দুপুর থেকেই ভিড় বাড়তে থাকে চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে। সবার চোখে-মুখে তখন আনন্দের ছাপ। কখন ফিরবেন এমভি আব্দুল্লাহর ২৩ নাবিক, সেটিরই অপেক্ষা। অবশেষে অপেক্ষার পালা শেষ হয় বিকেল ঠিক ৪টায়। বন্দরের জেটিতে ভেড়ে কেএসআরএমের মালিকানাধীন জাহাজ এমভি জাহান মনি। চিৎকার করে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন অপেক্ষায় থাকা স্বজনরা। পরে একে একে জাহাজ থেকে নেমে আসেন ২৩ নাবিক। স্বজনদের সেই উচ্ছ্বাস বাড়ে আরও কয়েকগুণ, অনেকে চোখেই তখন আনন্দ অশ্রু। সেখানে তৈরি হয় আবেগঘন পরিবেশের। অবশেষে শত উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা শেষে জিম্মিদশার ৬৪ দিন পর ঘরে ফেরেন ২৩ নাবিক।

মঙ্গলবার (১৪ মে) বিকেলে কর্ণফুলী পাড়ের চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে এমনই এক মুহূর্তে সৃষ্টি হয়।

এরপর নাবিকদের ফুল দিয়ে বরণ কর নেয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। সেখানে নাবিকদের বরণ করে নেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল ও কেএসআরএমের প্রধান নির্বাহী মেহেরুল করিমসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা।

এমভি আব্দুল্লাহ’র ক্যাপ্টেন আব্দুর রশীদ বলেন, ২৩ জন নাবিককে আগলে রেখেছিলাম। বিভীষিকাময় পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হবো বিশ্বাস ছিলে। একটা জাহাজ গেলে তার লোকসান হয়তো মানা যায়, কিন্তু একটা প্রাণ গেলে ফেরানো যাবে না কোনওভাবেই। তাই সবসময় সব ক্রুদের দস্যুদের থেকে নিরাপদে আগলে রাখার কথা ভাবতাম। এই দিনটা খুবই স্পেশাল আমাদের জন্য। দীর্ঘ ৩৩ দিন যে সময়ের মধ্য দিয়ে গেছি, তার অবসান হলো।

ছেলেকে ফিরে পেয়ে এমভি আব্দুল্লাহ’র ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদের মা জোসনা বেগম বলেন, একবার ভেবেছিলাম কলিজার টুকরাকে ফেরত পাবো না। কিন্তু আল্লাহর ওপর ভরসা ছিল। বড় বিপদ থেকে মুক্ত হয়ে ফিরেছে আমার বুকে। আর কারও পরিবার যাতে এই পরিস্থিতিতে না পড়ে, সেই দোয়া করি।

কেএসআরএম গ্রুপ জানায়, এমভি আবদুল্লাহ জাহাজে ৫৬ হাজার টন পণ্য চুনাপাথর রয়েছে। এতে প্রায় ১৯০ মিটার লম্বা জাহাজটির ড্রাফট (জাহাজের পানির নিচের অংশের গভীরতার পরিমাপ) বেড়ে হয়েছে সাড়ে ১২ মিটার। জাহাজটির ড্রাফট বেশি থাকায় কুতুবদিয়ায় প্রথমে কিছু পরিমাণ পণ্য খালাস করা হবে। এরপর পতেঙ্গার কাছাকাছি বঙ্গোপসাগরে বন্দর জলসীমায় আনা হবে। সেখানে বাকি পণ্য খালাস করা হবে। এ জন্য দেশে পৌঁছার পরও নাবিকদের ঘরে ফিরতে একটু সময় লেগেছে। 

জলদস্যুর কবলে এমভি আব্দুল্লাহ

গত ১২ মার্চ দুপুরে শিল্প গ্রুপ কেএসআরএমের মালিকানাধীন এসআর শিপিংয়ের জাহাজটি জিম্মি করে সোমালিয়ান দস্যুরা। অস্ত্রের মুখে সেখানে থাকা ২৩ নাবিককে একটি কেবিনে আটকে রাখা হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় জাহাজের ইন্টারনেট সংযোগও। ছিনিয়ে নেওয়া হয় নাবিকদের কাছে থাকা মোবাইল, সঙ্গে থাকা ডলার।

