মোবাইলে লেনদেন-যোগাযোগ
জাল নোট যাচ্ছে মফস্বলের গরুর হাটেও, মাধ্যম কুরিয়ার সার্ভিস
কোরবানির ঈদ আসন্ন। ঈদকে ঘিরে অন্যান্য বছরের মতো সক্রিয় জাল টাকার কারবারিরা। সুযোগ কাজে লাগাতে রাজধানীর কদমতলীতে তৈরি করা হচ্ছিল জাল টাকা। সুনির্দিষ্ট তথ্য ও গোয়েন্দা নজরদারির ভিত্তিতে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার কদমতলী এলাকায় অভিযান চালিয়ে দেশি-বিদেশি জাল নোট তৈরি চক্রের প্রধান জাকিরসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)
ডিবি লালবাগ বিভাগের একটি দল শনিবার (৮ জুন) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দুটি বাসায় অভিযান পরিচালনা করে তাদের গ্রেপ্তার করে।
বিজ্ঞাপন
গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিরা হলেন, চক্রের প্রধান লিয়াকত হোসেন জাকির ওরফে মাজার জাকির ওরফে গুরু জাকির (৪০), তার দ্বিতীয় স্ত্রী মমতাজ বেগম (২৫), লিমা আক্তার রিনা (৪০) ও সাজেদা আক্তার (২৮)।
ডিবি পুলিশ বলছে, ঈদুল আজহাকে টার্গেট করে চক্রটি বিপুল পরিমাণ জাল নোট বাজারে ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ঢাকায় তৈরি এই জাল নোট বিক্রির জন্য যোগাযোগ হতো অনলাইনে আর লেনদেন হতো মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। লেনদেনের পর কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পাঠানো হয় জাল নোট। যার বেশিরভাগ এবার যাচ্ছে মফস্বলে। টার্গেট কোরবানির পশুর হাট।
অভিযান সম্পর্কে ডিবি লালবাগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. মশিউর রহমান বলেন, অভিযানে দুটি বাসা থেকে প্রায় সোয়া এক কোটি টাকা এবং আরও প্রায় তিন কোটি জাল টাকা তৈরির মতো বিশেষ কাপড়/কাগজ, বিশেষ ধরনের কালি, ল্যাপটপ, চারটি প্রিন্টার, বিভিন্ন সাইজের কয়েক ডজন স্ক্রিন/ডাইস, সাদা কাগজ, হিটার মেশিন, নিরাপত্তা সুতাসহ জাল টাকার হরেক রকম মালামাল উদ্ধার করা হয়েছে। ২০০, ৫০০, এক হাজার টাকার জাল নোট ও ভারতীয় ৫০০ রুপির বিপুল পরিমাণ জাল নোট উদ্ধার করা হয়।
তিনি বলেন, ২৫ বছর ধরে জাল টাকার খুচরা ও পাইকারি কারবার করার পাশাপাশি বিভিন্ন মানের জাল টাকা ও জাল রুপি তৈরির অত্যন্ত দক্ষ লিয়াকত হোসেন জাকির। তিনি ২০১২ সাল থেকে ৫০০ ও এক হাজার টাকার জাল নোট তৈরি করলেও বর্তমানে সাধারণ মানুষ যেন সন্দেহ করতে না পারেন সেজন্য বড় নোটের পাশাপাশি ১০০ ও ২০০ টাকার জাল নোট তৈরি করতেন। বর্তমানে কাগজ, ল্যাপটপ, কম্পিউটারের কালি ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় জাকির এক হাজার টাকার ১০০টি নোটের বান্ডেল ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করতেন।
গত ১২ বছরে জাকির কখনো জাল টাকা খুচরায় বিক্রি করেননি। নারী-পুরুষ মিলে তার প্রায় ১৫/২০ জন কর্মচারী আছেন, যাদের মাসে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা বেতন দিতেন। তারা ব্যক্তি পর্যায়ে জাল টাকা বিক্রি করলে ধরা পড়তে পারেন, সেই ঝুঁকি এড়াতে অনলাইনে (বিশেষত ফেসবুক ও মেসেঞ্জার) দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ক্রেতাদের কাছ থেকে অর্ডার নিয়ে কুরিয়ারের মাধ্যমে জাল নোট বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দিতেন তারা।
অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি পাওয়া এ কর্মকর্তা আরও বলেন, জাল নোট তৈরির সময় জাকিরের সহযোগীরা গ্রেপ্তার হলে জাকির মাজারে মাজারে অবস্থান করতেন। মাজারের কচ্ছপ, মাছের খাবার নিয়ে ব্যস্ত থাকেন বলে তাকে মাজার জাকির বলা হয়। অপরদিকে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় জাল নোটের ছোট ছোট ঘরোয়া কারখানা স্থাপনকারীরা জাকিরের কাছ থেকে কারিগর, সফট কপি, পরামর্শ এমনকি মডেল জাল রুপি নিয়ে থাকেন বলে জাকিরকে গুরু জাকির বলেও চেনেন অনেকে।
অভিযান সম্পর্কে মশিউর রহমান বলেন, গত রোজার ঈদের আগে জাকিরের জাল নোটের দুই পাইকারি ক্রেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের সূত্র ধরে রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকার এক নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই নারী মাদকের একটি মামলায় কারাগারে গিয়ে জাল নোট চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এরপর জামিনে এসে জাল টাকার কারবার শুরু করেন। ঈদকে সামনে রেখে তিনি বিপুল পরিমাণ জাল নোট কেনার জন্য এসেছিলেন। তার সূত্র ধরে জাকিরকে গ্রেপ্তার করা হয়।
