১ এপ্রিল সন্ধ্যা ৭টা। ২২তম রোজায় ইফতার করে মিরপুরের পাইকপাড়ার মিল্টন সমাদ্দারের আশ্রম ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’-এ হারানো কবুতর খুঁজতে যান বিপরীত পাশের ভবনের বাসিন্দা সুজন আলী। গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে আশ্রমের কর্মীদের কাছে কবুতরের কথা জানতে চাইলে খারাপ আচরণ শুরু করেন তারা। একপর্যায়ে হয় কথা-কাটাকাটি।

পরে আশ্রম থেকে সুজন বের হয়ে আসতে চাইলে গেটের কাছ থেকে ধরে নিয়ে উপর্যুপরি মারধর করেন আশ্রমের কর্মচারীরা। ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে মারধরের শিকার হন সুজনের মা সালেহা বেগমও। শেষ পর্যন্ত স্থানীয়রা গিয়ে উদ্ধার করেন দুজনকে। এ সময় মিল্টন সমাদ্দার সেখানে উপস্থিত হয়ে জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন দিয়ে চাঁদাবাজির মামলায় সুজনকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য কর্মীদের নির্দেশ দেন।

শুধু এই ঘটনাই নয়, মানবতার সেবকরূপে আবির্ভূত মিল্টন সমাদ্দারের ভেতরের রূপ আরও ভয়ংকর। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনি এলাকায় সবসময় দাপট দেখিয়ে চলাচল করতেন। পাত্তা দিতেন না কাউকেই। রয়েছে নিজস্ব লাঠিয়াল বাহিনীও। কেউ কোনো বিষয়ে মিল্টন সমাদ্দারের মতের বাইরে গেলে তাকে পড়তে হয়েছে রোষানলে। শুনতে হয়েছে অকথ্য গালাগাল। তার ভয়ে সবসময় তটস্থ থাকতে হয়েছে এলাকাবাসীকে। সামান্য উনিশ-বিশ হলেই তার নির্যাতনের শিকারও হতে হয়েছে অনেককে। এখানেই শেষ নয়, দেখানো হতো মামলার ভয়। তাই নির্যাতনের পরও অনেকে মুখ বুজে সহ্য করেছেন সবকিছু। আশ্রমের কর্মীরাও মিল্টনের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে হয়েছেন বেশ বেপরোয়া। সেজন্য তারা এলাকাবাসীর কাছে মিল্টনের ‘লাঠিয়াল বাহিনী’ হিসেবে পরিচিত লাভ করেছে।

শুক্রবার (৩ মে) সকাল থেকে দিনভর মিরপুরের দক্ষিণ পাইকপাড়া এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে। তবে এখনও বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে ভয় পান স্থানীয়রা। তাদের মতে, মিল্টন সমাদ্দার অত্যন্ত বদরাগী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তিনি মমতা মাখানো ভিডিও দিলেও তার বাস্তব আচরণ খুবই খারাপ। ছোট-বড়-বয়স্ক এমনকি নারীদের সঙ্গেও খারাপ আচরণ করতেন তিনি। সেজন্য যতটা সম্ভব তার বিষয়গুলো থেকে নিজেদের গুটিয়ে রাখতেন স্থানীয়রা।

ভুক্তভোগী সুজন আলী

শুক্রবার পাইকপাড়ায় ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদককে স্থানীয়রা জানান, সামান্য একটি কবুতরকে ঘিরে তিলকে তাল করেছেন মিল্টন সমাদ্দার। পিটিয়েছেন মা-ছেলে দুজনকে। থানায় অভিযোগ করেও প্রতিকার পায়নি ভুক্তভোগী পরিবারটি।

এ বিষয়ে কথা বলতে যোগাযোগ করা হয় ভুক্তভোগী সুজন আলীর সঙ্গে। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, আমাদের বাসা ও মিল্টন সমাদ্দারের আশ্রম মুখোমুখি। উভয় বাসার ছাদেই কবুতর লালনপালন করা হয়। ১ এপ্রিল  বিকেলে আমার ছাদ থেকে একটি কবুতর উড়ে গিয়ে আশ্রমের ছাদে অন্য কবুতরের সঙ্গে আশ্রয় নেয়। সেটি আবার আশ্রমের কর্মচারী ও এলাকার ছেলে হাকিম ফোন দিয়ে জানায়, আমরা যেন কবুতর নিয়ে আসি। সেই অনুযায়ী আমি ইফতারের পর আশ্রমে যাই। সেখানে যাওয়ার পরই আমাকে জেরা করা শুরু করে আশ্রমের কর্মচারীরা। তারা কবুতর উড়ে আশ্রমের ছাদে আসার বিষয়টি অস্বীকার করে গালমন্দ করতে থাকে।

