কলকাতার সঞ্জীবা গার্ডেনে বাংলাদেশের ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার ঘটনায় মূল মাস্টারমাইন্ড বাংলাদেশি আমেরিকান আখতারুজ্জামান শাহীনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তার নির্দেশে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় বেশ কয়েকজন। তাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত চারজন গ্রেপ্তার হলেও পলাতক রয়েছে চারজন।

হত্যাকাণ্ডের পর পালিয়ে যাওয়া মূল পরিকল্পনাকারী আখতারুজ্জামান শাহীন আমেরিকায় ও সহযোগী সিয়াম নেপালে পালিয়ে গেছেন। তদন্তের স্বার্থে ডিবি পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের সহায়তায় সংশ্লিষ্ট দেশ দুটির এনসিবির কাছে সহায়তা চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশের ন্যাশনাল সেন্টার ব্যুরো (এনসিবি)।

সোমবার (২৭ মে) রাতে এ ব্যাপারে পুলিশ সদর দপ্তরের ইন্টারপোলের শাখা কার্যালয় ন্যাশনাল সেন্টার ব্যুরোর (এনসিবি) এআইজি আলী হায়দার চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে সংসদ সদস্য আনার হত্যাকাণ্ডে জড়িত দুজনকে ফিরিয়ে আনতে আবেদন করা হয়েছে। সে পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ইন্টারপোলের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দুটি দেশকে চিঠি পাঠিয়েছি। দুজনকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য সার্বিক সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের ন্যাশনাল সেন্টার ব্যুরোর (এনসিবি) সূত্রে জানা গেছে, সংসদ সদস্য আনার হত্যার ঘটনায় মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে দুই দেশের পুলিশ যাকে শনাক্ত করেছে, সেই আক্তারুজ্জামান শাহীন নেপাল ও দুবাই হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দিয়েছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। সোমবার তাকে ফেরত পাঠানোর জন্য আমেরিকার এনসিবিকে মেইল করা হয়েছে। পাশাপাশি ইন্টারপোলের সহায়তায় সংশ্লিষ্ট দেশটির পুলিশকে অবহিত করা হয়েছে। একই প্রক্রিয়ায় নেপালে পালানো আনার হত্যায় অন্যতম সহযোগী সিয়ামকে ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট দেশকে দু’দিন আগে ইন্টারপোলের সহায়তায় চিঠি পাঠানো হয়েছে।

সূত্রটি বলছে, বাংলাদেশের সঙ্গে আমেরিকার বন্দি বিনিময় চুক্তি নেই। সংগত কারণে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সেন্টার ব্যুরোকে (এনসিবি) আলাদা চিঠি দেওয়া হয়েছে। যেহেতু আনার হত্যায় কলকাতাতেও মামলা হয়েছে। ভারতের সঙ্গে আমেরিকা ও নেপালের বন্দি বিনিময় চুক্তি আছে। তাই তাদের সহযোগিতা চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

কলকাতা পুলিশ ও ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সংসদ সদস্য আনার হত্যাকাণ্ডে যে কয়েকজনের নাম এসেছে তাদের মধ্যে গ্রেপ্তার চারজন ছাড়াও এখনো পলাতক চারজন। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে তিনজন এবং ভারতের কলকাতায় একজন গ্রেপ্তার হয়েছেন।

ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হাতে গ্রেপ্তাররা হলেন– আমানুল্লাহ আমান ওরফে শিমুল ভুইয়া, তানভীর ভুইয়া ও শিলাস্তি রহমান। অন্যদিকে কলকাতা পুলিশ জিহাদ হাওলাদার নামে একজন কসাইকে গ্রেপ্তার করেছে। হত্যার দুই মাস আগে মুম্বাইয়ে অবৈধ অভিবাসী জিহাদকে পাঠানো হয়েছিল। তার বাড়ি বাংলাদেশের খুলনায়।