জাল নোট প্রতিরোধে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও আন্তরিক হওয়ার তাগিদ দিয়ে এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, সারাবছর গোয়েন্দা কার্যক্রম চালাতে হয়। নানান ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন। কারণ চক্রগুলো সারাবছরই জাল নোট তৈরি করছে। কয়েকদিন আগে এক নারীই ৫০ লাখ জাল টাকা নিয়েছেন জাকিরের কাছ থেকে। ফলে বোঝাই যাচ্ছে তারা কী পরিমাণ জাল নোট বাজারে ছাড়ছেন। চক্রে ১৫ থেকে ২০ জন এজেন্ট রয়েছেন, যারা সারাদেশে জাল টাকা ছড়িয়ে দিচ্ছেন। ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে গরু-ছাগল বিক্রি বা লেনদেনের সময় অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে টাকা যাচাই-বাছাই করে নেওয়ার পরামর্শ দেন এই কর্মকর্তা।
চক্রের মূলহোতা ও জাল নোট তৈরির কারিগর জাকিরের বিষয়ে ডিসি মশিউর রহমান বলেন, জাকির অত্যন্ত দক্ষ জাল নোট তৈরির কারিগর। তার চক্রে বহু নারী ও পুরুষ রয়েছেন। এসব কর্মচারীকে মাসে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা বেতন দিতেন তিনি। জাকির যে বাসায় অবস্থান করে জাল নোট বানাতেন সেই বাসার আশপাশে সিসি ক্যামেরা বসিয়ে নজরদারি করতেন যেন তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ধরতে না পারে। এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি টের পেলেই তিনি পালিয়ে যেতেন।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, চক্রটির বিভিন্ন জেলায় তাদের এজেন্ট আছে। তারা অনলাইনে যোগাযোগ করে অর্ডার কনফার্ম করে। এজন্য বিকাশসহ মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে পেমেন্ট পাওয়ার পর তারা কুরিয়ারে করে জেলা শহরে পাঠাচ্ছে জাল টাকা। জেলা শহরে বিভিন্ন কোরবানির পশুর হাট আছে। সেখানে তারা এই জাল টাকা গুলো নিজেরা কেনাকাটা করে পাশাপাশি জাল টাকা বিক্রি।
হারুন বলেন, ঈদকে কেন্দ্র করে মফস্বল পর্যন্ত জাল টাকার চালান ছড়িয়ে দেওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গরুর ব্যবসায়ীরা। কারণ গরু ব্যবসায়ীরা যা দাম বলে সেই দামেই গরু কিনে নেয় জাল টাকা দিয়ে। সেখানে জাল টাকা চেক করার মেশিনও অধিকাংশ গ্রামীণ কোরবানির হাটে নেই। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে খুদে ব্যবসায়ীরা।
আমাদের প্রত্যেকটা মার্কেট ও গরুর হাটে টাকা চেনার মেশিন থাকা জরুরি উল্লেখ করে হারুন বলেন, এই জাল টাকা কারবারি চক্র বাজারে কতো কোটি টাকা পরিমাণ টাকা ছেড়েছে তা আমরা এখনো জানি না। তাই প্রত্যেকটা কোরবানির হাটে জাল টাকা ধরার মেশিন স্থাপন করা উচিত। কোরবানির হাটে ও মার্কেটগুলোতে ঈদের সময় প্রচুর ভিড় থাকে। সেই সুযোগে তারা কিন্তু সহজে ব্যবসা করে যাচ্ছে।
জাল টাকার কারবার সম্পর্কে কারো কাছে কোনো তথ্য থাকলে ডিবি পুলিশকে জানানোর অনুরোধ জানিয়ে হারুন বলেন, ঢাকায় যারা জাল টাকার কারবার করেন তারা অধিকাংশই এখন ঢাকার বাইরে থাকেন। ঈদের সময় আর ঈদের আগে আগে ঢাকায় এসে কারবার শুরু করেন। তাই নজরদারিতে সব জাল টাকা কারবারিটা ধরা পড়ে না। সেজন্য যারাই জাল টাকার কারবার করেন ডিবি পুলিশকে জানান। আমরা অভিযান পরিচালনা করব।
এই জাল টাকার কারবারের শেষ কোথায়? যারাই কারবার করছেন গ্রেপ্তার হচ্ছেন আবার জামিনে বেরিয়ে একই কারবারে জড়িয়ে পড়ছেন। এমন প্রশ্নের জবাবে হারুন বলেন, শুধু জাল টাকা না, ডাকাতি ছিনতাইসহ নানা আসামিকে আমরা গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জেলহাজত থেকে তারা কীভাবে জামিনে বেরিয়ে যায় তা আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। নতুন করে জাল টাকার কারবারে জড়িয়ে যাওয়া কয়েকজনকে আরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তারা বলেছে, জেল থাকা অবস্থায় জাল টাকার কারবারির সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। তাদের এজেন্ট বানানো হয়। লাখ টাকার জাল নোট বিক্রি করতে পারলে ১০ থেকে ১৮ হাজার করে দেয়া হয়। লোভে পড়ে চক্রের মাধ্যমে জড়িয়েছে জাল টাকার কারবারে।
সমাধান সম্পর্কে তিনি বলেন, এই ব্যবসা তো অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সামনে কোরবানির ঈদ। আমাদের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। পাশাপাশি আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার। তবেই আমরা কিন্তু জাল টাকার কারবার নিয়ন্ত্রণে বা কিছুটা হলেও রেহাই পাব।
জেইউ/জেডএস