রেলওয়ে স্টেশনে টিকিট কাউন্টারের পাশে টাচ স্ক্রিনের একটি মেশিন। ওই স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে প্রারম্ভিক স্টেশন, যাত্রার তারিখ ও গন্তব্য স্টেশনের নাম লেখার ঘর। তারিখ ও গন্তব্যের ঘর পূরণ করে ‘সার্চ ট্রেন’ অপশনে ক্লিক করলেই দেখা মিলবে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের ট্রেনগুলোর নাম এবং আসন সংখ্যা। সেখানে ওয়েবসাইটের মতো প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে অনলাইনে পেমেন্ট করলে বের হয়ে আসবে কাঙ্ক্ষিত টিকিট। তবে এই মেশিনে নগদ টাকা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এমন টিকিট ভেন্ডিং মেশিন (টিভিএম) স্থাপন করা হয়েছে দেশের বড় কয়েকটি রেলওয়ে স্টেশনে।

রেলওয়ের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর কমলাপুর স্টেশনে চারটি, বিমানবন্দর স্টেশনে দুটি, চট্টগ্রাম স্টেশনে দুটি, সিলেট স্টেশনে একটি, কক্সবাজার স্টেশনে একটি, রাজশাহী স্টেশনে দুটি, খুলনা স্টেশনে একটি, বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম স্টেশনে একটি ও রংপুর স্টেশনে একটি ভেন্ডিং মেশিন বসানো হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরও মেশিন বসানো হবে।

স্টেশনের কাউন্টার, ওয়েবসাইট এবং মোবাইল অ্যাপের পর বাংলাদেশ রেলওয়ের নতুন সংযোজন টিভিএম। এর মাধ্যমে ওয়েবসাইট বা অ্যাপের মতোই একজন যাত্রী তার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের টিকিট সংগ্রহ করতে পারবেন। টিকিটের জন্য লেনদেন হবে অনলাইনে। এ মেশিনে লেনদেনে কিছুটা নিরাপত্তা ঝুঁকি অনুভব করছেন টিকিটপ্রত্যাশীদের কেউ কেউ।

রোববার (২১ এপ্রিল) রাজধানীর বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন ঘুরে দেখা গেছে, স্টেশনে প্রবেশের মুখেই টিকিট কাউন্টারের পাশে রয়েছে একটি টিভিএম। নতুন এই মেশিনটি দেখার জন্য অনেকে ভিড় জমিয়েছেন, আবার কেউ কেউ মেশিন থেকে টিকিট সংগ্রহের জন্য চেষ্টা করছেন। সবমিলিয়ে বিষয়টিকে দারুণ আগ্রহের সঙ্গে নিয়েছেন টিকিটপ্রত্যাশীরা।

বাংলাদেশ রেলওয়ের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, দেশের প্রধান ও বড় বড় স্টেশনগুলোতে এই টিকিট ভেন্ডিং মেশিন (টিভিএম) রাখা হবে।

টিভিএম দিয়ে রাজধানীর বিমানবন্দর স্টেশন থেকে জয়দেবপুর স্টেশন পর্যন্ত যমুনা এক্সপ্রেস (৭৪৫) ট্রেনের একটি আসন কেনেন মোতালেব হোসেন। তিনি বলেন, এই মেশিন আমাদের জন্য অনেক ভালো হয়েছে। কারণ অনেক সময় মোবাইলে ইন্টারনেট থাকে না। আবার কাউন্টারেও লম্বা লাইন থাকে। যেহেতু আমি এই মেশিন ব্যবহার করে টিকিট কীভাবে কিনতে হয় সেটা জানি, সুতরাং এটা আমার জন্য অনেক ভালো হয়েছে।

