বাংলাদেশের ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যার ঘটনার মূলহোতা আকতারুজ্জামান শাহীনকে পেতে তোড়জোড় শুরু করেছে ভারতের সিআইডি।

যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে অপরাধী প্রত্যর্পণ চুক্তি কাজে লাগিয়ে শাহীনকে আনার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। ভারতীয় পুলিশ প্রশাসনের একটি সূত্রে এ তথ্য জানিয়েছে আনন্দবাজার।

আনার ও শাহীন পুরোনো বন্ধু। ব্যবসায়িক লেনদেন থেকে তাদের মধ্যে সংঘাত তৈরি হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। এখন শাহীনকে হাতে পেলে দীর্ঘ পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির ভিত্তিতে হত্যার সম্ভাব্য কারণ পরিষ্কার হবে বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা।

পাশাপাশি এই হত্যা মামলার আরেক অভিযুক্ত বাংলাদেশি নাগরিক সিয়ামকে ধরতে ভারত-নেপাল সীমান্তের নানা এলাকায় ভারতীয় সিআইডির বিশেষ দল খোঁজখবর নিচ্ছে।

তদন্তকারী দলটি নেপালের বিভিন্ন মহলে যোগাযোগ রাখছে বলে সূত্র জানিয়েছে। তবে তারা কিছুটা চিন্তিত, কারণ এর আগে বারবার নানা মামলায় অভিযুক্তরা নেপাল সীমান্ত পার হয়ে কাঁকরভিটা হয়ে কাঠমান্ডু পৌঁছেছে বা বিহারের রক্সৌল থেকে নেপালের বীরগঞ্জের দিকে ঢুকেছে। এমনকি আনার হত্যার মূল অভিযুক্ত শাহিনও বাংলাদেশ থেকে নেপাল হয়েই যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। আবার তদন্তকারীদের একটি অংশের দাবি, বাংলাদেশ পুলিশও সিয়ামকে নিজেদের হেফাজতে নিতে চাইছে। দুই পক্ষই চেষ্টা করায় ওই প্রক্রিয়া কিছুটা ধাক্কা খাচ্ছে।

কলকাতা ছাড়ার আগে বৃহস্পতিবার (৩০ মে) ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান হারুন অর রশীদ বলেন, ‘বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে নেপালে চিঠি পাঠিয়ে সিয়ামের অবস্থান নিয়ে তাদের জানিয়েছেন।’ শিগগিরই তার বিষয়ে নেপাল থেকে ভালো খবর আসবে বলে আশা করছেন তিনি।

ভারতের সিআইডি সূত্রে খবর, শাহীনের অন্যতম প্রধান সহযোগী সিয়াম কসাই জিহাদকে নিয়ে কয়েক মাস ধরে চিনার পার্কে শাহীনের ফ্ল্যাটেই ছিল। খুনের পরিকল্পনা কার্যকর করার বিভিন্ন ধাপে সিয়ামের কার্যকর ভূমিকা ছিল বলে তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন। এমপি আনার হত্যার অভিযুক্তদের মধ্যে পলাতক শাহীন, সিয়াম, মুস্তাফিজুর, ফয়জুলের নামে ইতোমধ্যে ‘লুকআউট নোটিশ’ জারি করা হয়েছে। তারা বিদেশে পালিয়েছে– এমন শঙ্কা থেকে ইন্টারপোলের ‘রেড নোটিশ’ জারিরও প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

এমপি আনার হত্যার তদন্তে ভারতীয় সিআইডির পক্ষ থেকে একটি বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন করা হয়েছে। ওই দলের নেতৃত্বে রয়েছেন একজন আইজি। মোট ১২ জনের তদন্তকারী দলে সিআইডির দুজন ডিআইজি এবং একজন পুলিশ সুপারও রয়েছেন।

