বিদেশে আম রপ্তানি বাড়াতে প্যাকেজিং ও সংরক্ষণ সুবিধা বৃদ্ধিসহ ৮ দফা দাবি জানিয়েছে আম ব্যবসায়ীরা ও চাষিরা। পাশাপাশি ফরমালিনের ব্যবহারের নামে অতিরঞ্জিত খবর গণমাধ্যমে প্রচারে রাজশাহী অঞ্চলের আম ব্যবসায়ী ও চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন বক্তারা।

সোমবার (২৭ মে) জাতীয় প্রেস ক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম, ঢাকার (সিজেএফডি) আয়োজনে ‘বাংলাদেশে আম উৎপাদন : সমস্যা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক জাতীয় আম সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।

সেমিনারে যেসব দাবি উঠে আসে তা হলো– রাসায়নিক উপাদানের ব্যবহার সীমিত রেখে যথাযথ পরিচর্যার মাধ্যমে আম উৎপাদন করা, আমের প্যাকেজিং ব্যবস্থার উন্নয়ন করা, আম পরিবহনের জন্য আধুনিক যানবাহনের ব্যবস্থা করা ও বিমানের কার্গোতে আম পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত-সহজতর করা, রপ্তানি উপযোগী আমের চাষ সম্প্রসারণ করা ও আম চাষি বিশেষ করে রপ্তানির জন্য আম চাষিদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, আম থেকে উৎপাদিত পণ্য যেমন জুস, জ্যাম, জেলি, আচার, ক্যান্ডির বিদেশে বাজার সম্প্রসারণ করা, আমভিত্তিক শিল্প স্থাপনে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করা ও আম রপ্তানির জন্য সব রপ্তানিকারকের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা এবং মানদণ্ড ঠিক করে দেওয়া। এছাড়াও জৈব প্রযুক্তিনির্ভর আম উৎপাদন উৎসাহিত করা, আম সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্যাকিং ও পরিবহন বিষয়ে চাষিদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার দাবি জানানো হয়।

ঢাকাস্থ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরামের (সিজেএফডি) সভাপতি আব্দুল্লাহ আল মামুনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মু. জিয়াউর রহমান, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম এমপি, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার, পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা সমিতি, ঢাকার সভাপতি সৈয়দ নুরুল ইসলাম, বাংলাদেশ অ্যাগ্রো-কেমিক্যাল ম্যানুফেকচারারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কে এস এম মুস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ।

অনুষ্ঠানে সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, রাজশাহী বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীতেই আমের চাষ বেশি হয়। জীবন-জীবিকার তাগিদে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এখন আম চাষ হচ্ছে। বর্তমানে নওগাঁ জেলায় আমের ব্যাপক চাষ হচ্ছে। আমচাষী ও ব্যবসায়ীদের নিয়ে ২০০৯ সালে সমিতি করি। আমার নির্বাচনী এলাকায় ধান নেই বললেই চলে, সব স্থানেই আমের বাগান, সবার অর্থনীতি আম চাষের ওপর নির্ভর করে। ২০২১ সালের দিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী থেকে সিলেট চট্টগ্রামে বিভিন্ন গাড়িতে আম যেত, তখন ফরমালিনের কথা বলে সব আম নষ্ট করে দেওয়া হতো। এ থেকেই বাংলাদেশের মানুষের চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী আমের প্রতি আকর্ষণ কমে যায়।

সাংবাদিকরা অতিরঞ্জিতভাবে খবরগুলো প্রচার করার কারণেই রাজশাহী অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা ও আম চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে আমি বুঝিয়ে বলি যে রাজশাহীর অঞ্চলের মানুষ আমে ফরমালিন ব্যবহার করেন না, মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা এ ধরনের কাজ করে থাকে। ফলের জন্য আগে শ্যামপুরে কোয়ারেন্টাইন সেন্টার ছিল মাত্র একটি, সেটিও বন্ধ রয়েছে, যা সরকারের সাবেক কৃষি মন্ত্রী সফর করে দেখেছেন। 

শাহরিয়ার বলেন, জাপানের মানুষ বাংলাদেশি আমের ব্যাপক প্রশংসা করেছেন। সেদিন বেশি দূরে নয় যেখানে জাপানি আমের মত বাংলাদেশের ন্যাংড়া আম নিলামে উঠবে।

মু. জিয়াউর রহমান বলেন, আমের দেশের মানুষ আমি, আম সম্পর্কে ভালো জ্ঞান আমার নেই তবে আমি আম কুড়িয়ে খেয়েছি। আমাদের আম চাষের সমস্যা অনেক, এ সমস্যার সমাধান সমাধান করতে হবে। আম সারা দেশেই হয়, তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম সুস্বাদু হয়ে থাকে। তাই আম চাষের জন্য সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

ডিআইজি নুরুল ইসলাম বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা থেকে মূলত আম চাষের বিস্তার ঘটেছে। আমাদের সবার দায়িত্ব আম চাষের পরিধি বৃদ্ধি করে এর বিস্তার ধরে রাখা।

তিনি বলেন, আমাদের চিন্তা করতে হবে আম চাষ কীভাবে লাভজনক করা যায়। আমরা বাংলাদেশের মানুষের চাহিদা অনুযায়ী আম পৌঁছে দিতে পারছি না। এ ব্যাপারে আমাদের আরও জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। আমের সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে।

নুরুল ইসলাম বলেন, আমরা থাইল্যান্ড থেকে কাঁচা আম আমদানি করে খেয়ে থাকি। কিন্তু বাংলাদেশেই ভালো মানের প্যাকেজিং ব্যবস্থা থাকলে আমদানি করতে হবে না। আমাদের কাঁচা আম প্যাকেজিং সিস্টেম করে দেশের ইউনিয়ন পর্যায়ে পৌঁছে দিতে পারি। আমের চাষিরা অনেকেই বলেন আম খাতে ভর্তুকি দিতে হবে এটা ভুল, সরকারের ভর্তুকি দেওয়ার আরও অনেক খাত রয়েছে। আম চাষ লাভজনক করতে সবাইকে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করে ভালো মানের আম দেশের অলিগলিতে পৌঁছে দিতে হবে।

আম শিল্পে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশ অন্যতম আম উৎপাদক দেশ। আবহাওয়া ও মাটি অনুকূল। মৌসুম মে-সেপ্টেম্বর, পিক জুন-জুলাই। উৎপাদন এলাকা চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, সাতক্ষীরাসহ সারাদেশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে আম চাষের এরিয়া ও ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিবছর প্রায় ২৫ লক্ষ মেট্রিক টন আম উৎপন্ন হয়। সংগ্রহ না করার কারণে ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ। আসল মৌসুমে উৎপাদন প্রাচুর্যে মূল্য হ্রাস পায়, কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যদিও সরকারি উদ্যোগে রপ্তানি ও বাজার সহায়ক স্পেশাল ট্রেন চালুর ব্যবস্থা করেছে।

জেইউ/এসএসএইচ