সংসদ সদস্য আনার খুনের বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িত আরও অন্তত চারজনের নাম পেয়েছে দুই দেশের পুলিশ। তাদের মধ্যে আক্তারুজ্জামান শাহীন, সিয়ামসহ চারজন এখনো ধরা পড়েননি। বাকি দুজন হলেন– ফয়সাল আলী সাজী ও মো. মুস্তাফিজুর রহমান ফকির। দুজনই খুলনার ফুলতলার বাসিন্দা। ঢাকায় ডিবির হাতে গ্রেপ্তার শিমুল ভুইয়ার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে এলাকায় পরিচিত তারা। এ দুজন বাংলাদেশে আছেন বলে পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে।

‘মূল পরিকল্পনাকারী’ আক্তারুজ্জামান শাহীন একজনকে ভাড়া করেছিলেন বলে জানিয়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো। সূত্র বলছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আমানুল্লাহ নামধারী ব্যক্তি এ কথা জানিয়েছেন। পরে আমানুল্লাহ ভাড়া করেন মোস্তাফিজুর রহমান ফকির ও ফয়সাল আলীকে।

কলকাতা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, খুন হওয়া ৫৭ বছর বয়সী সংসদ সদস্য আনারের পারিবারিক বন্ধু গোপাল বিশ্বাস, যার বাসায় তিনি প্রথম উঠেছিলেন। সেই গোপাল বিশ্বাস সংসদ সদস্য আনার নিখোঁজ হওয়ার খবরে গত ১৮ মে কলকাতার বরাহনগর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন।

সেই থানার তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা সুবেন্দু গোস্বামীকে উদ্ধৃত করে গোপাল বিশ্বাস গণমাধ্যমকে জানান, সংসদ সদস্য আনার হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড বাংলাদেশি আমেরিকান আখতারুজ্জামান শাহীন। যিনি কলকাতায় এসেছিলেন আমেরিকার পাসপোর্ট ব্যবহার করে। এই আখতারুজ্জামান কলকাতায় একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করেছিলেন এক বছর আগে, যার ভাড়া এক লাখ রুপি।

গোপাল বিশ্বাস আরও জানান, আখতারুজ্জামান বাংলাদেশের ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের বাসিন্দা। তার সঙ্গে সংসদ সদস্য আনারের ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে সাতজনের সহযোগিতা নিয়ে আখতারুজ্জামান সংসদ সদস্য আনারকে হত্যা করে থাকতে পারেন।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, স্বর্ণ চোরাচালানের আন্তঃদেশীয় চক্রের দ্বন্দ্বের জেরে পরিকল্পিতভাবে আনোয়ারুলকে ভারতে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান শাহীনও স্বর্ণ চোরাচালানসহ হুন্ডির অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের সঙ্গে শাহীনের দ্বন্দ্ব ছিল। এর জেরে এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় বলে তদন্তকারীরা ধারণা করছেন।

মাস্টারমাইন্ড হিসেবে যাকে খোঁজা হচ্ছে সেই আখতারুজ্জামানের ভাই বাংলাদেশের ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর পৌরসভার মেয়র শহীদুজ্জামান।

এ চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তারের পর কলকাতার সিআইডির একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে এসে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ও বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে। অপরদিকে রোববার (২৬ মে) ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ প্রধান হারুন অর রশীদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল তদন্তের জন্য কলকাতা গেছে। বাকি দুইজন হলেন– ওয়ারী বিভাগের ডিসি মো. আব্দুল আহাদ ও এডিসি শাহীদুর রহমান। তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সিআইডির সঙ্গে বৈঠকে করেছেন।

সোমবার (২৭ মে) ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন তারা। কলকাতার সঞ্জীবা গার্ডেনের সেই ফ্ল্যাটে চোখ-মুখ বেঁধে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতায় গ্রেপ্তার কসাই জিহাদ হাওলাদারকে (২৪)। ঢাকার ডিবি দল বাংলাদেশে গ্রেপ্তার তিনজনকে অনলাইনে জিহাদের সঙ্গে সামনাসামনি যুক্ত করে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।

জিহাদের সঙ্গে অনলাইনে যুক্ত হয়ে আমানুল্লাহ আমান ওরফে শিমুল, তার ভাতিজা গ্রেপ্তার তানভীর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বিবরণ দেন। এসময় ডিবি প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদসহ কলকাতার তদন্ত দলও উপস্থিত ছিল।

