ছবি- ঢাকা পোস্ট

হ্যালো…! আমি এসবির এসআই মারুফ বলছি। আপনি কি শরীফ? আপনি কি পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেছেন? উত্তরে হ্যাঁ বলতেই ফোনের ওপার থেকে বলা হচ্ছে— আমি আপনার আবেদনের ভেরিফিকেশনের দায়িত্বে আছি। আপনার এনআইডি, বিদ্যুৎ বিলের কপিসহ দেখা করুন। সাক্ষাৎ করতে না পারলে কাগজপত্র হোয়াটসঅ্যাপে পাঠান। এরপর দ্রুত ভেরিফিকেশনের কথা বলে সাক্ষাৎ না করেই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে বলেন সেই মারুফ। টাকা পাঠানোর পর আর সেই নম্বরের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় না।

সম্প্রতি বেশ কয়েকজন পাসপোর্ট আবেদনকারীর সঙ্গে এমন প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে। প্রতারণার শিকার বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগীর অভিযোগের পর এসব তথ্য উঠে আসে।

পুলিশসূত্রে জানা যায়, পাসপোর্ট আবেদনকারীর সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটলেও বিষয়টি জানেন না আসল ভেরিফিকেশনের দায়িত্বে থাকা এসবি সদস্যরা। মূলত স্প্যাম কলে প্রতারণা করে আসছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। অভিনব এই প্রতারক চক্রের সদস্যরা ব্যবহার করেন ভুয়া রেজিস্ট্রিকৃত সিম। পরে আসল ভেরিফিকেশনের দায়িত্বে থাকা এসবি সদস্যদের নম্বর ক্লোন করে প্রতারণার কাজে ব্যবহার করেন। এসব ঘটনায় জড়িত রয়েছেন পাসপোর্ট অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী, পিয়ন ও আনসার সদস্য। তারা পাসপোর্ট আবেদনকারীদের ডেলিভারি স্লিপ এবং আবেদন ফরমে দেওয়া মোবাইল নম্বর ও তথ্য সংগ্রহ করে চক্রের কাছে সরবরাহ করে। 

এসব ঘটনায় রাজধানীর সবুজবাগ থানায় একটি মামলা দায়ের করে এসবি। ওই মামলার তদন্তে সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের সন্ধান পায় ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম(দক্ষিণ) বিভাগ। গ্রেপ্তার করা হয় চক্রটির মূলহোতাসহ ৯ সদস্যকে।

গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- মূলহোতা কাজী মো. বেলাল হোসেন (৩৫), মো. জসিম উদ্দিন (৩৩), আল-আমিন গাজী (২৭), হাসান আহম্মেদ (২৯), সোহাগ আলম, হোসাইন মোল্লা, নুরুজ্জামান মিয়া, মামুনুর রহমান ও রাসেল ইসলাম।

ডিবি পুলিশের অভিযানে গ্রেপ্তার অভিযুক্তরা

ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ (দক্ষিণ) বলছে, প্রতারণায় শুধু এই সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র নয়, জড়িত রাজধানীর দুটি পাসপোর্ট অফিসের অন্তত দুই ডজন অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী, পিয়ন ও আনসার সদস্য। তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। কারা কারা জড়িত, তাদের তালিকাও দেওয়া হয়েছে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে।

ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের (দক্ষিণ) অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার(এডিসি) মো. সাইফুর রহমান আজাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই প্রতারক চক্রটি পাসপোর্ট অফিসে ওৎ পেতে থাকে। পাসপোর্ট অফিসের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী, পিয়ন ও আনসার সদস্যের যোগসাজশে পাসপোর্ট অফিস থেকে আবেদনকারীদের তথ্য সংগ্রহ করে। এরপর স্পেশাল ব্রাঞ্চের পুলিশ অফিসার পরিচয় দিয়ে সেসব নম্বরে কল করে। চক্রের সদস্যরা প্রথমে আবেদনকারীকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র (এনআইডি, বিদ্যুৎ বিলের কপি) হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানোর জন্য বলে এবং পরে প্রতারণা করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করে।

