পশুর হাট না বসানোর নির্দেশে খুশি আফতাবনগরবাসী
রাজধানীতে কোরবানির পশু বেচা-কেনার জন্য যে কয়েকটি হাট বসে তার মধ্যে অন্যতম আফতাবনগর হাট। প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই হাটে গরু নিয়ে আসেন বিক্রেতা ও খামারিরা। ক্রেতাদেরও ব্যাপক সমাগম ঘটে এখানে। তবে এই হাট নিয়ে আফতাবনগরের বাসিন্দাদের নানা অভিযোগ আছে। তারা এখানে হাট বসতে দিতে রাজি নন। এ নিয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করা হয়। সেখানে এলাকার বাসিন্দাদের পক্ষে সিদ্ধান্ত এসেছে।
পশুর হাট বসানোর ইজারার বিজ্ঞপ্তি স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট। যার ফলে এবার আফতাবনগরে বসছে না কোরবানির হাট। কোর্টের এমন নির্দেশনার পর খুশি আফতাবনগরের বাসিন্দারা। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন।
বিজ্ঞাপন
আফতাবনগরে পশুর হাট বসানোর জন্য এবার ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ দুই সিটি কর্পোরেশনই ইজারা বিজ্ঞপ্তি দেয়। ওই দুই বিজ্ঞপ্তি চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন জহুরুল ইসলাম সিটি সোসাইটির (আফতাবনগর সোসাইটি) সভাপতি মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন ঢালী ও সাধারণ সম্পাদক এস এম কামাল। রিটে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সচিব, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়।
আরও পড়ুন
গতকাল (৮ মে) বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের বেঞ্চে রিটের শুনানি হয়। শুনানির পর হাটের ইজারার বিজ্ঞপ্তি স্থগিত করে রুলসহ আদেশ দেন হাইকোর্ট।
প্রতিবছর পশুর হাটের কারণে ভোগান্তি পোহানো আফতাবনগরের বাসিন্দারা হাইকোর্টের এ আদেশের পর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। আবাসিক এলাকাটির স্থায়ী বাসিন্দা বেসরকারি একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা হৃদয় হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, পরিবার নিয়ে স্থায়ীভাবে এখানে বসবাস করি। কোরবানির পশুর হাট বসলে এখানে নানা সমস্যা হয়। আপরিচ্ছন্ন হয়ে যায় পুরো এলাকায়। প্রচুর লোকের সমাগম ঘটে, যানজট হয়, যাতায়াতের সমস্যা হয়। গরুর হাটের ময়লা ঠিকমতো পরিষ্কারও করা হয় না। ফলে সেখানে দুর্গন্ধ হয়, পানি জমে এটা আরও তীব্র হয়, মশার উৎপাত বাড়ে। সবমিলিয়ে বিড়ম্বনার শেষ থাকে না। আমরা চাই এখানে আর কখনো কোরবানির পশুর হাট না বসুক।
তিনি বলেন, গরুর হাটের কারণে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে সন্ত্রাসী, চোর, চাঁদাবাজরা এই এলাকায় এসে একত্রিত হয়। যা এখানকার বাসিন্দাদের জন্য নিরাপত্তা হুমকি তৈরি করে। চুরি-ডাকাতি বেড়ে যায়।
আব্দুস সালাম নামে আরেক বাসিন্দা বলেন, হাট বসিয়ে পুরো এলাকা নোংরা করে দেওয়া হয়। মানুষের ভিড়ে হাঁটা চলা করা যায় না। এটা তো আবাসিক এলাকা। মানুষ নীরবে বসবাসের জন্য এখানে বাড়ি করেছে বা বাসা ভাড়া নিয়েছে। কিন্তু হাট বসিয়ে পুরো এলাকায় একটা বিশৃঙ্খলা তৈরি করা হয়। উচ্চ আদলত যে রায় দিয়েছেন তাতে আমরা খুব খুশি হয়েছি।
