সবজি চাষ করা হচ্ছে। রয়েছে বড় দুটি পুকুর। আশ্রয়ণ প্রকল্পে থাকা মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণে এসব পুকুরে সমন্বিত উদ্যোগে করা হয় মাছ চাষ।

এসব মাছ বড় হলে ধরে আশ্রয়ণ প্রকল্পে থাকা মানুষদের হাতেই তুলে দেওয়া হয়। রয়েছে মসজিদ। তার পাশেই রয়েছে প্রাইমারি স্কুল। এই প্রকল্পের আওতায় ঘর পাওয়া নারীদের দেওয়া হয় সেলাই, কুটির শিল্পসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ। যাতে করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করতে কারো কাছে হাত পাততে না হয়।

এখানকার মানুষজন বলছেন, এমন সাজানো গোছানো পরিবেশ সবার কাছেই স্বপ্নের মতো। জীবনে কোনোদিন নিজের মাথা গোঁজার ঠাঁই হবে সেটি তারা কল্পনাও করেননি।

মনোয়ারা বেগম নামের এক উপকারভোগী বলেন, আমার নিজের মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে। এটা কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবিনি। এখানে ছেলে স্বামী নিয়ে সুখের সংসার করতে পারছি। সরকার আমাকে পাকা ঘর করে দিয়েছে। আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য অনেক দোয়া জানাই। আমাদের কোনো ঠাঁই-ঠিকানা ছিল না। রোদে বৃষ্টিতে অনেক কষ্ট করেছি। এখন নিজের ঘর হয়েছে। এটাই আমাদের কাছে অনেক খুশির ব্যাপার।

মোমেনা খাতুন নামের আরেক নারী বলেন, আমার স্বামী এক্সিডেন্ট করে মারা গেছে। এরপর থেকে আমি সাগরের ফেনার মতো ভেসে ভেসে ঘুরেছি। একমাত্র প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে অনেক কষ্টের দিন কাটিয়েছি। এখন আমার ঘর দুয়ার হয়েছে। পাকা বাড়ি পেয়েছি। আমার সুখের সীমা নাই। ঘরের সামনে যে জায়গাটুকু আছে সেখানে সবজি চাষ করি। এখনো আমাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়। নিজের জমিতে ঘর বানিয়ে থাকতে পারব এটি কোনোদিন কল্পনাও করিনি।

স্থানীয় কালীগঞ্জ থানার উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) জহির ইমাম বলেন, ভূমিহীন এবং গৃহহীন অসংখ্য পরিবারকে ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে পঞ্চম পর্যায়ে দ্বিতীয় ধাপে ৮৭৫টি ভূমিহীন এবং গৃহহীন পরিবারের সদস্যদের জন্যও ঘর তৈরির কাজ শেষ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ১১ জুন কাকিনা মহিষামুড়ি আশ্রয়ণ প্রকল্প থেকে স্থানীয় কালীগঞ্জ থানার তুহিন এবং গৃহহীন পরিবার রয়েছে তাদেরকে উপহারের ঘর আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করবেন। সেই সঙ্গে কালীগঞ্জ উপজেলাকে ভূমিহীন এবং গৃহহীনমুক্ত উপজেলা হিসেবে ঘোষণা করবেন।

তিনি আরও বলেন, শুধু ঘর উপহার দিয়েই সীমাবদ্ধ থাকা হয়নি বরং তাদের জীবন-জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রশিক্ষণমূলক বিভিন্ন কর্মসূচিও হাতে নেওয়া হয়েছে। তাদের দুই শতাংশ জমি দলিলের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়ে তারমধ্যে সবজি চাষের মাধ্যমে স্বনির্ভরতা অর্জনের বিষয়ে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এরইমধ্যে উপকারভোগীরা প্রশিক্ষিত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে অর্থ উপার্জন করতে পারছেন। অনেকের ঠিকানা ছিল রাস্তায় তারা এখন স্থায়ীভাবে মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়েছেন।

অপরদিকে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের অধীনে ৫ম পর্যায়ের ২য় ধাপে মঙ্গলবার (১১ জুন) সারাদেশে ১৮ হাজার ৫৬৬টি ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে জমি ও গৃহ হস্তান্তর করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী সহকারী প্রেস সচিব এ. বি. এম সরওয়ার-ই-আলম।

তিনি বলেন, গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কার্যক্রমের ভার্চুয়াল উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী ৩টি উপজেলার (লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ, কক্সবাজার জেলার ঈদগাঁও এবং ভোলা জেলার চরফ্যাশন) সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত হবেন। এসময় প্রধানমন্ত্রী জমিসহ ১৮ হাজার ৫৬৬টি একক গৃহ হস্তান্তর করবেন।

তিনি আরও বলেন, এখন পর্যন্ত অশ্রয়ণ প্রকল্প এবং অন্যান্য কার্যক্রমের মাধ্যমে ঘর দেওয়ার মাধ্যমে ৪৩ লাখ ৪০ হাজার ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষ পুনর্বাসিত হয়েছেন। আর শুধু আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে পুনর্বাসিত হয়েছেন ২৯ লাখ ১০ হাজার ২৬৫ জন মানুষ।

এছাড়া এ পর্যায়ে ঢাকা, গোপালগঞ্জ, শরিয়তপুর, ফরিদপুর, নেত্রকোণা, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর নোয়াখালী, কুমিল্লা, ফেনী, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, নীলফামারী, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, সাতক্ষীরা, যশোর, খুলনা, নড়াইল, বাগেরহাট, বরগুনা, বরিশাল, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলার সব উপজেলাসহ মোট ৭০টি উপজেলা ভূমিহীন-গৃহহীনমুক্ত হতে যাচ্ছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

আরএইচটি/জেডএস