বর্ষা মৌসুম মানেই রাজধানীতে জলাবদ্ধতা। কয়েক বছর ধরে এটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামান্য বৃষ্টিতে জলজটে নাকাল হতে হচ্ছে নগরবাসীকে। এবারও বর্ষায় রাজধানীতে জলাবদ্ধতার আশঙ্কা রয়েছে। ইতোমধ্যে বর্ষা আসার আগেই বৃষ্টির পানিতে থৈ থৈ অবস্থা রাজধানীর।

গত কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, সামান্য বৃষ্টিতেই রাজধানীর অলিগলি ও প্রধান প্রধান সড়ক পানির নিচে তলিয়ে যায়। বৃষ্টি একটু দীর্ঘ সময় স্থায়ী হলে রীতিমতো ‘ডুবে যায়’ ঢাকা শহর। হাঁটু ও কোমর পানিতে নাকাল হতে হয় নগরবাসীকে। অথচ জলাবদ্ধতা নিরসনে বহু প্রকল্প ও পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন। কিন্তু ফলাফল শূন্যই থেকে যাচ্ছে। কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না কিংবা প্রকৃত অর্থে যে ধরনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার তা নেওয়া হচ্ছে না।

বর্ষা এখনো শুরু হয়নি। তার আগেই সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে হওয়া বৃষ্টিতে রাজধানীজুড়ে তীব্র জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এ ছাড়া সামান্য বৃষ্টি হলেই নগরীর বিভিন্ন অলিগলিতে জমে যায় পানি। বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পরও জলাবদ্ধতা থাকে বহু সড়ক ও অলিগলিতে। কিছু এলাকায় বৃষ্টির পর চলাচলের কোনো উপায় থাকে না।

বিরক্ত নগরবাসী চান জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি

জলাবদ্ধতা বিষয়ে নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে রাজধানীর শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা হাবিবুর রহমান বলেন, প্রতিবছর রাজধানীর বিভিন্ন জায়গার পাশাপাশি এই শেওড়াপাড়ায় বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এমনও পরিস্থিতি হয় যে, বৃষ্টির পর এখানে নৌকাও চলাচল করে। ভ্যান, রিকশা জনপ্রতি ১০ টাকা ২০ টাকা নিয়ে বেশি জলাবদ্ধ অংশগুলো পার করে দেয়। এরপর হাঁটু পানি পেরিয়ে আমাদের বাসায় ফিরতে হয়। বর্ষা মৌসুমে অথবা যে কোন বৃষ্টির দিন আমরা বাসা থেকে বেরিয়ে হাঁটু পানি পেরিয়ে মূল রাস্তায় যাই। মূল রাস্তায়ও থাকে পানি। এর মধ্যেই বাসে উঠে আমাদের অফিসে যেতে হয়। এমনকি জলাবদ্ধ রাস্তায় যখন যানবাহন চলাচল করে সেখান থেকে সৃষ্টি হওয়া ঢেউ ফুটপাতেও আমাদের শরীরে এসে পড়ে। 

তিনি বলেন, প্রতিবছর সিটি কর্পোরেশন থেকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়— এবার আর জলাবদ্ধতা হবে না। কিন্তু বৃষ্টি হলেই রাজধানীজুড়ে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। প্রতিটা এলাকার বাসিন্দা জলাবদ্ধতা নিয়ে ত্যক্ত-বিরক্ত। মানুষের দুর্ভোগের সীমা থাকে না। এত কিছু চোখের সামনে হয়ে যায়, কিন্তু সিটি কর্পোরেশন শুধু তাদের প্রতিশ্রুতিতেই সীমাবদ্ধ থাকে। সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ মোকাবিলায় তারা কার্যকর কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করে না। সামনে বর্ষা মৌসুম, তখন যে জলাবদ্ধতা হবে তা ভাবলে এখনই আঁতকে উঠি।

রাজধানীর ধানমন্ডি ২৭ এলাকা দিয়ে নিয়মিত বাসা থেকে অফিসে যাতায়াত করেন বেসরকারি চাকরিজীবী জুবায়ের আল হাসান হীরা। তিনি বলেন, বৃষ্টি মানেই যেন রাজধানীর সড়ক-অলিগলি ডুবে যাওয়া। বৃষ্টি হলে অন্যান্য এলাকার মতো ধানমন্ডি ২৭-এ থৈ থৈ পানিতে জলপথের রূপ নেয়। কোথাও হাঁটু পানি কোথাও কোমর পানি জমা হয়ে যায়। এখনই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে ভরা বর্ষায় কী হবে আল্লাহ জানে!