লেনদেনে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগার কথা উল্লেখ করে এ যাত্রী বলেন, এই মেশিন সবার সামনে উন্মুক্ত। তাই আমি এখানে লেনদেন করার সময় আমার গোপন নম্বরগুলো প্রবেশ করাতে অনেকটা অনিরাপদ বোধ করছি। কারণ, অনেকে আমার ব্যাংক বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের পাসওয়ার্ড জেনে যেতে পারে। মোবাইল নম্বর ট্র্যাক করতে পারে। ফলে এটা আমার জন্য নিরাপদ মনে হয়নি।

মোতালেব হোসেন বলেন, যদি এটিকে এটিএম বুথের মতো একটি নিরাপদ জায়গায় রাখা যেত যেখানে আমি ছাড়া আর কেউ ঢুকতে পারবে না ওই মুহূর্তে। তাহলে এটি আমার জন্য সবচেয়ে বেশি নিরাপদ বলে মনে হতো।

আরেক টিকিটপ্রত্যাশী নুবায়েত প্রত্যয় মেশিনে নগদ টাকা প্রবেশ করানোর সুযোগ রাখার দাবি জানান। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, যেটা আমি ঘরে বসে কিনতে পারি, সেটা আমি এখানে কেন কিনব? যদি এটিতে টাকা প্রবেশ করানো যেত মেট্রোরেলের মতো, তবে সেটি সবচেয়ে বেশি ভালো হতো। সবাই ব্যবহার করতে পারত।

আরেক টিকিটপ্রত্যাশী মোয়াজ্জেম হোসেন রতন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি তো অনলাইন বুঝি না। এই বাক্স দিয়ে কী হয়, তাও আমি জানি না। আমি তো জানি টিকিট কাটতে হয় কাউন্টারে দাঁড়িয়ে লাইন ধরে। এই বাক্স তো আমি চালাতে পারব না।

বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বেশ আলোচনা হচ্ছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে ফ্যানস ফোরাম গ্রুপে টিভিএমের একটি ছবি পোস্ট করে জুনায়েদ হোসাইন প্রবল নামের একজন লিখেছেন, ‘এই মেশিনের উপকার কী, কেউ যদি একটু বুঝিয়ে বলতেন। এই মেশিনে যদি টিকিট ক্রয় করতে আমাকে অতিরিক্ত ২০ টাকা চার্জই দেওয়া লাগে, তাহলে বাসায় বসেই তো আমরা টিকেট ক্রয় করতে পারি। স্টেশন কেন যাব?’

তিনি আরও লিখেছেন, ‘আর যদি স্টেশনেই যেতে হয়। তাহলে এই মেশিনে টিকিট ক্রয় করব কেন? ২০ টাকা কমে তো আমরা পাশে থাকা কাউন্টার থেকেই টিকিট ক্রয় করতে পারি। আমি মনে করি, এই মেশিনের সুবিধা জনগণ পেত, যদি এই মেশিন দ্বারা টিকিট ক্রয় করতে অতিরিক্ত চার্জ দেওয়া না লাগত। এই উদ্যোগ লোক দেখানো ছাড়া আর কিছুই না।’

ওই পোস্টের মন্তব্যের ঘরে আব্দুল্লাহ নোমান নামের একজন লিখেছেন, ‘টাকা দেওয়ার অপশন থাকবে এবং টিকিট নেবে। তাহলে সিস্টেমটা উপকারে আসবে।’

বিশ্বজিৎ ভৌমিক নামের একজন লিখেছেন, ‘এই মেশিন দিয়ে কমিউটার, মেইল ও লোকাল ট্রেনের টিকিট কাটতে পারলে সেটাই হবে প্রকৃত কাজ। নতুবা শুধু প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ বৈ কিছু হবে না।’