তাদের অভিযানে নিউ টাউনের বিভিন্ন এলাকার সিসিটিভির ফুটেজ জব্দ করা হয়েছে। পাশাপাশি অভিযুক্তরা যে গাড়ি ব্যবহার করেছিল, সেটির চালকদের জবানও নথিভুক্ত করা হয়েছে। তবে নিউ টাউনের আবাসনের সেপটিক ট্যাঙ্ক থেকে দেহাংশ উদ্ধার হলেও দেহের হাড় বা মাথা উদ্ধার হয়নি। খোঁজ মেলেনি পোশাক, জুতারও। এসবের খোঁজে ভাঙড়ে বাগজোলা খালে তল্লাশি চলমান রয়েছে।

ভারতীয় সিআইডির আশা, আগামী সপ্তাহের শেষ দিকে দেহাংশ নিয়ে প্রাথমিক ফরেন্সিক রিপোর্ট চলে আসবে। এরপরই ডিএনএ নমুনা মেলানোর প্রক্রিয়া শুরু হবে।

গত ১২ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে যান এমপি আনোয়ারুল আজীম আনার। সেদিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে কলকাতায় তার পারিবারিক বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা করতে যান। পরের দিন ১৩ মে চিকিৎসক দেখাতে হবে জানিয়ে দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে গোপালের বাড়ি থেকে বের হন আনার। সন্ধ্যায় ফিরবেন বলেও জানান তিনি। পরে বিধান পার্কের কাছে কলকাতা পাবলিক স্কুলের সামনে থেকে ট্যাক্সিতে উঠেছিলেন।

চলে যাওয়ার পর সন্ধ্যায় আনার তার বন্ধু গোপালকে জানান, তিনি দিল্লি যাচ্ছেন এবং সেখানে পৌঁছে তাকে ফোন করবেন। পরে তার সঙ্গে ভিআইপিরা আছেন জানিয়ে বন্ধু গোপালকে ফোন না দেওয়ার জন্য সতর্ক করেছিলেন।

গত ১৫ মে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো বার্তায় এমপি আনার বন্ধু গোপালকে জানান, তিনি দিল্লি পৌঁছেছেন এবং ভিআইপিদের সঙ্গে আছেন। তাকে ফোন করার দরকার নেই। একই বার্তা পাঠান বাংলাদেশে তার ব্যক্তিগত সহকারী রউফের কাছেও।

১৭ মে আনারের পরিবার তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে গোপালকে ফোন করেন। ওই সময় তারা গোপালকে জানান, তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না তারা। পরিবারের পক্ষ থেকে ওইদিনই ঢাকায় থানায় অভিযোগ করা হয়। এরপর থেকে এমপি আনারের খোঁজ পাওয়া যায়নি।

২০ মে এমপি আনারের খোঁজ করতে গিয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তার মোবাইল লোকেশন ট্র্যাক করে। তারা জানতে পারে, কলকাতায় বন্ধুর বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর তার মোবাইলের লোকেশন একবার পাওয়া গিয়েছিল সেখানকার নিউমার্কেট এলাকায়। এরপর ১৭ মে তার ফোন কিছুক্ষণের জন্য সচল ছিল বিহারে।

পরে ২২ মে ভারতের এনডিটিভির খবরে বলা হয়, কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জিবা গার্ডেন্সের একটি ফ্লাটে এমপি আনারকে খুন করা হয়েছে। খুনের পর মরদেহ টুকরো টুকরো ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও জানানো হয়। এনডিটিভি বলে, ১২ মে কলকাতায় আসার পর নিখোঁজ হওয়া এমপি আনারের খোঁজে তল্লাশি শুরুর পর ২২ মে সকালে তার খুনের ব্যাপারে নিশ্চিত হয় পুলিশ।

এদিকে, সেদিনই ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় খুন করার উদ্দেশ্যে অপহরণের অভিযোগে মামলা দায়ের করেন এমপি আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন। এমপি আনার সংসদ ভবন এলাকায় থাকতেন। সেখান থেকে তিনি ভারতে গেছেন। তাই ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) প্রধান হারুন-অর-রশিদের পরামর্শে শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা দায়ের করেন তার মেয়ে।

এসএসএইচ