অনলাইনে ভিডিও কলে তারা বিবরণ দেন, ফ্ল্যাটের কোথায়, কীভাবে হত্যা করা হয়, মরদেহ কীভাবে খণ্ড খণ্ড করা হয় এবং কীভাবে বাইরে নেওয়া হয়েছিল। তিনজনকেই কলকাতায় গ্রেপ্তার কসাই জিহাদের সঙ্গেও ভিডিও কলে যুক্ত করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এসময় রক্তাক্ত কক্ষ, টেনে ব্যাগ ও স্যুটকেসে কাটা দেহাংশ তোলার বর্ণনা দেন তারা।

ডিবি সূত্রে জানা গেছে, শিমুল হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তাররা ডিবিকে যা আগে জানিয়েছে তার সঙ্গে কসাই জিহাদের দেওয়া তথ্যের মিল আছে কি না সেটা জানতে ও সেসব তথ্য যাচাই-বাছাই করতেই চারজনকে একসঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে অধিকাংশ তথ্যের মিল পাওয়া গেছে বলে ডিবি সূত্র নিশ্চিত করেছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট ডিবি কর্মকর্তারা বলছেন, কলকাতা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার কসাই জিহাদ হত্যাকাণ্ডের শুরু থেকে সব কিছু না জানলেও হত্যার পর টুকরো টুকরো করাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ কোথায় কোথায় ফেলা হয়েছে তার সব জানতেন। জিজ্ঞাসাবাদে নতুন কিছু তথ্য এসেছে, সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।

ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশ প্রধান হারুন-অর রশীদ বলেন, ভারতীয় পুলিশের উপস্থিতিতে কসাই জিহাদকে নিয়ে কলকাতার নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনের ওই ফ্ল্যাট আমরা পরিদর্শন করেছি। এটা আলিশান বাড়ি। এই বাড়িতেই সংসদ সদস্য আনার জীবন্তও অবস্থায় প্রবেশ করেছিলেন। কিন্তু তাকে মাত্র আধা ঘণ্টার মধ্যে হত্যা করা হয় অত্যন্ত বর্বরোচিতভাবে।

আনোয়ারুল আজীম আনারের দেহ কীভাবে খণ্ড খণ্ড করা হয় তার রোমহর্ষক বর্ণনা দেন কসাই জিহাদ। এসময় ডিবির প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে জিহাদকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। জিহাদকে ওই ফ্ল্যাটে থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখালে তিনি সবকিছু স্বীকার করেন।

হারুন বলেন, এই ফ্ল্যাটে ঢোকার পরই আমরা খোঁজার চেষ্টা করেছি কীভাবে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডটি ঘটানো হয়েছিল। সংসদ সদস্য আনার হত্যার পর আনন্দ উল্লাস করা হয়েছিল বলেও জানা গেছে।

তিনি বলেন, আমরা কলকাতার তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মিটিং করেছি। তাদের কাছে গ্রেপ্তার একজন আসামি জিহাদ, তাকেও আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তাকে নিয়ে ওই ফ্ল্যাট পরিদর্শন করেছি। জিহাদের কথা মতো আমরা ডাম্পিং এলাকা পরিদর্শন করেছি, যেখানে সংসদ সদস্য আনারের মরদেহের বিভিন্ন অংশ ফেলা হয়েছে। আমরা দুই দেশে গ্রেপ্তার চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্য মেলানোর চেষ্টা করছি।

তবে সোমবার রাত পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডের ১৪ দিন পার হলেও এমপি আনারের টুকরো টুকরো করা দেহের কোনো অংশই উদ্ধার হয়নি। খুনে ব্যবহার করা চাপাতিসহ অন্য ধারালো অস্ত্রও উদ্ধার করা যায়নি। আলামত উদ্ধারে কলকাতা পুলিশ ময়লার ভাগাড়, খাল ও ডোবায় গত কয়েকদিন ধরে তল্লাশি চালাচ্ছে।

জেইউ/এসএসএইচ