স্টেশনে রেলওয়ের টিভিএম স্থাপন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, যে লক্ষ্য সামনে নিয়ে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেটা ইতিবাচক। তবে বর্তমান সিস্টেমকে মডিফিকেশন বা ইমপ্রুভ করার দরকার আছে। টিভিএম পৃথিবীর কোথাও শুধু অনলাইন পেমেন্টের মাধ্যমে হয় না। টিভিএম থাকলে সেখানে অবশ্যই নগদ টাকা প্রবেশ করানোর ব্যবস্থা থাকতে হবে। কিন্তু এখানে নগদ টাকা প্রবেশ করানোর কোনো সুযোগ নেই। এভাবে রাখলে যে লক্ষ্য সামনে রেখে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেটি অর্জন করা যাবে না।

নিরাপত্তা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের এটিএম বুথে যেরকম ব্যবস্থা রয়েছে সেরকম ব্যবস্থা স্টেশনে থাকতে পারে। ফলে সবার সামনে লেনদেনের কোনো পিন নম্বর প্রবেশ করাতে কেউ বিচলিত হবে না। এছাড়া এটিও অনলাইন নির্ভর হওয়ায় যারা স্মার্টফোন ব্যবহার করতে পারে না, তারা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হলো। স্টেশনে এ সুবিধাটা দেওয়া হয়েছে এজন্যই যে যাদের কাছে মোবাইল নেই, স্মার্টফোন নেই তারা যেন টিকিট কাউন্টারে লাইনে না দাঁড়িয়ে এখান থেকে কাটতে পারে। এমনিতেই অভিযোগ রয়েছে, টিকিট সিস্টেম অনলাইনে করার পর অনেকে বঞ্চিত হয়েছেন। যদি নগদ টাকা দিয়ে এখান থেকে টিকিট কেনা যেত, তবে সেটি সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য হতো মানুষের কাছে। অনলাইন হওয়ায় যারা আগে সুবিধা পেয়েছে, এখনো তারাই সুবিধা পাবে। তাই এই সিস্টেমটার ইমপ্রুভমেন্টের দরকার আছে।

পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, রেলওয়ে চাইলে কন্টাক্টলেস কার্ড সিস্টেম ব্যবহার করতে পারে, মেট্রো পাসের মতো। এটি হলে সবার সামনে পিন দেওয়ার কোনো ঝামেলা থাকবে না। বিভিন্ন দেশে টিভিএমে কন্টাক্টলেস কার্ড সিস্টেম থাকে এবং নগদ টাকা প্রবেশের সুযোগ থাকে।

স্টেশনে টিভিএম মেশিন স্থাপন প্রসঙ্গে রেলওয়ের ঢাকা বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা শাহ আলম কিরণ শিশির ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঢাকা, বিমানবন্দর, ময়মনসিংহ, সিলেটসহ বড় স্টেশনগুলোতে টিভিএম দেওয়া হচ্ছে। একইসঙ্গে টিকিটের বেশি চাহিদা আছে এমন স্টেশনগুলোতেও দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনে চারটি টিভিএম ও একটি বুথ, বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে তিনটি টিভিএম ও একটি বুথ থাকছে। স্টেশনে এসে যাত্রী যেন নিজেই টিকিট কাটতে পারেন এবং অনলাইনে টাকা পরিশোধ করতে পারেন, সেজন্য এ ব্যবস্থা করা হয়েছে। যাত্রীর সুবিধার্থে এটি সবসময় খোলা থাকবে।

পেমেন্টের গোপন নম্বর প্রবেশের ক্ষেত্রে যাত্রীর অ্যাকাউন্টের নিরাপত্তার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, লাইনে কেউ থাকলে পেছনের জন তো তার সামনের মনিটর দেখতে পারবে না। এছাড়া এটার পাশে একটি বুথের মতো ব্যবস্থা থাকবে। সেখানে গেলে যাত্রীকে টিকিট কাটা থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত সবকিছু বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য একজন লোক থাকবে। শনিবার (২০ এপ্রিল) স্টেশনে টিভিএম স্থাপন করা হয়েছে, মানুষের বুঝতে একটু সময় লাগবে।

এমএইচএন/এসএসএইচ