ঢাকায় তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ জানাল বিআইপি
ঢাকা মহানগরীতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও তাপপ্রবাহের মূলে ভূমি আচ্ছাদনের (সবুজ, পানি ও ধূসর বা কংক্রিট আচ্ছাদন) মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট, কংক্রিটের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি। এছাড়া ভবনের নকশায় পরিবেশ ও জলবায়ুর ধারণা অনুপস্থিত, কাচ নির্মিত ভবন ও এসি নির্ভর ভবনের নকশা তৈরি। এছাড়াও খাল-পুকুর ভরাট, দখল ও ধ্বংস, সবুজ এলাকা নষ্ট করে অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ, বনায়ন না করা উল্লেখযোগ্য কারণ।
শনিবার (৪ মে) রাজধানীর বাংলামটরে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানাসের (বিআইপি) উদ্যোগে ঢাকায় তাপপ্রবাহ নগর পরিকল্পনা ও উন্নয়ন ব্যবস্থাপনার দায় ও করণীয় শীর্ষক পরিকল্পনা সংলাপে বিআইপির পক্ষ থেকে এ বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়।
বিজ্ঞাপন
সভায় বিশেষজ্ঞ বক্তারা বলেন, প্রাকৃতিকভাবেই ঢাকা শহরে কয়েক দশক আগেও নগর পরিকল্পনার মানদণ্ড অনুযায়ী পর্যাপ্ত পরিমাণ সবুজ এলাকা ও জলাশয় বিদ্যমান ছিল। বর্তমানে নগর এলাকায় সরু রাস্তার পাশেই সুউচ্চ ভবন নির্মাণ, সরকারি-বেসরকারি সংস্থাসমূহ কর্তৃক জলাশয়-জলাধার-সবুজ এলাকা ধ্বংস করা হচ্ছে। ময়লার ভাগাড়, ইটভাটা, যানবাহন ও শিল্পকারখানার ধোঁয়া থেকে সৃষ্ট বায়ু দূষণে নগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির পাশাপাশি বায়ু দূষণে সৃষ্ট অতি ক্ষুদ্র কণার কারণে নগরে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঢাকার বাতাসে উত্তাপ বাড়াচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর গ্যাস। এছাড়া ময়লার ভাগাড়, ইটভাটা, যানবাহন ও শিল্পকারখানার ধোঁয়া থেকে তৈরি হচ্ছে গ্যাস।
আরও পড়ুন
সভায় মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ইনস্টিটিউটের সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান।
তিনি বলেন, ঢাকা শহরে সবুজ যেমন কমেছে, ঠিক তেমনি গত দুই দশকে বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত ধূসর এলাকা ও কনক্রিটের পরিমাণ, যা নগর এলাকায় তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে মারাত্মক হারে। বাড়ছে আরবান হিট আইল্যান্ড এর প্রভাব। ২০১৯ সালে করা বিআইপি’র গবেষণা অনুসারে, কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকা ১৯৯৯ সালে ছিল ৬৪ দশমিক ৯৯ ভাগ, ২০০৯ সালে বেড়ে হয় ৭৭ দশমিক ১৮ ভাগ, আর ২০১৯ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৮১ দশমিক ৮২ শতাংশে।
২০২৩ সালে বিআইপি'র প্রকাশিত আরেকটি গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২৮ বছরে রাজধানী ঢাকার সবুজ এলাকা কমে মাত্র ৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে; অন্যদিকে, জলাভূমি নেমে এসেছে মাত্র ২.৯ শতাংশে। যদিও নগর পরিকল্পনার মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি আদর্শ শহরে ২৫ শতাংশ সবুজ এলাকা এবং ১০ থেকে ১৫ শতাংশ জলাশয়-জলাধার থাকার কথা।
অথচ ভবনের নকশায় প্রাকৃতিক আলো-বাতাস চলাচল ব্যহত করে দিয়ে আবদ্ধ ঘর, কাচ নির্মিত ঘর ও এসি ব্যবহারকে মাথায় রেখে ভবন নির্মাণের প্রবণতার কারণে মহানগরীতে তাপমাত্রা বাড়ছে।
বিআইপির সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে পুরো পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১ থেকে ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস বৃদ্ধির কথা বলা হলেও ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় এই তাপমাত্রা ৫ থেকে ৬ ডিগ্রি বৃদ্ধি পেয়েছে। যার মূল কারণ মূলত ঢাকা শহরের আশেপাশের প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার এবং নগরায়নের নামে চালানো ধ্বংসযজ্ঞ।
ঢাকা শহরের বায়ুর মানদণ্ড পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় অত্যন্ত নিম্নমানের মন্তব্য করেন বিআইপি-র ন্যাশনাল এন্ড ইন্টারন্যাশনাল লিঁয়াজো পরিকল্পনাবিদ মো. আবু নাইম সোহাগ। তিনি বলেন, খিলগাঁও এলাকায় যে কয়টি জলাভূমি ছিল, রাতের আঁধারে তা উন্নয়নের নামে ভরাট করা হচ্ছে। কাগজে কলমে ঢাকা শহরে যে পরিমাণ খাল অথবা জলভূমির পরিমাণ উল্লেখ করা রয়েছে বাস্তবে তার পরিসংখ্যান অত্যন্ত কম।
বিআইপির বোর্ড সদস্য (রিসার্চ এন্ড পাবলিকেশন) পরিকল্পনাবিদ হোসনেআরা নগরের সবুজ এলাকা হ্রাস ও নগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখ করে বলেন, ঢাকার তাপপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণে এবং তাপ সহনশীল নগর হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে আরবান হিট মিটিগেশন ও ম্যানেজমেন্ট কৌশল নগর পরিকল্পনায় সর্বোচ্চ বিবেচনায় আনতে হবে।
পরিকল্পনাবিদ মো. রেদওয়ানুর রহমান বলেন, ঢাকা শহরে পাঁচ থেকে দশ শতাংশ জনগণ মূলত এসি ব্যবহার করে থাকেন, যা আমাদের ঢাকা শহরের তাপমাত্রা পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ। পাশাপাশি আমাদের জলবায়ুর ক্ষতি সাধন করছে। সরকারের উচিত এ সকল বিলাসবহুল পণ্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করা এবং জনগণকে তা মানার জন্য আহ্বান জানানো।
এএসএস/এমএসএ