জাহাজটি ৫৮ হাজার মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে গত ৪ মার্চ আফ্রিকার মোজাম্বিকের মাপুটো বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে। ১৯ মার্চ সেটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের হামরিয়াহ বন্দরে পৌঁছানোর কথা ছিল। জাহাজটিতে ছিলেন ২৩ বাংলাদেশি নাবিক। ১২ মার্চ বাংলাদেশ সময় বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে জাহাজটিকে ভারত মহাসাগর থেকে সোমালিয়ার উপকূলে নিয়ে যাওয়ার কাজ শুরু করে জলদস্যুরা। জাহাজটি ওই সময় সোমালিয়া উপকূল থেকে ৪৫০ নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থান করছিল। সোমালিয়ার উপকূল নিয়ে যাওয়ার পর এক সপ্তাহের পরের মুক্তিপণ চেয়ে মালিকপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি জলদস্যুরা।

মালিকপক্ষের সঙ্গে জলদস্যুদের যোগাযোগ 

জাহাজটিকে জিম্মি করার আট দিন পর ২০ মার্চ প্রথমবারের মতো এমভি আব্দুল্লাহ’র মালিকপক্ষ কবির গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ করে সোমালি জলদস্যুরা। জিম্মি করার পর ২৩ নাবিকসহ জাহাজটিকে বেশ কয়েকবার হাতবদল করা হয়। যারা যোগাযোগ করছে তারাই অপহরণের মূল হোতা বলে দাবি জাহাজটির মালিকপক্ষের। শুরুতে যারা অপহরণ করেছিল তারা ছিল মূলত ভাড়াটে।

মুক্তিপণ দিয়ে মুক্ত ২৩ নাবিক

১৪ এপ্রিল জলদস্যুদের হাতে জিম্মি এমভি আবদুল্লাহর ২৩ নাবিক দীর্ঘ এক মাস পর মুক্তি পান। ওইদিন বাংলাদেশ সময় রাত ৩টায় জাহাজটি থেকে ৬৫ জলদস্যু নেমে যাওয়ার পরই মুক্তি পান নাবিকরা। সোমালি জলদস্যুদের বরাতে রয়টার্স জানায়, ৫০ লাখ ডলার মুক্তিপণের বিনিময়ে এমভি আবদুল্লাহ এবং এর নাবিকদের মুক্তি দেওয়া হয়।

মুক্তি পাওয়ার পরপরই এমভি আবদুল্লাহ দুবাই বন্দরের দিকে রওনা দেয়। জলদস্যুরা নেমে যাওয়ার পরপরই জাহাজটির কাছে ছুটে আসে ইইউয়ের অপেক্ষমাণ যুদ্ধজাহাজ। ইইউর নৌ সদস্যরা এমভি আবদুল্লাহ জাহাজে উঠে নাবিকদের শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করেন। জলদস্যুদের রেখে যাওয়া কিছু আলামত এবং ফিঙ্গারপ্রিন্টও সংগ্রহ করে। দুবাইমুখী চলাচলের পথে বেশ কিছু সময় যুদ্ধজাহাজগুলো এমভি আবদুল্লাহকে এসকর্ট সুবিধা দেয়। যাতে ফের কোনো জলদস্যু টিম ঝামেলা না করে।

২১ এপ্রিল দুবাইয়ে পৌঁছে এমভি আব্দুল্লাহ

সোমালি জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্তি পাওয়া এমভি আবদুল্লাহ জাহাজসহ ২৩ নাবিক ২১ এপ্রিল বাংলাদেশ সময় বিকাল সাড়ে ৪টা নাগাদ সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই আল হারমিয়া বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছে। এরপর সেখানে জাহাজটিতে থাকা কয়লা খালাস করা হয়। 

দেশের পথে এমভি আব্দুল্লাহ

৩০ এপ্রিল ভোরে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ ২৩ জন ক্রু সদস্য নিয়ে দেশের পথে রওনা হয়। সে সময় বন্দরটি থেকে এমভি আবদুল্লাহতে প্রায় ৫৬ হাজার টন চুনাপাথর জাহাজে বোঝাই করা হয়। 

বাংলাদেশের জলসীমায় এমভি আব্দুল্লাহ

রোববার (১২ মে) সকালে জাহাজটি বঙ্গোপসাগরে দেশের জলসীমায় প্রবেশ করে। ওইদিন সকাল সাড়ে ১০টায় জাহাজটির অবস্থান ছিল চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মাত্র ৩০০ নটিক্যাল মাইল দূরে। সোমবার (১৩ মে) বিকেলে জাহাজটি কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায় পৌঁছায়। সন্ধ্যা ৬টায় জাহাজটি নোঙর করে। এরপর কেএসআরএমের মালিকানাধীন আরেকটি জাহাজ এমভি জাহান মনি-৩ করে মঙ্গলবার সাড়ে ১১টায় কুতুবদিয়া থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্দেশ্য রওয়ানা হন ২৩ নাবিক। 

আরএমএন/কেএ