‘দূষিত’ বরফের শরবতে প্রাণ জুড়াচ্ছেন মানুষ
রিকশার পাটাতনে কোনোরকম সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াই আনা হচ্ছে বরফের বড় খণ্ড। নামানোর সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো ভেঙে দেওয়া হচ্ছে ফিল্টারের মধ্যে। এর সঙ্গে পাশের ড্রাম থেকে মগ ভরে দেওয়া হচ্ছে পানি। সবশেষ পলিথিন থেকে বের করে হাতের মুঠোয় ভরে দেওয়া হচ্ছে চিনি-লবণ। ব্যাস তৈরি হয়ে গেল ‘দূষিত’ বরফ-পানির অস্বাস্থ্যকর শরবত। এরপর ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী লেবু অথবা ইস্পি (এক ধরনের ইনস্ট্যান্ট পাউডার) দিয়ে কাঁচের গ্লাসে এই শরবত পরিবেশন করা হচ্ছে। লেবুর শরবত প্রতিগ্লাস ১০ টাকায় আর ইস্পি মেশানো শরবত প্রতিগ্লাস ১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রচণ্ড গরমে তৃষ্ণার্ত মানুষ এই শরবত পান করেই প্রাণ জুড়াচ্ছেন। রিকশাচালক, দিনমজুর, দোকানদার, পথচারী এমনকি অনেক সচেতন মানুষকেও দেখা গেছে রাস্তার পাশের এসব শরবত পান করতে।
রোববার (২১ এপ্রিল) সকাল থেকে রাজধানীর মতিঝিল, আরামবাগ, গুলিস্তান, শাহবাগ, নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায় রাস্তার পাশে, অলিগলিতে এবং পাড়া-মহল্লায় অসংখ্য শরবতের দোকান। যার অধিকাংশই ভ্রাম্যমাণ। ছোট ভ্যানের ওপর একটি ফিলটার, লেবু, কয়েকটি গ্লাস, পানি, বিভিন্ন কোম্পানির ইনস্ট্যান্ট পাউডারের ছোট প্যাকেট দিয়েই দোকানের পসরা সাজানো হয়েছে। শরবত তৈরিতে মানা হচ্ছে না কোনো ধরনের স্বাস্থ্যবিধি। সংশ্লিষ্টরা ফিল্টারের ওপরে ঢাকনা খুলে খালি হাতেই বরফ-পানি, লেবু দিয়ে শরবত নাড়া দিচ্ছেন আবার ওই হাতেই টাকা নিচ্ছেন কিংবা অন্যান্য কাজও করছেন। যে গ্লাসে শরবত পরিবেশন করা হচ্ছে সেটি একজন পান করার পরে পাশের ছোট বালতির সাদা পানিতে ধুয়েই আবার আরেকজনকে শরবত পান করার জন্য দেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া শরবত ঠান্ডা করতে যে বরফ দেওয়া হচ্ছে সেটিও আনা হচ্ছে অস্বাস্থ্যকর উপায়ে। খালি রিকশায় কিংবা ভ্যানে ছালার চট বিছিয়ে আনা এসব বরফ কতটা স্বাস্থ্যসম্মত সে প্রশ্নের উত্তরও জানা নেই কারো। আর শরবত তৈরির জন্য যে পানি ব্যবহার করা হচ্ছে সেসব পানি দোকানিরা যার যার সুবিধা অনুযায়ী রাস্তার পাশ থেকে সংগ্রহ করছেন।
বিজ্ঞাপন
অবশ্য এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি কোনো শরবত বিক্রেতা।
সরেজমিনে ঘুরে আরও দেখা যায়, কোথাও বেলের শরবত বিক্রি করা হচ্ছে। ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে বেল আগে থেকেই ভেঙে খোলা অবস্থায় রাখা হয়েছে। ধুলোবালি পড়ে থাকা সেই বেলই কিছুসময় পর আবার শরবতে দেওয়া হচ্ছে।
তবে শরবত বিক্রেতাদের দাবি, সাধ্যের মধ্যে যতটুকু সম্ভব ভালো পানি-বরফ দিয়েই শরবত তৈরি করা হয়েছে। তারা বলেন, কমদামে এর চেয়ে ভালো সেবা আর কেউ দিতে পারবেন না। কোনো পচা বাসি জিনিস নেই। তাৎক্ষণিকভাবে সবার সামনে শরবত তৈরি করে বিক্রি করা হচ্ছে। পানি বিভিন্ন মসজিদ কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কল বা পানির টেপ থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে। দামে কম হওয়ার কারণে সবাই এই শরবত পান করতে পারছেন। এতকিছু দেখতে হলে শরবতের দাম বাড়াতে হবে। এতে গরিব মানুষেরা কষ্টে পড়বেন।