সুজন বলেন, অথচ একটু আগেই সেখানকার হাকিম নামের আরেক কর্মচারী আমার বন্ধুকে জানায় কবুতর উড়ে এসে আশ্রমের ছাদে বসেছে। বিষয়টি নিয়ে কিছুটা কথা-কাটাকাটিও হয়। পরে আমি আশ্রমের ভেতর থেকে বের হয়ে আসতে গেটের দিকে পা বাড়াই। গেটের কাছাকাছি পৌঁছানোর পর আমাকে আশ্রমের কয়েকজন কর্মচারী টেনে ভেতরে নিয়ে যায়। শুরু করে মারধর। শুরুতে আশ্রমের কর্মচারী রাহাত, আরিফ, অমিত, দেবাশীষ পেটাতে থাকে। পরে তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় আরও কয়েকজন। লাঠি, প্লাস্টিকের পিভিসি পাইপ দিয়ে মারধরের একপর্যায়ে চিৎকার শুনে আমার মা সালেহা বেগম ছুটে আসেন। তাকেও পাইপ দিয়ে মারধর করা হয়।

“তারা সবসময়ই ১০-১৫ জন আশ্রমের ভেতরে রেডি থাকে। আমাদের যখন ভেতরে আটকে মারধর করা হচ্ছিল, তখন এলাকার এক আঙ্কেল আশ্রমের ভেতরে গিয়ে আমাদের বের করে নিয়ে আসেন। তখন মিল্টন সমাদ্দার দোতলা থেকে নেমে ৯৯৯-এ কল দিয়ে আমাকে চাঁদাবাজি মামলায় পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য তার কর্মীদের নির্দেশ দেন। বিষয়টি নিয়ে আমরাও থানায় লিখিত অভিযোগ করি। কিন্তু পুলিশ তার নাম শুনে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।”

বিষয়টি জানতে পেরে এলাকার লোকজনও জড়ো হন আশ্রমের বাইরে। আমাকে পুলিশে দিতে চাইলে সেখানে এলাকাবাসীর সঙ্গেও উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়— জানান সুজন।

মানবিক মুখোশের আড়ালে থাকা মিল্টনকে নিয়ে আরও অভিযোগের কথা জানান স্থানীয়রা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জানান, সম্প্রতি এক মাছ বিক্রেতাকেও পেটান মিল্টন। কম দামে মাছ না দেওয়ায় তাকে মারধর করা হয়। ভ্রাম্যমাণ ওই মাছবিক্রেতার দামে বনিবনা না হওয়ায় চলে যাচ্ছিলেন। তখন তাকে ভেতরে নিয়ে মারধর করা হয়।

মিল্টনের এমন পরিণতি অবশ্যম্ভাবী ছিল— উল্লেখ করে স্থানীয় এক দোকানি বলেন, মিল্টনের দুইটা রূপ। একটা রূপ, যেটা সারা দেশের মানুষ ফেসবুকে দেখেছে। আরেকটা রূপ যেটা আসল, সেটা এলাকার মানুষ দেখেছে। তার আচরণে আমরা অতিষ্ঠ ছিলাম। রোজায় যেদিন ওই বৃদ্ধ মহিলাকে মারধর করা হয়, সেদিন এলাকার সবাই একসঙ্গে আশ্রমে যায়, প্রতিবাদ জানায়। আমরা চাই সুষ্ঠু তদন্ত করে তার অপরাধগুলোর বিচার করা হোক। আর আশ্রমের দায়িত্ব সরকার নিক।

স্থানীয়রা মিল্টনের পাশাপাশি তার আশ্রমে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কর্মরত পেটোয়া বাহিনীকেও তদন্তের আওতায় আনার দাবি জানান।

নানা অপকর্মের অভিযোগে গত বুধবার (১ মে) রাতে ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ আশ্রমের চেয়ারম্যান মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ।

তার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগগুলোর অন্যতম হলো- অসহায় মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার নামে তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি করা। এমনকি তার পরিচালিত আশ্রমে তিনি যে কয়জনকে লালনপালন করছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন জায়গায় তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বলে প্রচার করেছেন। এ ছাড়াও মরদেহ দাফন করার যে হিসাব তিনি নিয়মিত দিয়ে আসছিলেন, সেখানেও বড় ধরনের গরমিলের অভিযোগ পাওয়া যায়।

