সাভারের আশুলিয়া এলাকার একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করেন দিনাজপুরের শাকিল মাহমুদ। আরেকটি কারখানায় চাকরি করেন তার স্ত্রী। ঈদে বাড়ি যেতে সোমবার দিবাগত রাত ৪টায় অন্যদের সঙ্গে মাইক্রোবাসে ওঠেন তারা। শুধু চন্দ্রা এলাকা পার হতেই তাদের লেগে যায় ১২ ঘণ্টা।

শাকিল মাহমুদ বলেন, উত্তরবঙ্গের মানুষ যারা জীবিকার তাগিদে এদিকে থাকি, চাইলেও সবসময় বাড়ি যেতে পারি না। ঈদটা আমাদের কাছে অনেক আবেগের। কিন্তু প্রত্যেকবার বাড়ি যেতে যানজটের কারণে সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হয়।

শুধু শাকিলের পরিবারই নয়, হাজার হাজার পরিবারকে সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টা মহাসড়কে অসহনীয় ভোগান্তি-বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। এই ভোগান্তির পেছনে মূল কারণ ছিল বঙ্গবন্ধু সেতুতে এবং আরও কয়েকটি স্থানে কয়েকটি যানবাহন বিকল হয়ে পড়া। ফিটনেসবিহীন এসব যান অন্য সবার দুর্ভোগের কারণ হয়।

অথচ ঈদের আগে সমন্বয় সভা ডেকে গণমাধ্যমকে পরিবহন মালিক, শ্রমিক ও হাইওয়ে পুলিশ দিয়েছিলেন নানা প্রতিশ্রুতি আর আশার বাণী। বলেছিলেন ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে সব ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বলা হয়েছিল ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় নামতে দেওয়া হবে না।

গত ১৯ মার্চ অনুষ্ঠিত এক সমন্বয় সভায় যানজট বা ব্লক তৈরি হতে পারে এমন এলাকা চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে ড্রোনে হাইওয়েতে নজরদারি চালানোর কথা বলেছিলেন সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মসিউর রহমান রাঙ্গা। বলেছিলেন ত্রুটিপূর্ণ কোনো যানবাহন যাতে সড়কে না নামে সেটি নিশ্চিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

হাইওয়ে পুলিশের অ্যাডিশনাল আইজিপি মো. শাহাবুদ্দিন খান হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন, এবারের ঈদযাত্রায় কোনোভাবেই ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন চলতে দেওয়া হবে না।

কিন্তু ঈদযাত্রায় প্রথম ২-৩ দিন মহাসড়কের অবস্থা স্বাভাবিক থাকলেও ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় পরিস্থিতি। যানবাহনের চাপ ও সংখ্যা যত বাড়তে থাকে, মহাসড়কের জট ততই বাড়ে। যানজটে অসহনীয় ভোগান্তিতে পড়েন বাড়িমুখো মানুষ। বিশেষ করে চন্দ্রা, টাঙ্গাইল ও যমুনা সেতুর উপরে বেশ কয়েকটি যানবাহন বিকল হয়ে পড়ায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভুগতে হয় যাত্রীদের।

এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতির ড্রোন টোটকা কিংবা ফিটনেসবিহীন যানবাহনের বিষয়ে হাইওয়ে ‍পুলিশের হুঁশিয়ারি গেল কোথায়?

জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মসিউর রহমান রাঙ্গা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ফিটনেসবিহীন যানবাহন আমরা কেন নামাব? আমরা তো বলেছি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন যদি রাস্তায় নামে বা ঈদে নামানো হয় তাহলে যেন জব্দ করা হয়। তারা (পুলিশ) ডাম্পিং করুক। তারা কেন ডাম্পিং করল না, আমরা তো করতে পারি না। এটা তারা কেন করল না?