আব্দুল লতিফ নামের গুলিস্তানের এক শরবত বিক্রেতা বলেন, রোদ-গরমে শরবতের বিক্রি অনেক ভালো হচ্ছে। লেবু, ট্যাং, ইস্পি, তোকমা, রুহ আফজা, ফলসহ বিভিন্ন শরবতের দোকান এখানে রয়েছে। গরিব মানুষদের কথা চিন্তা করে ৫ টাকা থেকে শরবতের দাম শুরু করা হয়েছে। আপনার চাহিদা অনুযায়ী বানিয়ে দিতে পারব। সর্বোচ্চ ৫০ টাকা গ্লাসের শরবতও আছে। আমরা নিজেরাও তো এই শরবত খাই। খারাপ জিনিস মানুষকে খাওয়াই না।
বোরহানউদ্দিন নামের আরেক শরবত বিক্রেতা বলেন, এবার গরমের শুরু থেকেই ব্যবসা খুব ভালো। খারাপ শরবত বানাই না। সবার সামনে লেবু কেটে শরবত বানিয়ে দিচ্ছি। লেবুর শরবত ১০ টাকা, প্যাকেটজাত বিভিন্ন ফ্লেভার দিয়ে বানানো শরবত গ্লাসে ১০ টাকা আর ৫০০ মিলিলিটারের বোতলে ২০-২৫ টাকা, বেলের শরবত ২০ টাকা, তোকমার শরবত ২০ টাকা এবং ফলের মিশ্রণে তৈরি শরবত ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
মাছ সংরক্ষণের জন্য তৈরি বরফ দেওয়া হচ্ছে শরবতে
রাস্তার পাশের এসব ভ্রাম্যমাণ শরবতের দোকানে যে বরফ ব্যবহার করা হচ্ছে তার অধিকাংশই মানুষের খাবার উপযোগী নয়। বিভিন্ন বরফকল থেকে মাছ সংরক্ষণ করার জন্য তৈরি করা বরফের পাটালি পাইকারি দামে কিনে এনে শরবতে মেশান বিক্রেতারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কয়েকজন শরবত বিক্রেতা জানান, বরফকলে সাধারণত দুই ধরনের বরফ তৈরি করা হয়। একটি মাছ সংরক্ষণের জন্য। আরেকটি খাবার জন্য। এর মধ্যে মাছ সংরক্ষণের জন্য যে বরফ তৈরি করা হয় সেটির দাম তুলনামূলক কম। সেজন্য মাছ সংরক্ষণের জন্য তৈরি বড় বরফই কেনেন তারা। এক্ষেত্রে পাশাপাশি কয়েকটি দোকানের বিক্রেতারা একসাথে কিছুসময় পরপর একটি বা দুটি করে বরফের পাটালি কিনে নিয়ে আসেন। যা ভাগ করে ব্যবহার করা হয়।
স্বাস্থ্যঝুঁকি জেনেও এসব শরবত পান করছেন সাধারণ মানুষ
স্বাস্থ্যঝুঁকি জেনেও তৃষ্ণা মেটাতে অনেকটা নিরুপায় হয়েই এসব শরবত পান করছেন সাধারণ মানুষ। তারা বলছেন, গরমকে কেন্দ্র করে অধিকাংশ কোম্পানিই তাদের জুস কিংবা পানীয়ের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। সেজন্য তুলনামূলক কম দাম এবং সহজলভ্য হওয়ায় এসব শরবত মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আবার অনেক ক্ষেত্রেই দোকান থেকে কিংবা নামিদামি ব্র্যান্ডের জুস কিনে খেতে বাড়তি টাকার প্রয়োজন হয়। তাই স্বল্প আয়ের মানুষেরা গরমে স্বস্তির জন্য রাস্তার পাশের এসব শরবতেই আস্থা রাখেন।
নিউমার্কেটে সড়কের পাশের একটি দোকান থেকে শরবত পান করতে দেখা যায় রিকশাচালক নিজামুল ইসলামকে। তিনি বলেন, গরমের মধ্যে এসব শরবত খেতে ভালোই লাগে। যে রোদ পড়েছে তাতে বেশি সময় একটানা রিকশা চালানো যায় না। অল্পতেই কাহিল হয়ে যেতে হয়। লেবুর শরবত খেলে শরীরে একটু চাঙ্গাভাব আসে। বেশিক্ষণ কাজ করা যায়। আর এই শরবতের দামও কম। ২০ টাকা দিয়ে দুই গ্লাস খেলে অনেকক্ষণ শক্তি পাওয়া যায়। ভালো-মন্দের কথা কি বলবো। আমি প্রতিনিয়তই এই শরবত পান করি। এখন পর্যন্ত কিছু হয়নি।
সোলাইমান হোসেন নামের আরেক রিকশাচালক বলেন, রোদের তাপে শরীরের সব পানি বের হয়ে গেছে। লেবুর পানি পান করলে একটু ভালো লাগে। এই গরমের মধ্যে পেটের দায়েই বাইরে বের হই। আমাদের তো ভালো জুস কিনে খাওয়ার মতো পয়সা নেই। সেজন্য এই জুসই কিনে খাই। আপনিই বলেন, ঢাকায় কোথায় আমাদের খাওয়ার জন্য একটু ভালো পানি আছে? মসজিদ খোলা থাকলে তখন সেখান থেকে পানি নিতে পারি। তাছাড়া বিভিন্ন বাসা বাড়ির নিচ থেকে দারোয়ানকে বলে পানি নিতে হয়। সেজন্য কমদামে এই শরবতই ভরসা।