তিনি বলেন, বছরের পর বছর ধরে এমন সমস্যা চলছে। অথচ তারা এটার স্থায়ী কোনো সমাধান করতে পারছে না।

জলাবদ্ধতায় নিজেদের ক্ষতির কথা উল্লেখ করে রাজধানীর সিএনজি চালক জয়নাল হক বলেন, বৃষ্টি হলে রাজধানীর বেশিরভাগ সড়ক ডুবে যায়। এতে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি আমরা সিএনজি চালকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হই। অনেক সড়কে হাঁটু পানি থাকে, ইঞ্জিনে পানি ঢুকে সিএনজি বন্ধ হয়ে যায়। তখন যাত্রী নামিয়ে দিয়ে ঠেলে ঠেলে গাড়ি নিয়ে যেতে হয়।

জলাবদ্ধতার কারণ কী, বৃষ্টির পানি কেন সরে যেতে পারে না?

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকার পানি তিনটি মাধ্যমে আশপাশের নদ-নদীতে গিয়ে পড়ে। পাম্প স্টেশন, স্লুইসগেট ও খাল। বর্তমানে বেশ কয়েকটি পাম্প স্টেশন নষ্ট হয়ে আছে। একইভাবে স্লুইসগেটগুলোও অকেজো অবস্থায় আছে। আর খালগুলোর অবস্থা ভালো নয়, সেগুলো পানি প্রবাহের উপযুক্ত নয়। অবৈধ দখলের পাশাপাশি নানা বর্জ্য জমে খালগুলোতে কয়েক স্তরের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়ে আছে।

ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকায় প্রতিদিন প্রায় ৭ হাজার টন বর্জ্য উৎপাদন হয়। এর মধ্যে প্রায় ১৫ শতাংশই প্লাস্টিক বর্জ্য, যা ঢাকার ড্রেন, নালা আর খালে গিয়ে পড়ছে। এসব প্লাস্টিক বর্জ্য খালে বা ড্রেনে আটকে থাকছে, যে কারণে পানি নামতে পারছে না।

ঢাকা উত্তর সিটির খাল এবং প্রতিবন্ধকতা

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের এলাকার খালগুলোর মধ্যে রয়েছে— কল্যাণপুর ঙ খাল, কল্যাণপুর চ খাল, রূপনগর প্রধান খাল, রূপনগর শাখা খাল-আরামবাগ, রূপনগর শাখা খাল-দুয়ারীপাড়া, রূপনগর শাখা খাল-চিড়িয়াখানা, মিরপুর দিয়াবাড়ী খাল, ইব্রাহিমপুর খাল, বাউনিয়া খাল, শাহজাদপুর খাল, সূতিভোলা খাল, ডুমিনি খাল, বোয়ালিয়া খাল, গোবিন্দপুর খাল, নরাই খাল, আব্দুল্লাহপুর খাল, দ্বিগুণ খাল, ধউর খাল, বাইশটেকি খাল, সাংবাদিক কলোনি খাল, কসাইবাড়ী খাল, মহাখালী খাল, উত্তর দিয়াবাড়ী খাল, বেগুনবাড়ী খাল, কাটাসুর খাল, রামচন্দ্রপুর খাল, কল্যাণপুর প্রধান খাল, কল্যাণপুর ক খাল, কল্যাণপুর খ খাল এবং কল্যাণপুর ঘ খাল।

খালের দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার পর খালের সীমানা নির্ধারণের কাজ করতে চেয়েছিল ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি)। কিন্তু পুরো কাজ এখনো শেষ হয়নি। কোথাও সিএস, কোথাও আরএস এবং কোথাও মহানগর জরিপ ধরে খালের সীমানা নির্ধারণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি খালের আধুনিকায়নে একটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও তার কোনও অগ্রগতি নেই।

এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ঢাকা একসময় খালের জন্য বিখ্যাত ছিল। কিন্তু অবৈধ দখল ও দূষণের কবলে পড়ে খালগুলো মরতে বসেছিল। খালগুলো বুঝে পাওয়ার পর থেকে আমরা কাজ করছি। এ বছরও কিছু খাল দখলমুক্ত করে পানি প্রবাহ নিশ্চিত করা হয়। আমাদের উদ্ধারকৃত খালগুলোর মধ্যে রয়েছে লাউতলা খাল; যেখানে ১০তলা বিল্ডিং অপসারণ করা হয়। এ ছাড়া রামচন্দ্রপুর খাল, গুলশান লেক, প্যারিস বা বাইশটেকি খাল, সুতিভোলা খাল এবং রাজউক খাল থেকে দুই লাখ ৫৮ হাজার টন বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে। পাশাপাশি ওয়াটার লগিং হটস্পট চিহ্নিতকরণ করা হয়েছে। নিয়মিত ড্রেন পরিষ্কারকরণ, ড্রেনে পানির লেভেল পরীক্ষাকরণ, অতিবৃষ্টির সময় কল্যাণপুর থেকে শক্তিশালী পাম্পের সাহায্যে দ্রুত পানি সরিয়ে নদীতে স্থানান্তর করা হচ্ছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটির খাল এবং প্রতিবন্ধকতা

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের খালগুলোর মধ্যে রয়েছে— মান্ডা খাল, হাজারীবাগ খাল, শ্যামপুর খাল, জিয়া সরণি খাল, সুতিভোলা খাল, কদমতলা খাল, বাসাবো খাল, তিতাস খাল, শাহজাহানপুর খাল, নন্দীপাড়া খাল, বেগুনবাড়ি খাল, কাটাসুর খাল, খিলগাঁও-বাসাবো খাল, জিরানী খাল, কুতুবখালী খাল, খিলগাঁও খাল, দোলাইরপাড় খাল, কাজলা খাল, ফকিরখালী খাল, সুকুরসি খাল, ডগাইর খাল, বাইগদা খাল, মৃধাবাড়ী খাল, মাতুয়াইল কবরস্থান খাল এবং সেগুনবাগিচা খাল। তবে এর বাইরে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা (ডিএনডি) এলাকায় ডিএসসিসির আওতাভুক্ত অংশে ১৫টি খাল রয়েছে। যেগুলো পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে, এগুলো সিটি কর্পোরেশনকে হস্তান্তরের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রের একটি বড় অংশের বৃষ্টির পানি মান্ডা, জিরানী, শ্যামপুর ও কালুনগর খাল হয়ে নিষ্কাশন হয়ে থাকে। এ চারটি খালের দৈর্ঘ্য ২০ কিলোমিটার। কাগজে-কলমে খালগুলো থাকলেও বাস্তবে দখল ও ভরাটে অচল হয়ে রয়েছে। মূলত এই কারণে ঢাকা দক্ষিণ এলাকায় জলাবদ্ধতা হয়। এ বছরও আসন্ন বর্ষায় দক্ষিণের বেশ কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতা আশঙ্কা রয়েছে।

তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তাদের আওতাভুক্ত এলাকার খালগুলোর মধ্যে শ্যামপুর, জিরানি, মান্ডা ও কালুনগর খাল অন্যতম। এসব খাল পুনরুদ্ধার ও নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে এবং ২০২২ সালে একনেক এই চার খালের প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে। ৮৯৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ব্যয়ে 'খাল পুনরুদ্ধার ও নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টি' নামক এই প্রকল্প ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস বলেন, জলজট ও জলাবদ্ধতা এই শহরের পুঞ্জীভূত সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম। সামান্য বৃষ্টিতে তলিয়ে যেত এই শহরের প্রায় ৭০ শতাংশ এলাকা। এই সমস্যা নিরসনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন খাল, বক্স কালভার্ট ও নর্দমা থেকে বাৎসরিক সূচি অনুযায়ী বর্জ্য ও পলি অপসারণ করে চলেছে। এ ছাড়া জলাবদ্ধতাপ্রবণ মোট ১৬১টি স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে এবং ২৫২ কোটি টাকা ব্যয়ে নিজস্ব অর্থায়নে ১০৯টি স্থানে জলাবদ্ধতা নিরসনে অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ২৬টি স্থানে অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন কাজ চলমান রয়েছে এবং বাকি ২৬টি স্থানে অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে শ্যামপুর বাণিজ্যিক এলাকা, মিটফোর্ড রোড, নটরডেম কলেজের সামনের সড়ক, বঙ্গভবনের দক্ষিণ ও পশ্চিম অংশের রাস্তা, বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনের সড়ক, সচিবালয়, লালবাগ রোড, আজিমপুর মোড়সহ অনেক এলাকায় জলাবদ্ধতা ও জলজট সমস্যার সমাধান হয়েছে। ফলে, জলাবদ্ধতা সমস্যা ৭০ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নেমে এসেছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন থেকে জানানো হয়, প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে চারটি খাল থেকে বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এ ছাড়া ভূমি উন্নয়ন, বাই সাইকেল লেন ও অ্যাপ্রোচ রোড নির্মাণ, দৃষ্টিনন্দন এলইডি বাতি স্থাপন, ওয়াকওয়ে নির্মাণ, বসার বেঞ্চ স্থাপন, এম্পিথিয়েটার ও নর্দমা অবকাঠামো নির্মাণ, ব্যায়ামের শেড স্থাপন, আরসিসি রিটেইনিং ওয়াল ও ঢাল সুরক্ষা নির্মাণ, দৃষ্টিনন্দন সুরক্ষা বেষ্টনী ও গণশৌচাগার নির্মাণ ইত্যাদি অনুষঙ্গ রয়েছে। খালের দুই পাড় ঘেঁষে বৃক্ষরোপণ ও ল্যান্ডস্কেপিং করার মাধ্যমে নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টি করা হবে।

১৩ বছরে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয় হলেও ফলাফল শূন্য

একসময় রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব ছিল ঢাকা ওয়াসার। পরে সব নালা ও খাল দুই সিটি কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দিতে ঢাকা ওয়াসা, সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন সংস্থা গত ১৩ বছরে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয় করলেও এটি যেন নগরবাসীর পিছু ছাড়ছে না।

প্রধান প্রধান ড্রেন লাইন নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও ছিল ঢাকা ওয়াসার। শাখা লাইনগুলোর দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের ওপর ন্যস্ত ছিল। ওই সময় রাজধানীর মোট ড্রেনেজ লাইনের মধ্যে ৩৮৫ কিলোমিটার ঢাকা ওয়াসার অধীন এবং প্রায় দুই হাজার ৫০০ কিলোমিটার ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের অধীনে ছিল। এর বাইরে ৭৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ২৬টি খাল ও ১০ কিলোমিটার বক্স কালভার্টের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও ছিল ঢাকা ওয়াসার। যে কারণে বর্ষায় সৃষ্ট জলাবদ্ধতা নিরসনে সংস্থাগুলো একে অন্যের ওপর দায় চাপানোর সুযোগ পেত। কিন্তু ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে ওয়াসার দায়িত্বে থাকা সব নালা ও খাল দুই সিটি কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

দায়িত্ব ছাড়ার আগে ঢাকা ওয়াসা রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ২০৩ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়। যার মেয়াদ শেষ হয় ২০১১ সালে। কিন্তু এ প্রকল্পের মাধ্যমে নগরবাসী কোনো সুফল পাননি। দ্বিতীয় ধাপে আরও ২৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে আরেকটি প্রকল্প নেওয়া হয়। সবমিলিয়ে ১০ বছরে জলাবদ্ধতা নিরসনে ঢাকা ওয়াসা ব্যয় করেছে প্রায় দুই হাজার ২৫ কোটি টাকা। এরপর ২০২১ সাল থেকে খাল রক্ষণাবেক্ষণের একক দায়িত্ব পায় ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন।
এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও তারা কথা বলতে রাজি হননি। তাদের ভাষায়, যেহেতু ঢাকার খাল, ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব এখন সিটি কর্পোরেশনের। সে কারণে তারা আর এই বিষয়ে কথা বলতে চান না। আর বিষয়টি অনেক আগের হওয়ায় অনেকের জানা নেই।

