রিকশাচালককে নিয়ে দেওয়া এডিসি হাফিজুরের পোস্ট ভাইরাল
পেছন থেকে ‘চাচা’ বলে ডাক, কাছে আসতেই জড়িয়ে ধরলেন কালু
গুলশানের আকাশে ঝরছিল ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। এমন আবহাওয়ায় হাঁটা পথে গুলশান-২ হয়ে কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশ ট্রাফিক বিভাগের গুলশান জোনের এডিসি হাফিজুর রহমান। আচমকা ‘চাচা’ ডাক শুনে দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি। আশপাশে তাকিয়ে দেখলেন কেউ নেই। সব মুখ অপরিচিত।
কিন্তু ‘চাচা’ ডাক যে কণ্ঠের, সেটি খুব পরিচিত মনে হলো এই পুলিশ কর্মকর্তার। একটু ভালোভাবে চোখ মেলতেই দেখলেন দাঁড়িয়ে রয়েছেন তার গ্রামের ছেলে কালু। বর্তমানে তিনি গুলশান-বনানী এলাকায় রিকশা চালান। এডিসি হাফিজুর রহমানের সঙ্গে দেখা হতেই চিনতে পারায় ডাক দিয়েছেন কালু। সারা শরীর ঘামে ভেজা তার। কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই কালু দু’হাত দিয়ে জড়িলে ধরলেন এডিসি হাফিজুর রহমানকে। আনন্দের ঝিলিক তখন কালুর চোখে-মুখে।
বিজ্ঞাপন
কালুর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর এমন সুন্দর এক মুহূর্তের কথা উল্লেখ করে ফেসবুকে ছবিসহ একটি পোস্ট দিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ ট্রাফিক বিভাগের গুলশান জোনের এডিসি হাফিজুর রহমান। প্রায় ১৪ ঘণ্টা আগে করা তার পোস্টটি মুহূর্তের মধ্যে সাধারণ মানুষের মন ছুঁয়ে যায়। সেখানে পড়তে থাকা অসংখ্য কমেন্ট, লাইক রিয়েকশন পৌঁছে যায় প্রায় দুই হাজারে। সঙ্গে অনেকেই শেয়ার করেন তাদের নিজ টাইমলাইনে।
আরও পড়ুন
এডিসি হাফিজুর রহমান তার পোস্টে লিখেছেন, ‘আচমকা ডাক শুনে দাঁড়িয়ে গেলাম। আশপাশে তাকিয়ে দেখলাম কেউ নেই। অপরিচিত সব মুখ। কিন্তু ‘চাচা’ ডাক যে কণ্ঠের সেটা খুব পরিচিত মনে হলো। পেছনে ফিরে দেখি কালু। আমাদের গ্রামের ছেলে। ওর বাবার নাম ভাদ্রু। চৌকিদার ছিল ভাদ্রু ভাই।’
আচমকা ডাক শুনে দাঁড়িয়ে গেলাম। আশপাশে তাকিয়ে দেখলাম কেউ নেই। অপরিচিত সব মুখ। কিন্তু 'চাচা' ডাক যে কন্ঠের সেটা খুব পরিচিত...
Posted by Hafizur Rahman Real on Tuesday, June 4, 2024
‘আমি হাঁটছিলাম গুলশান-২ হয়ে কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ের দিকে। যখন দেখা হলো তখন হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। কালু বৃষ্টিতে ভিজছিল। ওর ডাক শুনে থমকে দাঁড়ালাম। কতদিন পর দেখা ওর সাথে আমার? ১০-১২ কিংবা ১৫ বছরেরও বেশি হতে পারে। এর মধ্যে কত পরিবর্তন হয়েছে কালুর। সেই দুরন্ত-দূর্বার কালু এখন পুরোদস্তুর যুবক। আমাকে দেখেই বলে ওঠে চাচা, আমাকে চিনতে পেরেছেন? আমি ভাদ্রু চৌকিদারের ছেলে কালু। সারা শরীর ঘামে ভেজা উসকো খুশকো চুলের কালুকে চিনতে দেরি হলো না এক মুহূর্ত।’
‘কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই কালু দু’হাত দিয়ে জড়িলে ধরলো আমাকে। আনন্দের ঝিলিক তখন ওর চোখে-মুখে। কালুর ঘাম থেকে আমার গ্রামের গন্ধ পেলাম। গন্ধ পেলাম সোঁদা মাটির। গন্ধ পেলাম ভাঁটফুলের, কদম, কৃষ্ণচূড়া, জবা আর বামুনিয়া মোড়ে থাকা অসংখ্য শিমুল-পলাশ ফুলের। আমাকে অনেকক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখলো কালু আর আমার বামুনিয়া গ্রাম।’
