মাসিক ৩০ হাজার টাকা বেতনের চাকরির আশায় ট্যুরিস্ট ভিসায় ঢাকা ছাড়েন রোমেল মিয়া। কার্পেট কোম্পানিতে চাকরির কথা বলে নরসিংদীর রোমেল মিয়াকে নেওয়া হয় লিবিয়া। যেসব বাংলাদেশিদের সহযোগিতায় তিনি লিবিয়া যান, পৌঁছে দেখেন তারাই জিম্মি চক্রের সদস্য। রোমেলকে আটকে রেখে নির্মম ও পাশবিক কায়দায় নির্যাতন করে তারা। ভিডিও কলে নির্যাতনের চিত্র দেখিয়ে পরিবারের কাছে দাবি করে ১২ লাখ টাকা মুক্তিপণ।

নিম্নবিত্ত রোমেলের পরিবারের পক্ষে এতো টাকা জোগাড় করা অসম্ভব। এ অবস্থায় নরসিংদী পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) দ্বারস্থ হয় পরিবার। ঘটনার তদন্তে নেমে দেশে অবস্থানরত এই সংঘবদ্ধ চক্রের হোতা সোহেলসহ (২৪) তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। গ্রেপ্তার বাকি দুইজন হলেন- ওয়াসিম হোসেন ও আকারিছ মিয়া। পরে পিবিআইয়ের তৎপরতা ও লিবিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশ দূতাবাসের চেষ্টায় রোমেলকে দেশে ফেরানো সম্ভব হয়।

মঙ্গলবার (৪ জুন) দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডিতে পিবিআইয়ের প্রধান কার্যালয়ে ভুক্তভোগী রোমেল মিয়া বলেন, ‘আমি ভাবতে পারি নাই জীবিত দেশে ফিরতে পারব। আমি দুই কন্যার বাবা। ওদের মুখ শুধু চোখে ভেসেছে। আমি বারবার ওদের পায়ে পড়ে করুণা, কাকুতি-মিনতি করেছি কিন্তু ওরা আমাকে ছাড়েনি। নির্যাতনের পর নির্যাতন করে গেছে।’

রোমেল বলেন, ‘প্লাস দিয়ে আঙ্গুলে চাপ দিতো, লাঠি দিয়ে বেধড়ক পেটাত, চাপাতি গলায় ধরে রাখত। বাড়িতে বারবার কথা বলেছি কোনো রকমে নানা মাধ্যমে দেড় লাখ টাকা পাঠাইছে। এর মধ্যে বাড়ি থেকে গোপনে মামলা করা হয়। সেই খবরও ওরা জেনে যায়। নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। আমি কল্পনা করিনি, বাংলাদেশে ফিরতে পারব, পরিবারের দেখা পাব। এখনো শরীর শিউরে উঠে যে, আমি জীবিত আছি। জীবিত ফিরে আসছি।’

পিবিআই নরসিংদী জেলার পুলিশ সুপার মো. এনায়েত হোসেন মান্নান বলেন, চার লাখ টাকায় রোমেলকে লিবিয়া নেওয়ার চুক্তি হয়। গত ৬ মার্চ দুই লাখ টাকা পরিশোধ করেন এবং ১৪ মার্চ এক লাখ ২৪ হাজার টাকার সমপরিমাণ ডলার নিয়ে রহমত উল্লাহ ও বিল্লাল মিয়ার সঙ্গে রওনা দেন রোমেল। ট্যুরিস্ট ভিসায় দুবাই-মিশর হয়ে রোমেলকে নেওয়া হয় লিবিয়ায়। সেখানে নিয়ে রোমেলকে আটকে রেখে স্বজনদের ভিডিও কল দিয়ে ১২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। পরে গত ১০ এপ্রিল রোমেলের ভাই বাবুল ও তার স্বজনরা পিবিআই নরসিংদী কার্যালয়ে অভিযোগ করেন। টাকা না পাঠালে কখনো বলে হাত কেটে ফেলবে, কখনো বলে মেরে ফেলবে।