বোতলে ভরে শরবত নিতে দেখা যায় নাইমুল ইসলাম নামের এক শিক্ষার্থীকে। তিনি বলেন, তীব্র রোদ এবং গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা। কোচিংয়ে গিয়েছিলাম। এখন মেসে ফিরছি। সেজন্য বোতলে শরবত নিয়ে নিলাম। দামে কম আবার খেতেও মজাদার। তবে স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি ভেবে দেখিনি। আমি প্রায়ই এই দোকান থেকে শরবত নেই।
এসব শরবত পান না করার পরামর্শ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং চিকিৎসকরা বলছেন, বর্তমান এই তাপপ্রবাহের সময়ে স্বাভাবিক ও নিরাপদ খাবার পানির বিকল্প নেই। ঘরোয়া পরিবেশে তৈরি করা শরবত পান করা যেতে পারে। তবে সেটি অবশ্যই ঠান্ডা পানি ছাড়া হতে হবে। গরমে অতিরিক্ত ঠান্ডা কিংবা অনিরাপদ পানি পান করলে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়। আর বাইরের কিংবা কৃত্রিম ফ্লেভার যুক্ত শরবত থেকে দূরত্ব অবলম্বন করতে হবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে যারা বাইরে কাজ করেন বিশেষ করে শ্রমিক কিংবা রিকশা চালকদের সবচেয়ে বেশি ডিহাইড্রেশন (পানি শূন্যতা) তৈরি হচ্ছে। এক্ষেত্রে একটানা অনেকক্ষণ রোদের মধ্যে না থেকে কিছুটা সময় নিয়ে কিংবা ছায়াযুক্ত স্থানে বিশ্রাম নিয়ে কাজ করতে হবে। আর প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ খাবার পানি পান করতে হবে। ভেজাল পানি নয়।
এই চিকিৎসক আরো বলেন, অনেকেই রাস্তার পাশে বিভিন্ন শরবত পান করে থাকেন। এটি ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে। শরবত পান করতে হলে ঘরের মধ্যে নিজেরা তৈরি করে পান করবেন। আবার বাচ্চাদের দিকেও বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে। এই সময় যেন তারা বাইরে খাবার না খায়।
আবার রাস্তার পাশের এসব পানীয় মানুষের মৃত্যুঝুঁকি তৈরি করতে পারে বলেও মন্তব্য করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী। তিনি বলেন, শরবত বিক্রেতারা সরাসরি ওয়াসার পানি জারে ঢুকিয়ে ফিলটারের পানি বলে ব্যবহার করছেন। অথচ এগুলোর মানও ভালো না। অনিরাপদ পানি বা বরফ দিয়ে বানানো শরবতগুলো খাওয়ার ফলে পানিবাহিত রোগ টাইফয়েড, জন্ডিস, হেপাটাইটিসের মতো রোগগুলো ছড়াচ্ছে। আবার ফুড পয়জনিং, বমিসহ নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। গরমের সময় ঢাকায় এই অসুখগুলো বেড়ে যায়। এখন যেহেতু তাপপ্রবাহ হচ্ছে সেজন্য আরও বেশি সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। তাই পথের পাশের এসব শরবত বা পানীয় পান না করার পরামর্শও দিয়েছেন তিনি।
দোকানগুলোতেও চাহিদা বেড়েছে জুস, লাচ্ছি, ঠান্ডা পানীয়ের
চলমান তাপপ্রবাহে অত্যধিক গরম এবং রোদের কারণে চাহিদা বেড়েছে দেশীয় বিভিন্ন জুস ও পানীয়ের। এর পাশাপাশি সাধারণ পানির চাহিদাও অনেক বেশি। কনফেকশনারি, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর কিংবা ছোট-বড় সব দোকানেই বিভিন্ন জুস, পানি, মাঠা, লাচ্ছির জন্য মানুষকে ভিড় করতে দেখা গেছে।
আরএইচটি/জেডএস