ঈদযাত্রায় উত্তরবঙ্গের মানুষকে প্রতিবছরই ভুগতে হচ্ছে। প্রতিশ্রুতি দেন, বাস্তবায়ন হয় না। কারণ কী? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হঠাৎ করে উত্তরবঙ্গ রুটে যাত্রী বেড়ে গেছে। গাড়িও বেড়েছে। যে কারণে সমস্যা তৈরি হয়। এবার কয়েকটি যানবাহন রাস্তায় বিকল হয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে যায়।

ফিটনেসবিহীন যানবাহন যাতে রাস্তায় না নামে সেজন্য তো আপনি নির্দেশনা দিয়েছিলেন, তাহলে নামাল কারা? এমন প্রশ্নের উত্তরে রাঙ্গা বলেন, ফিটনেসবিহীন যানবাহন আটকানোর লোকবল তো আমাদের নেই। কিন্তু সরকারের আছে। সরকারের এত সৈন্য-সামন্ত, পুলিশ, আনসার, বিজিবি যদি ঈদের সময় কাজে না লাগায় কখন লাগাবে। পুরো বিশ্ব কাজে লাগাচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ায় ঈদযাত্রায় ফ্রি সার্ভিস দেয় সরকার। সে রকম দেশ আমরা কেন হতে পারি না?

বাংলাদেশ কেন পারছে না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বড় বড় লেকচার দিলে তো হবে না। কাজের কাজটা করতে হবে। শুধু বলবেন লক্কড়-ঝক্কড় বাস চলে। আরে ভাই পয়সাটা কই, পয়সা তো থাকতে হবে। বিআরটিসি সরকার চালায়। বছর বছর কেন কোটি কোটি টাকা লস দেয় সরকার? কিন্তু আমাদের তো মালিকরা নিজেরা পকেট থেকে খরচ করি।

ফিটনেসবিহীন যানবাহনের চলাচল তবে ঠেকাবে কারা? মহাসড়কে ড্রোন টোটকাও গেল কই? জবাবে তিনি বলেন, আমরা তো বলিনি ঈদে বাস বন্ধ করে দেব। আমরা বলেছি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলবে না। তবে যেসব গাড়ির কাগজপত্র ঠিক আছে সেগুলো যেন চলতে দেওয়া হয়। আর আমাদের তো নিজস্ব ড্রোন নেই। বলেছিলাম, সেটা আমরা কিনতে পারিনি। কেনার সুযোগও নেই। ড্রোন কিনলে নাকি আমাদের ক্রাইম হবে। ড্রোন আছে হাইওয়ে পুলিশের। সেটা তাদের ভালোভাবে ব্যবহার করার সুযোগ ছিল।

ঈদযাত্রায় যানজটের কারণে ভোগান্তি হওয়ায় সবার কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে রাঙ্গা বলেন, আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত, লজ্জিত। এবারেই শেষ। আমি মনে করি আগামী কোরবানির ঈদ বা পরের ঈদ থেকে সড়কের চিত্র বদলে যাবে। ভোগান্তির দায় অন্য কাউকে না দিয়ে নিজেদের ঘাড়েই নিচ্ছি।

ফিটনেসবিহীন যানবাহন কেন ঠেকানো গেল না? এমন প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত ডিআইজি (অপস অ্যান্ড ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট) শ্যামল কুমার মুখার্জী ঢাকা পোস্টকে বলেন, উত্তরটা সবারই জানা। আপনিও জানেন। আমাদের গাড়ির সংখ্যা আসলে কত? ঈদের সময় বাসের চাহিদা কত? ঈদের সময় গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য মহাসড়কে আসলে কী পরিমাণ যাত্রী থাকে? আউটগোয়িং প্যাসেঞ্জার যদি এক কোটি হয় তাহলে এর বিপরীতে আমাদের গাড়ির সংখ্যা কত? চাহিদা অনুযায়ী আমাদের সে পরিমাণ যানবাহন আদৌ কি আছে?