পরে জিম্মিকারীদের দেওয়া চার বিকাশ নম্বরে দেড় লাখ টাকা পাঠানো হয়। চক্রটি টাকা রিসিভ করে আরো টাকা পাঠাতে তাগাদা দেয়। একপর্যায়ে পিবিআইয়ের তিনটি টিম একযোগে ঢাকার দোহার, নবাবগঞ্জ, কিশোরগঞ্জের ভৈরব এবং নরিসিংদীর রায়পুরা থানা এলাকায় অভিযান চালায়। এ সময় ওয়াসিম হোসেন ও আকারিছ মিয়াকে আটক করা হয়। তাদের কাছ থেকে ৯টি মোবাইল সেট, মুক্তিপণের দেড় লাখ টাকা ও বিকাশ সিমসহ মোট ২২টি সিম কার্ড জব্দ করা হয়। তবে মূলহোতা সোহেল তখনো পলাতক।

একপর্যায়ে গত ১৯ এপ্রিল সোহেল দেশ থেকে দুবাই পালিয়ে যাওয়ার জন্য হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে গেলে ইমিগ্রেশন পুলিশ তাকে আটক করে। পরে সেখান থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই।

পুলিশ সুপার মান্নান বলেন, সোহেল রিমান্ডে অনেক তথ্য দিয়েছে। তার মোবাইল দিয়ে লিবিয়ায় অবস্থানরত চক্রের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার পর রোমেলকে ছাড়তে রাজি হয়। যদিও তখন সামনে আসে নানা নাটকীয়তা ও জটিলতা। সোহেলের কথামতো রোমেলকে একদিন ঘুরিয়ে রাত ৩টায় ত্রিপলিতে রহমত উল্লাহর কাছে পৌঁছে দিয়ে ছেড়ে দেওয়ার দায়িত্ব দেয়। এরপর রোমেলকে ত্রিপলি থেকে দেশে আনার জন্য পাসপোর্ট, ভিসা ও বিমান টিকিটের জটিলতা দেখা দেয়। পিবিআই লিবিয়ার অ্যাম্বাসিতে একাধিকবার কথা বলে অনেক চেষ্টার পর গত ২৪ মে রোমেলকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়।

মান্নান বলেন, ভুক্তভোগী রোমেল লিবিয়াতে সে ছাড়াও আরও ১১ জন বাংলাদেশিকে জিম্মি অবস্থায় দেখেছেন বলে জানিয়েছেন। বিষয়টি যাচাই করা হচ্ছে। 

ভুক্তভোগী রোমেল বলেন, ‘বিল্লাল-রহমতউল্লা আমাকে ট্যুরিস্ট ভিসায় দুবাই-মিশর হয়ে লিবিয়া নিয়ে যায়। সেখানে দিনের পর দিন আটকে রেখে আমাকে নির্যাতন করা হয়। বাড়ির লোকজনকে ভিডিওতে রেখে ব্যাপক মারধর করে ১২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। সেখানে কয়েকজন লোক ছিল, একজন যে প্রধান তাকে সবাই বেয়াই বলে ডাকতো। এ ছাড়া, দেলোয়ার, আরিফ, রুহুল, তানভীর, সাইফুল, আবুল, হৃদয় খান, তানভীর নামে আরও কয়েকজন ছিল। তারা বলতো ১২ লাখ টাকা দিবি নয়তো মেরে ফেলব। তারা বারবার টাকা দেওয়ার জন্য তাড়া দিতো, সময় দিতে রাজি না। তারা বলতো তোর মতো অনেক রোমেল হারিয়ে গেছে, তোকেও মেরে ফেলব।’

রোমেলের বাবা আসাদ মিয়া বলেন, ‘যখন আমার ছেলে যায় তখন রমজান মাস ছিল। আমরা গরীব মানুষ, ভিটা-জমি বিক্রি করে ছেলেকে বিদেশ পাঠাইছিলাম, পরে যখন আবার টাকা চায় আমরা কই থেকে দেব? আর একদিনের ভেতরে ১২ লাখ টাকা কীভাবে দিমু! বললাম বাবারে ছেলেটারে আর মাইরো না, টাকা দিমু, একটু তো সময় দিবা। কিন্তু ওরা শোনেনি। মারে আর ফোন করে। গালিগালাজ করে।’

তিনি বলেন, ‘মনে শান্তি আইছে। ছেলে ফিরে আসছে এজন্য আমি খুশি। পিবিআই স্যারদের ভালো হোক।’

জেইউ/এমজে