মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিনের (২৪) সঙ্গে শেষ ভিডিও কলে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলেছিলেন ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজিম আনার। এরপর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপর বারবার যোগাযোগ করেও সংযোগ পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ গত ১৩ মে ইন্ডিয়ান হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে তার শ্যালক উজিরের নম্বরে ম্যাসেজ আসে, ‘আমি হঠাৎ দিল্লি যাচ্ছি, সঙ্গে ভিআইপি আছে’। এরপর থেকে এমপি আনারের সঙ্গে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়। পরে আজ আসে আনারকে হত্যার খবর।

বাবার হত্যার খবরে ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে ছুটে যান ছোট মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন। 

সেখানে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমি বাবার হত্যার বিচার চাই, আমি দেখতে চাই কারা আমাকে এতিম করল। কারা হত্যাকারী। আমি বাবার হত্যাকারীদের ফাঁসিতে ঝুলে মৃত্যু দেখে যেতে চাই।

পরে ডিবি পুলিশের পরামর্শে রাজধানীর শেরে বাংলা নগর থানায় খুনের উদ্দেশ্যে অপহরণের মামলা দায়ের করেন তিনি। মামলা নং ৪২। মামলার আসামিরা অজ্ঞাত।

মামলায় বাদী ডরিন উল্লেখ করেন, মানিক মিয়া এভিনিউয়ে সংসদ সদস্যদের বাসভবনে স্বপরিবারে বসবাস করি। গত ৯ মে রাত ৮টার দিকে সংসদ সদস্যদের বাস ভবন থেকে বাবা ঝিনাইদহের গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। গত ১১ মে বিকেল ৪টা ৪৫ মিনিটে তার মোবাইল নম্বরে কথা বললে কথাবার্তায় কিছুটা অসংলগ্নতা মনে হয়। এরপর বাবার মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও বন্ধ পাই। 

এরপর ১৩ মে তিনি তার ইন্ডিয়ান নম্বর থেকে উজির মামার মোবাইল নাম্বারে হোয়াটসঅ্যাপে ম্যাসেজ করেন, তাতে লেখা, ‘আমি হঠাৎ করে দিল্লি যাচ্ছি, আমার সঙ্গে ভিআইপি আছে’। আমি অমিত সাহার কাছে যাচ্ছি। আমাকে ফোন দেওয়ার দরকার নাই। আমি পরে ফোন দিব।’ এটা ছাড়াও আরও কয়েকটি ম্যাসেজ আসে। ম্যাসেজগুলো আমার বাবার মোবাইল ফোন ব্যবহার করে অপহরণকারীরা করে থাকতে পারে। 

ডরিন আরও উল্লেখ করেন, আমরা বিভিন্ন জায়গায় আমার বাবার খোঁজ-খবর করতে থাকি। কোনও সন্ধান না পেয়ে বাবার বন্ধু গোপাল বিশ্বাস বাদি হয়ে ইন্ডিয়ান বারানগর থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। আমরা বাবাকে খোঁজাখুঁজি অব্যাহত রাখি। পরে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানতে পারি অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা পূর্ব পরিকল্পিতভাবে পরস্পর যোগসাজশে আমার বাবাকে অপহরণ করেছে।

এর আগে, কলকাতার গণমাধ্যমে খবর ছড়ায় আনোয়ারুল আজীম হত্যার শিকার। এরপর এ ব্যাপারে প্রথম গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, ভারতে গিয়ে নিখোঁজ বাংলাদেশের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের মরদেহ উদ্ধারের খবর পেয়েছি গণমাধ্যম সূত্রে। তবে, ইন্ডিয়ান বা কলকাতা পুলিশ আমাদের এখনো কিছু নিশ্চিত করেনি। তিনি জীবিত না কি মৃত তা এখনো অফিসিয়ালি নিশ্চিত নই। আমরা যৌথভাবে কাজ করছি। 

পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে। কারা তাকে খুন করেছে তা জানতে বাংলাদেশ ও ভারতের পুলিশ কাজ করছে।

এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে আটক করা হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, আটক তিনজন বাংলাদেশ পুলিশের কাছে আছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

মন্ত্রী বলেন, চিকিৎসার জন্য আনোয়ারুল আজীম দেশের বাইরে গিয়েছিলেন। সেখানে তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। ভারতের পুলিশ আমাদের নিশ্চিত করেছে, তাকে হত্যা করা হয়েছে। 

প্রাথমিক তদন্তের বরাত দিয়ে মন্ত্রী বলেন, খুনের সঙ্গে ভারতের কেউ জড়িত নয়। বাংলাদেশিরাই খুন করেছে। সেহেতু বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খারাপ হওয়ার কোনো কারণ নেই। ভারত আমাদের যথেষ্ট কো-অপারেশন করছে। 

তিনি বলেন, আমাদের কাছে আরও তথ্য আছে। তবে তদন্তের স্বার্থে এখন জানাতে পারছি না। 

এমপি আনোয়ারুল আজীম হত্যাকাণ্ডের কারণ জানতে নিবিড়ভাবে তদন্ত চলছে বলে জানান ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন-অর-রশিদ।

ডিবি প্রধান বলেন, ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক। ঝিনাইদহ-কালিগঞ্জ এলাকার জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধি ছিলেন তিনি। তার এলাকার সাধারণ মানুষ স্তম্ভিত। আমরা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি। তিনি তিনবারের সংসদ সদস্য। এটি নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড, এটা মনে করেই তদন্তকারী কর্মকর্তারা কাজ করছেন। নিবিড়ভাবে ভারতীয় পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। কয়েকজন আমাদের কাছে আছে, তাদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচ্ছি। তদন্তের স্বার্থে আমরা সবকিছু বলতে পারছি না।

হারুন-অর-রশিদ বলেন, একজন সংসদ সদস্যকে বাংলাদেশি অপরাধীরা নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকি যারা আছে তাদের প্রত্যেককে আমরা আইনের আওতায় আনব। বিচারের মুখোমুখি করব। তদন্তের স্বার্থে নাম প্রকাশ করতে চাচ্ছি না।

বিভিন্ন ধরনের ভুল তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। কী কারণে হত্যার ঘটনা ঘটেছে জানা গেছে কি না? এ প্রশ্নের জবাবে ডিবি প্রধান বলেন, আসলে এটা কী কারণে ঘটেছে জানতে আমাদের তদন্ত চলছে। এটা পারিবারিক, আর্থিক না কি এলাকায় কোনো দুর্বৃত্ত দমন করার কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে, সবকিছু আমরা তদন্তে আনব।

জেইউ/কেএ