তিনি বলেন, এখান থেকে পশু কিনে সবাই কোরবানি করতে পারলেও আফতাবগরবাসী শন্তিতে কোরবানি করতে পারেন না। কারণ ময়লা-আবর্জনার কারণে কোরবানি দেওয়ার মতো পরিষ্কার জায়গা থাকে না। প্রতিবছর এটা নিয়ে খুব ভোগান্তি পোহাতে হয়।
ইসহাক মিয়া নামে এই এলাকার আরেক বাসিন্দা বলেন, আবাসিক এলাকা হাটের জন্য নয়, এটা মানুষের শান্তিতে বসবাসের জন্য। প্রতিবার হাট বসিয়ে মানুষকে খুব অসুবিধার মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়। এবার শুনেছি হাট না বসাতে হাইকোর্ট রায় দিয়েছেন, এটি আমাদের জন্য সুখবর।
তিনি বলেন, গরুর হাটের কারণে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা বিঘ্নিত হয়, পরিবেশ থাকে না। এখানে শতাধিক আইনজীবী, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ বাস করেন, যারা সবাই এখানে হাট বসানোর বিপক্ষে।
স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন ২০০৯ এর ধারা ৩ (২) ও ১ম তফসিল অনুযায়ী আফতাবনগর (ইস্টার্ন হাউজিং) বাড্ডা থানার ৩৭ নং ওয়ারেডর অধীন, যা ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) অন্তর্ভুক্ত।
আফতাবনগরের হাট নিয়ে জানতে চাইলে ডিএনসিসির মুখপাত্র মকবুল হোসাইন বলেন, এটা এখন আর আমাদের বিষয় নয়, হাইকোর্টের বিষয়। আদালত যে রায় বা সিদ্ধান্ত দেবেন সেটা আমরা মেনে নেব।
এদিকে আফতাবনগরের এই হাট নিয়ে শুরু থেকেই দুই সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে টানাটানি চলছে। দুই সিটি কর্পোরেশন পৃথকভাবে ইজারা বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। নাগরিক সমস্যার কথা উল্লেখ করে বিভিন্ন সময় হাটের অনুমতি না দিতে দুই সিটি কর্পোরেশনের কাছে চিঠি দিয়ে আবেদন জানিয়ে আসছে জহুরুল ইসলাম সিটি সোসাইটি (আফতাবনগর সোসাইটি)।
সম্প্রতি রাজধানীর ১১টি স্থানে কোরবানির পশুর অস্থায়ী হাট বসানোর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। সেখানে ৮ নম্বর হাট হিসেবে ইস্টার্ন হাউজিং (আফতাবনগর) ব্লক ই, এফ, জি এবং সেকশন ১ ও ২ এর খালি জায়গায দেখানো হয়। অস্থায়ী পশুর হাটের জন্য ২ কোটি ৫৫ লাখ ৯৯ হাজার টাকা সরকারি মূল্য নির্ধারণ করা হয়।
অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন নয়টি স্থানে অস্থায়ী পশুর হাট বসানোর জন্য ইজারা বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। সেখানে ৪ নম্বর হাট হিসেবে ইস্টার্ন হাউজিং (আফতাব নগর) হাটের নাম রয়েছে। তারা আফতাব নগরের ব্লক ই, এফ, জি, এইচ, এল, এম, এনসহ আশপাশের খালি জায়গায় হাট বসানোর জন্য সরকারি মূল্য এক কোটি ৭৪ লাখ ২ হাজার ৭২৭ টাকা নির্ধারণ করে।
আরও পড়ুন
দুই সিটির মেয়রের কাছে সোসাইটির চিঠি
পশুর হাট বসানোর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর জহুরুল ইসলাম সিটি সোসাইটির সভাপতি মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন ঢালী এবং সাধারণ সম্পাদক এস এম কামাল স্বাক্ষরিত পৃথক দুটি চিঠি ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের কাছে পাঠানো হয়।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বাড্ডা থানার আফতাবনগর, জহুরুল ইসলাম সিটি, ইস্টার্ন হাউজিং লি. এর একটি আবাসিক এলাকা। এখানে বর্তমানে প্রতি ব্লকে প্রচুর ইমারত নির্মিত হয়েছে এবং দুই লাখের বেশি মানুষ এখানে বসবাস করেন। ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, ইম্পেরিয়াল কলেজসহ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে এখানে। প্রতিবছর এখানে গরুর হাট দেওয়ার কারণে এলাকাবাসী ও ছাত্র-ছাত্রীরা নানা সমস্যার সম্মুখীন হন। হাট বসানোর সময় যত্রতত্র অপরিকল্পিত পানির লাইন সংযোগ দেওয়া হয়, পরবর্তীতে সঠিকভাবে এসব পানির লাইন বন্ধ না করার কারণে এলাকাবাসীকে সারা বছর ময়লা পানি ব্যবহার করতে হয়। বৈদ্যুতিক লাইন টানার সময় স্ট্রিট লাইট ও অন্যান্য লাইনের তারগুলো ছিঁড়ে ফেলা হয়। পরবর্তীতে এগুলো মেরামতে সোসাইটিকে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, রাস্তায় গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার কারণে এলাকাবাসীর চলাচল, মালামাল পরিবহন ও অসুস্থ রোগীকে জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে নিতে অসুবিধা হয়। এমনকি মৃত ব্যক্তির লাশ দাফন করার জন্যও পরিবহন সমস্যার সৃষ্টি হয়। এছাড়া গরুর হাট শেষ হলেও ময়লা আবর্জনা মাসের পর মাস পরিষ্কার করা হয় না। দুর্গন্ধ ও মশার অত্যাচারে এখানে বসবাস খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। তাছাড়া এলাকার প্রবেশমুখ প্রগতি সরণিতে রামপুরা ব্রিজের আশপাশে ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হয়।
এই পরিস্থিতিতে চলতি বছর ২০২৪ থেকে কোরবানির ঈদ উপলক্ষ্যে আফতাবনগর আবাসিক এলাকায় গরু ছাগলের হাট বসানোর অনুমতি না দেওয়ার জন্য এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে আবেদন জানানো হলো।
দাবির পক্ষে রায় পেয়েছে আফতাবনগরবাসী
এ বিষয়ে জহুরুল ইসলাম সিটি সোসাইটির (আফতাবনগর) সভাপতি মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন ঢালী ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটি সম্পূর্ণ আবাসিক এলাকা, এখানে অনেক মানুষ বসবাস করেন। রায়ও হয়েছে হাট না বসানোর পক্ষে। অন্যান্যবার হাট শেষ হয়ে যাওয়ার পর তারা পরিষ্কার করে না, দুর্গন্ধ হয়। কোনো অ্যাম্বুলেন্স ঢুকতে পারে না, প্রাইভেটকার, রিকশা নিয়েও যাওয়া যায় না। বৃষ্টি হলে কাঁদা হয়ে যায়, মশা বংশ বিস্তার করে। গরুর ব্যাপারিরা আশপাশে প্লটে গর্ত করে, সেখানে পানি জমাট হয়, এডিস মশার উৎপাদন হয়। লাখ লাখ লোক আসে কিন্তু বাথরুম থাকে না, তারা আশপাশে মলমূত্র ত্যাগ করে পরিবেশ দূষণ করে। এছাড়া তারা পাইপ লাইনগুলো কেটে সেখানে তাদের পানির ব্যবস্থা করে, পরে আর ঠিক করে না। বৃষ্টি হলে সে পানি গিয়ে ব্যবহার্য পানির সঙ্গে মিশে যায়। সেই কারণে পরে এসব লাইনের পানি খেয়ে এলাকার মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে।
তিনি বলেন, সবমিলিয়ে হাটের কারণে আফতাবনগরে বসবাসকারী প্রতিটি মানুষ দুর্ভোগ পোহায়, তাদের বিড়ম্বনার শেষ থাকে না। যে কারণে এই এলাকার মানুষের দাবি ছিল যেন এখানে আর হাট না বসে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এই এলাকার সবাই গণস্বাক্ষর করে দাবি জানিয়ে আসছিল। এরপর হাট না বসার পক্ষে সিদ্ধান্ত পেয়ে এই এলাকার প্রতিটি মানুষ খুব খুশি হয়েছে। দাবির পক্ষে রায় পেয়েছে আফতাবনগরবাসী।
এএসএস/এমজে