‘‘তালগাছের মতো লিকলিকে লম্বা হয়েছে কালু। বাবা ভাদ্রুর মতো পুরো অবয়ব ওর শরীরজুড়ে। গুলশান-বনানীর অলিগলিতে রিকশা চালায়। দরদর করে ঘাম ঝরে ওর শরীর থেকে। রিকশা চালিয়ে মাসে প্রায় কুড়ি হাজার টাকা কামায়। এখান থেকে টাকা পাঠায় ওর ছোটভাই হুমায়ুনকে। ‘হুমায়ুন ছাড়া তো আমার আর কেউ নেই চাচা, আব্বা আমার হাতেই ওকে তুলে দিয়ে গেছে’। কণ্ঠে তার অনুভব বিহ্বলাতা।’’
‘আলাপেই জানলাম কালু বিয়ে করেছিল একবার। লোহাগাড়া হাটের এক মেয়েকে। শ্যামলা গড়ন সেই মেয়েটিকে ভীষণ ভালোবেসেছিল ও। বছরখানেক টিকে ছিল মাত্র। ওর ছোটভাই হুমায়ুনকে তার বউ একদিন বেধড়ক মাইর দেওয়ায় সেদিনই বিয়ের পাঠ চুকিয়ে ফেলে কালু। তখন থেকে আজ অবধি বিয়ে করেনি। কিছুটা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ছোটভাই হুমায়ুনকে প্রতিষ্ঠিত করার লড়াইয়ে এখন ব্যস্ত সে।’
‘‘এর মধ্যেই কালুর ফোন বেজে ওঠে। দু’ভাই আলাপ শুরু করে। কথা বলতে গিয়ে কালু আমার নাম বলাতেই হুমায়ুন আমার সাথেও কথা বলে। অস্পষ্ট উচ্চারণে বলে, ‘ইয়েল চাচা কেমনছি (আছো)? কুরবানি ঈদোত বাড়ি ওসপোনি? (আসবে না)’। আমি বললাম, যাব। ওপাশ থেকে হাসির শব্দ শুনতে পেলাম।’’
‘নাস্তা-পানি খাইয়ে বিদায় দেওয়ার সময় ভীষণ হাসিমাখা মুখ নিয়ে কালু জানাল, সে এবার চার শতক জমি কিনেছে। এই ঈদে ওখানে নতুন বাড়ি করবে। টিনের চাল দেবে তাতে। একটা ছোট রান্নাঘর আর একটা কলপাড় করবে।’
‘কালু রিকশা চালিয়ে চলে যাচ্ছে বনানীর ১১/০৭ বি রোডে। তখন বৃষ্টি সামান্য বেড়েছে। খানিক দূরে গিয়ে হাত উঁচিয়ে আবার তাকায় কালু। সে তাকানোয় মন কেমন করা এক মায়া। এক অজানা ঘোর। আমি সেই ঘোর নিয়েই গাড়িতে উঠি।’
মূলত ইট-পাথর ও কংক্রিটের শহরে যারা জীবিকার তাগিদে বাস করেন, তাদের সবারই মন পড়ে থাকে নিজ গ্রামের বাড়ি, চেনা পথ, সেখানকার মানুষদের কাছে। তাই চলার পথে সেই গ্রামের কারও সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে অনুভূত হয় শিকড়ের টান। তার মাধ্যমে মানুষ খুঁজে পেতে চান নিজ গ্রামের গন্ধ। হারিয়ে যেতে চান এর খবর, ওর খবর... এমন আলাপচারিতায়।
ঠিক তেমনটাই ঘটেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ ট্রাফিক বিভাগের গুলশান জোনের এডিসি হাফিজুর রহমানের সঙ্গেও। ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এমন আবেগ-অনুভূতির কথাই তুলে ধরেছেন।
ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, কালুর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই কালু দু’হাত দিয়ে জড়িলে ধরলো আমাকে। কালুর ঘাম থেকে আমার গ্রামের গন্ধ পেলাম। গন্ধ পেলাম সোঁদা মাটির। গন্ধ পেলাম ভাঁটফুলের, কদম, কৃষ্ণচূড়া, জবা আর বামুনিয়া মোড়ে থাকা অসংখ্য শিমুল-পলাশ ফুলের। আমাকে অনেকক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখলো কালু আর আমার বামুনিয়া গ্রাম। সে এক অন্য রকমের ভালো লাগা। এরপরই তার ছবিসহ তাকে নিয়ে একটি পোস্ট করেছি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
এএসএস/কেএ