এদিকে ড্রেনেজ খাতের উন্নয়নে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫৭৩ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। পরের আড়াই বছরে অর্থাৎ গত অর্থবছর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে আরও ৪০০ কোটি টাকা। এভাবে নানা সময় ঢাকা ওয়াসা, সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন সংস্থা জলাবদ্ধতা নিরসনে হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে। কিন্তু নগরবাসী কোনো সুফল পাননি।

আসন্ন বর্ষায় জলাবদ্ধতা নিরসনে পদক্ষেপ কী— জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, জলাবদ্ধতা নিয়ে এখন কিছু বলতে পারছি, যা জানার দরকার আপনি জনসংযোগ বিভাগ থেকে খোঁজ নেন।

তবে নাম না প্রকাশের শর্তে এই কর্মকর্তা বলেন, খালের সীমানা নির্ধারণসহ উন্নয়নের কাজ চলমান রয়েছে। সিএস রেকর্ড অনুযায়ী খালের সীমানা নির্ধারণ করা হচ্ছে। আসন্ন বর্ষায় যেন জলাবদ্ধতা না হয়, সে কারণে খালগুলো পরিষ্কার রাখা হচ্ছে। পানিগুলো যেন দ্রুত নেমে যেতে পারে। তবে খালগুলো পুনরুদ্ধার হয়ে পানি প্রবাহ ঠিক হতে অনেক সময়ের প্রয়োজন।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং প্রকৌশল বিভাগের বরাত দিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মুখপাত্র মকবুল হোসাইন বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে খালগুলো থেকে ইতোমধ্যে দুই লাখ ৫৮ হাজার টন বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে। পাশাপাশি জলাবদ্ধতার হটস্পট চিহ্নিতকরণ করা হয়েছে। নিয়মিত ড্রেন পরিষ্কার করার পাশাপাশি কুইক রেসপন্স টিম কাজ করে যাচ্ছে। জলাবদ্ধতা হলে এই টিম সার্বক্ষণিক প্রস্তুত থাকে।

তিনি আরও বলেন, ডিএনসিসির আওতায় আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে ড্রেন লাইনসহ ৭১ কিলোমিটার রাস্তায় কাজ শেষ হবে। পাশাপাশি ৮১ কিলোমিটার ড্রেন লাইনের কাজ শেষ হবে। অন্যদিকে খাল খনন সম্পন্ন হবে সাড়ে তিন কিলোমিটার। কাজগুলো শেষ হলে আশা করা যায় রাজধানীর জলাবদ্ধতা অনেকাংশেই কমে আসবে।

বর্তমানে কত টাকা খরচ করছে ঢাকার দুই সিটি?

জলাবদ্ধতা নিরসনে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন লেক মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে বরাদ্দ রেখেছে পাঁচ কোটি টাকা। ড্রেন ক্লিনিং খাতে রাখা হয়েছে পাঁচ কোটি টাকা, খাল পরিষ্কারেও সংস্থাটি ব্যয় করছে পাঁচ কোটি টাকা। এছাড়া পাম্প হাউসের যন্ত্রপাতি আধুনিকীকরণ, উন্নয়ন ও ক্রয়বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৫ কোটি টাকা।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে জলাবদ্ধতা দূরীকরণের জন্য বাজেটে বরাদ্দ রেখেছে ৯০ কোটি টাকা। এ ছাড়া ‘খাল পুনরুদ্ধার, সংস্কার ও নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টি’ নামের প্রকল্পে ব্যয় ধরেছে ২০৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা।

এ প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নগর ও পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, খাল ও নর্দমাগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টি হলেই রাজধানীতে জলাবদ্ধতা হচ্ছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। নিয়ম মেনে সঠিক কার্যক্রম হিসেবে এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। সিটি কর্পোরেশন তো পানি নিষ্কাশনের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছে, তাই কঠিন, দীর্ঘমেয়াদি কাজ হলেও সঠিকভাবে তাদেরকেই কাজ করতে হবে। এখন আর অন্যদের ওপর দোষ চাপানোর কোন সুযোগ নেই।

এএসএস/এমজে