কলকাতার সঞ্জীবা আবাসনের বিইউ ৫৬ ফ্ল্যাটের সেপটিক ট্যাংক থেকে উদ্ধার করা হয়েছে একটি মরদেহের খণ্ডিত অংশ। তবে সেটি যে বাংলাদেশের ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের তা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করেনি কলকাতায় যাওয়া ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) দল।

মরদেহের খণ্ডিত অংশ উদ্ধারের ব্যাপারে মঙ্গলবার রাতে ডিএমপির গোয়েন্দা পুলিশ প্রধান হারুন অর রশীদ বলেন, কলকাতা পুলিশের কাছে গ্রেপ্তার হওয়া জিহাদ হাওলাদার বলেছিলেন, প্রায় ৪ কেজি ওজনের দেহাংশ ফেলে দিয়েছিলেন। সেই তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আজ সকালে সিআইডিকে অনুরোধ করেছিলাম ওই বাড়িতে তল্লাশি করার জন্য। সন্ধ্যায় তারা সেপটিক ট্যাংকে তল্লাশি করে একটি মরদেহের খণ্ডিতাংশ পেয়েছেন বলে আমরা জেনেছি। তবে এটি এমপি আনারের কি না তা আমরা বা তারা কেউ নিশ্চিত নই। এ বিষয়ে তারা আমাদের আনুষ্ঠানিক কিছু জানায়নি।

তিনি বলেন, গণমাধ্যমে মরদেহের খণ্ডিত অংশ উদ্ধারের খবর দেখে এমপি আনারের মেয়ে ডরিন আমাকে ফোন দিয়েছিলেন। আমি তাকে দ্রুত এখানে আসতে বলেছি। তিনি আসলে পরীক্ষাটা দ্রুত করানো যাবে।

হারুন বলেন, আমরা কাল সকালে কলকাতা সিআইডি কার্যালয়ে যাব। মরদেহের খণ্ডিতাংশ উদ্ধারের বিষয়টি অফিসিয়ালি নিশ্চিত হতে হবে। সেটা যে সংসদ সদস্য আনারের তা ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়া বলা সম্ভব নয়। আমরা আগে নিশ্চিত হই। তারপর রক্তের সম্পর্কের কাউকে কলকাতায় ডাকা হবে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য।

পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনস আবাসনের যে ফ্ল্যাটে এমপি আনার খুন হয়েছেন, সেই ভবনের সেপটিক ট্যাংক থেকেই দেহাংশ মিলেছে বলে জানিয়েছেন এক প্রত্যক্ষদর্শী। তবে কলকাতা পুলিশ বা সিআইডির কোনো কর্মকর্তারা কেউ এখনো এ বিষয়ে মুখ খোলেননি।

মঙ্গলবার (২৮ মে) বিকেলে সঞ্জীবা গার্ডেনসের কর্মী পরিচয় দেওয়া সিদ্ধেশ্বর মণ্ডল একদলা মাংস উদ্ধারের তথ্য গণমাধ্যমকে জানান।

তিনি বলেন, ‘ট্যাংক থেকে মাংস উদ্ধার হচ্ছে। গন্ধের কারণে শরীর খারাপ লাগে। অসম্ভব বমি পায়। আর থাকতে পারিনি। তাই চলে এসেছি। ফোনে ছবি ওঠাতে চেয়েছিলাম। তুলতে দেয়নি। ’

সিদ্ধেশ্বর মণ্ডল বলেন, ‘আমার ভগ্নীপতি ভূষণ শিকারী ট্যাংক পরিষ্কার করার দায়িত্বে ছিল। উদ্ধার হওয়া মাংস ওজনে তিন-চার কেজির মতো হবে।'

অনুমান করে সিদ্ধেশ্বর মণ্ডল গণমাধ্যমকে বলেন, ‘হয়ত তাকে খুনের পর কুচি কুচি করে মাংস কমোডে ফ্ল্যাশ করে থাকতে পারে, সেটা পাইপ হয়ে সেপটিক ট্যাংকে গিয়ে দলা হয়েছিল। ’

এর কিছুক্ষণ পর ঘটনাস্থলে পলিথিনে দলা দলা মাংস জড়ো করতে দেখা যায় দায়িত্বপ্রাপ্তদের। এরপর সেখান থেকে পুলিশের দুটি গাড়ি বের হতে দেখা যায়। সে সময় পুলিশের কর্মকর্তারা বলেন, এখনই কিছু বলব না। তবে এটা মানুষের মাংস একপ্রকার নিশ্চিত। ফরেনসিক পরীক্ষার পরই সব বলা যাবে।