বাবাকে পিটিয়ে এলাকা ছাড়েন মিল্টন

মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেপ্তারের পর তার উত্থান ও বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশীদ।

তিনি বলেন, বরিশালের উজিরপুরের মিল্টন সমাদ্দারের উত্থান নিজ বাবাকে পিটিয়ে। এ অপরাধে এলাকাবাসী তাকে বাড়িছাড়া করেন। এরপর তিনি ঢাকার শাহবাগে এসে একটি ফার্মেসিতে কাজ শুরু করেন। কিন্তু ওষুধ বিক্রির টাকা চুরি করায় সেখানেও বেশি দিন টিকতে পারেননি। এরপর মিতু হালদার নামের এক নার্সকে বিয়ে করার পর তার নতুন উদ্যোগের যাত্রা শুরু হয় জানান হারুন। বিয়ের পর ওল্ড অ্যান্ড চাইল্ড নামের একটি কেয়ার সেন্টার স্থাপনের স্বপ্ন দেখেন তারা। পরে মিরপুর এলাকায় চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার সেন্টার স্থাপন করেন। তিনি খুঁজে খুঁজে গরিব, বৃদ্ধ ও শিশুদের নিয়ে আসতেন সেখানে।

আশ্রমের ভেতর অপারেশন থিয়েটার

হারুন অর রশীদ বলেন, মিল্টন সমাদ্দারের আশ্রমের ভেতরে অপারেশন থিয়েটার থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। কিন্তু তাদের অপারেশন থিয়েটারের লাইসেন্স নেই। সেখানে অবৈধভাবে অপারেশন করা হতো।

মিল্টনের বিরুদ্ধে অজস্র অভিযোগ

পুলিশের এই অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, মিল্টনের বিরুদ্ধে আমরা অজস্র অভিযোগ পেয়েছি। তিনি বলেছেন, তার দুটি আশ্রম রয়েছে। সাভারের আশ্রমে পাঁচ থেকে সাতশ লোক রয়েছে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে ২০ থেকে ৩০ জনের বেশি লোক নেই। আমরা তাকে নিয়ে এসেছি। এ ছাড়া মিল্টনকে রিমান্ডে নিয়ে কতসংখ্যক মানুষ তার কাছে আশ্রয়ের জন্য গিয়েছিল, কতসংখ্যক মানুষ মারা গেল। তার আশ্রমে যে অপারেশন থিয়েটার রয়েছে, এর মাধ্যমে কিডনি বিক্রি করেছেন কি না, সেটাও তদন্ত করা হবে বলেও জানান ডিবি প্রধান।

সই জাল করে ডেথ সার্টিফিকেট দিতেন মিল্টন!

হারুন অর রশীদ বলেন, মিল্টন সমাদ্দার কেন ডেথ সার্টিফিকেট নিজের স্বাক্ষরে তৈরি করেছেন এবং সেখানে ডাক্তারের কোনো সিগনেচার কেন নেননি, সেগুলো খুঁজে বের করা হবে। আমরা সবকিছু তদন্ত করে পরে আপনাদের জানাব। আমরা তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ পেয়েছি, সেগুলো তদন্ত করে তাকে রিমান্ডে নিয়ে পরবর্তী বিষয়গুলো জানব।

সুনসান-নীরব মিল্টনের আশ্রমে, ঢুকতে পারছেন না কেউই

মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেপ্তারের পর একপ্রকার বন্ধ হয়ে গেছে চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ারের দরজা।

মিরপুরের দারুস সালাম এলাকার কল্যাণপুর নতুন বাজার রোডে অবস্থিত আলোচিত চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ারে প্রবেশ করে দেখা যায়, পুরো প্রতিষ্ঠান সুনসান ও নীরব। প্রধান ফটকটি বন্ধ। প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট ছাড়া বাইরের কেউই সেখানে প্রবেশ করতে পারছেন না।

প্রতিষ্ঠানটির নিরাপত্তাকর্মী রাসেল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ডিবি পুলিশ এখানে সবার জন্য প্রবেশ নিষেধ করে দিয়েছে। হারুন স্যারের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আসতে হবে। অথবা প্রশাসনসহ এখানে প্রবেশ করতে হবে। যতদিন অবধি সমস্যার সমাধান না হবে ততদিন এই নিয়মে চলবে।

আরএইচটি/ওএফএ/এসএসএইচ