কীভাবে কাজ করত চক্রটি

গ্রেপ্তার বেলাল ও জসিম চক্রের মূলহোতা। আর হাসান, আল-আমিন ভেরিফিকেশনের নামে মিথ্যা পুলিশ পরিচয়ে পাসপোর্ট আবেদনকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করত।

ডিবি পুলিশ জানায়, টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন পাসপোর্ট অফিসে কর্মরত কিছু আনসার সদস্য, পিয়ন, কর্মচারী এই চক্রের সঙ্গে জড়িত। অধিক লাভের আশায় বিভিন্ন কম্পিউটার দোকানের কর্মচারীও এই চক্রে জড়িয়েছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের(ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ / ফাইল ছবি

এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের(ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, পাসপোর্ট আবেদনকারীকে ফোন করে একটি চক্র এসবি পরিচয় দিয়ে টাকা চায় ও টাকা নেয় বলে অভিযোগ পাই। সেই সংক্রান্ত একটি মামলা তদন্ত করতে গিয়ে এই সংঘবদ্ধ চক্রের সন্ধান পাই।

হারুন বলেন, গ্রেপ্তার চক্রের মূলহোতা কাজী বেলাল হোসেনের নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে তিন মামলা রয়েছে। গ্রেপ্তার জসিম উদ্দিনের নামে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দুটি মামলা রয়েছে।

পাসপোর্ট অফিসে যোগাযোগ রাখেন বেলাল, সিম সরবরাহ করেন মোল্লা

মূলহোতা বেলাল পাসপোর্ট অফিসে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। আবেদনকারীর সব তথ্য পাওয়ার পর ফোন করেন। এর আগে ভুয়া নামে রেজিস্ট্রিকৃত মোবাইল সিম সরবরাহ করে সিম বিক্রেতা হোসাইন মোল্লা। সেই ভুয়া রেজিস্ট্রিকৃত সিম ব্যবহার করে পুলিশের ছবি ও নাম ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করে বিভিন্ন অ্যাপস ইন্সটল করে সেখানে এগুলো আপডেট করা হয়। এরপর সংগৃহীত তথ্য উল্লেখ করে পাসপোর্টের আবেদনকারীকে ফোন করা হয়। অধিকাংশ তথ্যই বিশ্বাসযোগ্য মনে হওয়ায় টাকা দিয়ে দেন পাসপোর্টপ্রত্যাশীরা।

নম্বর ক্লোন ও অ্যাপে এসবি কর্মকর্তার নাম সেভ করে ফোন দেওয়া হয় ভুক্তভোগীদের

ডিবি প্রধান বলেন, কল দেওয়ার আগে আসল ভেরিফিকেশনে জড়িত এসবি সদস্যদের নাম ও ছবি সংগ্রহ করে অ্যাপসে সেভ করা হয়। এরপর আবেদনকারীকে ফোন দিলে তার ফোনে সেসব পরিচয় দেখা যায়। কথোপকথনে সব তথ্য উল্লেখ করার ফলে আবেদনকারীর পক্ষে অবিশ্বাসের সুযোগ থাকে না। তখন সাক্ষাৎ ছাড়াই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাঠিয়ে দেন আবেদনকারীরা। বহুদিন যাবৎ চক্রটি এভাবে প্রতারণা করে আসছে।

পাসপোর্ট অফিসের কোনো কর্মকর্তা জড়িত কি না— জানতে চাইলে হারুন বলেন, শুধু আগারগাঁও নয় উত্তরা পাসপোর্ট অফিসের কিছু কর্মকর্তা, পিওন ও আনসার সদস্য জড়িত, তাদের নাম ও নম্বর পেয়েছি। তাদের তালিকাসহ সার্বিক বিষয় ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে জানানো হয়েছে।

জেইউ/এমজে