কলকাতা সিআইডি পুলিশ সূত্র বলছে, সরকারিভাবে আগে ফরেনসিক করা হবে। সেটা মানুষের মাংস কি না সেটা আগে নিশ্চিত হতে হবে। এরপর খুন হওয়া সংসদ সদস্য আনারের সম্ভাব্য মরদেহ কি না তা পরীক্ষার জন্য ডিএনএ পরীক্ষা করতে হবে। ডিএনএ পরীক্ষায় নিশ্চিত হবে আনারের মরদেহের খণ্ডিতাংশ কি না। ডিএনএ পরীক্ষার জন্য সংসদ সদস্য আনারের ব্লাড রিলেটিভকে ডাকা হবে।

এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে খুন হওয়া আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিনের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল দেওয়া হলে তিনি সাড়া দেননি। তাই তার মন্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

গত শুক্রবার (২৪ মে) দুপুরে আনারের মেয়ে ডরিন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, দিল্লি হাই কমিশনসহ সবার সঙ্গে আমার কথা হচ্ছে। ওখানকার অনেক বড় বড় কর্মকর্তা আমাকে ফোন দিয়েছেন। তারা নিজেরাই এ বিষয়টা দেখছেন। তারা চেষ্টা করছেন, কিছু না কিছু বের করবেন। প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকারের সহযোগিতায় আমি ভিসা করতে দিয়েছে। আমার ভিসাও হয়ে গেছে। আমাকে যখন প্রয়োজন হবে তখনই চলে যাব। এখন পর্যন্ত আপডেট কিছু পাইনি।

এর আগে রোববার সকালে অপহরণ মামলার তদন্ত ও মরদেহ উদ্ধারে ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত দল কলকাতায় যান। প্রতিনিধি দলে আরও রয়েছেন ওয়ারী বিভাগের ডিসি মো. আব্দুল আহাদ ও এডিসি শাহীদুর রহমান।

গতকাল সোমবার দিনভর প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যেই কলকাতায় দুই দেশের তদন্ত কর্মকর্তারা নানা জায়গায় তদন্ত করে বেড়ান। সকাল ১০টায় নিউ টাউনের সঞ্জীবা গার্ডেন্সে যান বাংলাদেশের গোয়েন্দা টিম। এ সময় কলকাতা সিআইডির কর্মকর্তাও ছিলেন। দুপুর সাড়ে ১২টা দিকে সেখানে নেওয়া হয় জিহাদকে। বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সামনে ঘটনার বর্ণনা দেন তিনি। এরপর তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা পোলেরহাট থানার কৃষ্ণমাটি বাগজোলা খালের কাছে যান।

হত্যায় জড়িতদের তথ্য মতে, লাশের টুকরো ফেলা হয়েছে সেখানে। জিহাদের সঙ্গে ক্যাব চালক জুবেরের বর্ণনা মিলিয়ে দেখতে তদন্তকারীরা যান নিউ টাউন শহরের একাধিক জায়গায়।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য মো. আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার পর মরদেহ টুকরো করার বর্ণনা দিয়েছেন জড়িতরা। কলকাতায় গ্রেপ্তার জিহাদ হাওলাদার ওরফে ‘কসাই জিহাদ’ জানান, নিউ টাউনের সঞ্জীবা গার্ডেন্সের বাথরুমে টুকরো করা হয় এমপি আজীমের লাশ। এর আগে প্রায় এক ঘণ্টা মরদেহটি মেঝেতে পড়ে ছিল। পরে চারজন মিলে টেনে সেটি বাথরুমে নিয়ে যান।

জিজ্ঞাসাবাদে সংসদ সদস্য আনার হত্যায় অন্যতম অভিযুক্ত জিহাদ হাওলাদার জানান, হত্যার পর মাথা কেটে শরীর থেকে আলাদা করার দায়িত্ব ছিল তার ওপর। এরপর তা টুকরো টুকরো করা হয়। শরীর থেকে চামড়া ছাড়িয়ে আলাদা করা হয় মাংস ও হাড়। লাশ টুকরো করার কাজ জিহাদ করলেও তা গায়েব করার দায়িত্ব ছিল ফয়সালের ওপর। অনলাইনে ভিডিও কলে গ্রেপ্তার চারজন মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য জানিয়েছেন।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার ঘটনায় মূল মাস্টারমাইন্ড বাংলাদেশি আমেরিকান আখতারুজ্জামান শাহীনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তার নির্দেশে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন বেশ কয়েকজন। তাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত চারজন গ্রেপ্তার হলেও এখনো পলাতক বাকি চারজন। হত্যাকাণ্ডের পর পালিয়ে যাওয়া মূল পরিকল্পনাকারী আখতারুজ্জামান শাহীন যুক্তরাষ্ট্র ও সহযোগী সিয়াম নেপালে পালিয়ে গেছেন।

জেইউ/এসকেডি