বাংলাদেশ পুলিশের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি) তথ্যের ভিত্তিতে সম্প্রতি নেপালে আটক করা হয়েছে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যায় জড়িত ‘কিলার’ সিয়াম হোসেনকে। বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী সিয়াম কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জীভা গার্ডেনসের ফ্ল্যাটে আনারকে খুনের পর নেপালে গিয়ে আত্মগোপন করেন।

সিয়ামকে দেশে ফেরানোসহ আরও কিছু বিষয়ে তদন্ত করতে নেপাল গেছে পুলিশের চার সদস্যের একটি দল। যেখানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।

এদিকে আজ সোমবার (৩ জুন) বাংলাদেশের আদালতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে সিয়ামের বিরুদ্ধে। এখন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, সিয়ামকে এই মুহূর্তে দেশে ফেরানো যাবে কি না। তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, এখনই তাকে ফেরানো যাবে না।

গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্রে জানা গেছে, সিয়ামকে বাংলাদেশে ফেরাতে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দি বিনিময় চুক্তি না থাকা। এছাড়া আরও কিছু বাধা রয়েছে।

অন্যদিকে নেপালের সঙ্গে ভারতের বন্দি বিনিময় চুক্তি আছে। আনার হত্যার ঘটনায় ভারতেও যেহেতু মামলা হয়েছে সেহেতু তারাও সিয়ামকে ফেরাতে আবেদন করেছে। কলকাতা সিআইডির একটি টিমও এই মুহূর্তে নেপালে রয়েছে।

আজ সোমবার নেপাল থেকে গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, সিয়ামকে বাংলাদেশে ফেরাতে সব ধরনের চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে এখানে মোটামুটি তিনটি বাধা সামনে আসছে-- এক. দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দি বিনিময় চুক্তি না থাকায় সিয়ামকে ফেরাতে জটিলতা দেখা দিয়েছে। বন্দি বিনিময় চুক্তি না থাকলেও সিয়াম বাংলাদেশি হওয়ায় এবং বাংলাদেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করে নেপাল প্রবেশ করায় ইমিগ্রেশন আইনে তাকে দেশে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

দুই. কলকাতা সিআইডিও নেপাল থেকে সিয়ামকে ফেরত নিতে আবেদন করেছে।

তিন. ইমিগ্রেশন আইনে ফেরানোর চেষ্টার মধ্যেই আজ সিয়ামের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আদালত থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়ায় সেটি আর সম্ভব নাও হতে পারে।

তিনি বলেন, সিয়ামের ব্যাপারে কলকাতা পুলিশ বেশি প্রিভিলেজ পাচ্ছে। কারণ, কলকাতার সঞ্জীভা আবাসনের সেফটি ট্যাংক থেকে উদ্ধার হওয়া মরদেহের খণ্ডিত অংশ এমপি আনারের কি না তা নিশ্চিত হতে ফরেনসিক ও ডিএনএ টেস্ট করছে কলকাতা সিআইডি। মামলার ইনসিডেন্ট স্পট ও তদন্ত সেখানে হচ্ছে। সিয়ামকে কলকাতায় নেওয়া আবেদনে এসব উল্লেখ করেছে তারা। তাই কলকাতা সিআইডি এখানে প্রিভিলেজ পাচ্ছে। তবে আমরাও বসে নেই, চেষ্টা করছি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ভারতের সঙ্গে তাদের বন্দি বিনিময় চুক্তি থাকায় এবং সেখানে হওয়া মামলাকে গুরুত্ব দিয়ে নেপালের পক্ষ থেকে কলকাতা সিআইডির হাতেই সিয়ামকে তুলে দেওয়া হচ্ছে বলে মোটামুটি নিশ্চিত।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের ইন্টারপোলের শাখা কার্যালয় ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি) এআইজি আলী হায়দার চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, সংসদ সদস্য মো. আনোয়ারুল আজীম হত্যার আসামিদের গ্রেপ্তারের সহযোগিতার জন্য ইন্টারপোলের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য নেপালে গেছেন এনসিবি’র এক সদস্যসহ তদন্ত সংশ্লিষ্ট তিন কর্মকর্তা। নেপাল হতে সিয়ামকে আটক ও ফেরানোর ব্যাপারে আমরা এনসিবির মাধ্যমে সহযোগিতা চেয়েছি।

প্রসঙ্গত, গত ১২ মে চিকিৎসার জন্য চুয়াডাঙ্গার দর্শনার গেদে সীমান্ত দিয়ে ভারতে যান সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার। ওঠেন পশ্চিমবঙ্গে বরাহনগর থানার মণ্ডলপাড়া লেনে গোপাল বিশ্বাস নামে এক বন্ধুর বাড়িতে। পরের দিন ১৩ মে চিকিৎসক দেখাতে হবে জানিয়ে দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে গোপালের বাড়ি থেকে বের হন আনার। সন্ধ্যায় ফিরবেন বলে জানান।

সন্ধ্যায় আনার তার বন্ধু গোপালকে জানান, তিনি দিল্লি যাচ্ছেন এবং সেখানে পৌঁছে তাকে ফোন করবেন। পরে তার সঙ্গে ভিআইপিরা আছেন জানিয়ে বন্ধু গোপালকে ফোন না দেওয়ার জন্য সতর্ক করেন। গত ১৫ মে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো বার্তায় এমপি আনার বন্ধু গোপালকে জানান, তিনি দিল্লি পৌঁছেছেন এবং ভিআইপিদের সঙ্গেই আছেন। তাকে ফোন করার দরকার নেই। একই বার্তা পাঠান বাংলাদেশে তার ব্যক্তিগত সহকারী রউফ-এর কাছেও।

১৭ মে আনারের পরিবার তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে গোপালকে ফোন করেন। ওই সময় তারা গোপালকে জানান, তার (আনার) সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না তারা। পরিবারের পক্ষ থেকে ওই দিন ঢাকায় থানায় অভিযোগ করা হয়। এরপর থেকে এমপি আনারের খোঁজ পাওয়া যায়নি। ২০ মে এমপি আনারের খোঁজ করতে গিয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তার মোবাইল লোকেশন ট্র্যাক করে। তারা জানতে পারে, কলকাতায় বন্ধুর বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর তার মোবাইলের লোকেশন একবার পাওয়া গিয়েছিল সেখানকার নিউমার্কেট এলাকায়। এরপর ১৭ মে তার ফোন কিছুক্ষণের জন্য সচল ছিল বিহারে। পরে ২২ মে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জিভা গার্ডেন্সের একটি ফ্ল্যাটে এমপি আনারকে খুন করা হয়েছে।

এরপর তদন্তে উঠে আসে সংসদ সদস্য আনার খুনের পরিকল্পনা হচ্ছিল দীর্ঘদিন থেকে। তৃতীয় বারের চেষ্টায় সফল হয় হত্যাকারীরা। হত্যার পরিকল্পনা চূড়ান্ত হওয়ার পর মূল মাস্টারমাইন্ড আকতারুজ্জামান শাহীনের অন্যতম সহযোগী সিয়াম প্রথমে নেপালে যান। সেখান থেকে কলকাতায় প্রবেশ করেন। গত ১৩ মে সঞ্জিভা গার্ডেনসের ফ্ল্যাটে আনারকে খুন করার পর ফের নেপালে চলে যান সিয়াম।

জেইউ/জেডএস