তিনি বলেন, পরিসংখ্যান লাগবে না, অনুমান থেকেও যদি বলি তাহলে আউটগোয়িং প্যাসেঞ্জারের সংখ্যা বেশি তাহলে এই মানুষগুলো ঈদে কীভাবে বাড়ি যাবে? ম্যানেজেবল হয় তখনই যখন আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান বা তথ্য থাকে। যদি আগে জানা যেত ৮ বা ৯ তারিখ এত যাত্রী নির্দিষ্ট এই সময়ে বের হবে। সেজন্য এই পরিমাণ ট্রান্সপোর্ট দরকার। তখন বোঝা যেত ম্যানেজ করা সম্ভব কি অসম্ভব।

তিনি বলেন, মানুষ ঈদে বাড়ি যাওয়ার জন্য উন্মুখ থাকেন। তাদের আবেগের কাছে আমাদের কোনো পরিকল্পনা শতভাগ সফল হচ্ছে না৷ কারণ আমাদের ব্যবস্থা ততটুকু, যতটুকু রোড ও গাড়ি আছে। যদি কোনো যাত্রীকে জিজ্ঞেস করা হয়, কেন ঝুঁকি নিচ্ছেন? তখন তারা বলেন, আমার বাড়ি যেতেই হবে। এসব ঝুঁকি দেখার সময় নেই। আবার এটাও সত্য, আমরাও ঈদযাত্রার যাত্রীদের নিরাপদে গন্তব্য পৌঁছাতে নিরাপদ যানবাহন দিতে পারিনি।

তিনি বলেন, যারা বাড়ি যান তাদের যেমন সচেতনতা-সতর্কতার অভাব রয়েছে, তেমনি বাস্তবতার নিরিখে তাদের জন্য যে সাপোর্টটা দরকার সেটা এখনো রেডি নয়। পুরো ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা কিন্তু সে রকমই।

এ অবস্থায় হাইওয়ে পুলিশের দায়িত্বটা কী? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমরা চিন্তা করি যাত্রীরা যেন নিরাপদে গন্তব্যে বা বাড়িতে ফিরতে পারে; পরিবার ও স্বজনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারে।

বঙ্গবন্ধু সেতুতে বেশ কয়েকটি যানবাহন বিকল হওয়ার কারণেই উত্তরবঙ্গের যাত্রীদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেতুর উপরে ম্যানেজমেন্ট সেতু কর্তৃপক্ষের। যানবাহন বিকল হওয়ার পর সেটা যত দ্রুত সম্ভব অপসারণ করার দায়িত্ব ছিল তাদের।  

যানবাহনের অভাব নাকি পর্যাপ্ত মানসম্পন্ন যানবাহনের অভাব? কোনটাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে হাইওয়ে পুলিশ? হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও কিন্তু আমরা ঈদ যাত্রায় ফিটনেসবিহীন যানবাহন মহাসড়কে দেখছি-- এসব ব্যাপারে তিনি বলেন, পর্যাপ্ত যানবাহনের চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ ভালো মানের বা মানসম্পন্ন যানবাহন দরকার। গত কয়েক বছরে সড়কের প্রশস্ততা বেড়েছে, লেনসহ মান বেড়েছে৷ সে তুলনায় চলাচলকারী যানবাহনের যে কোয়ালিটি হওয়া উচিত সেটা হয়নি। বঙ্গবন্ধু সেতুর উপরে যদি একটি যানবাহন বিকল না হয়ে পড়ত তাহলে এই ভোগান্তির দৃশ্য হয়ত নাও দেখতে পেতাম।

ঈদের সময় হাইওয়ে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে রাঙ্গার প্রশ্নের উত্তর সম্পর্কে জানতে চাইলে অতিরিক্ত ডিআইজি শ্যামল কুমার মুখার্জী বলেন, দুই ধরনের ফিটনেস লাগে। একটা কাগজের, অন্যটি যানবাহনের বডি ফিটনেসের। দুটোই দরকার পড়ে। যখন নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে থেকে বলে দেওয়া হলো এ ধরনের কোনো একটি ফিটনেসের অভাব থাকলে সে যানবাহন যেন রাস্তায় নামানো না হয়। তখন প্রাথমিক দায়িত্বটি আসলে কার? যিনি যানবাহনের মালিক তারই তো হওয়া উচিত৷

শ্যামল কুমার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, রাষ্ট্র আইন করে দিয়েছে, সেটি মানার দায়িত্ব আমাদের। আইন করাই হয়েছে মেনে চলার জন্য, বাধ্য করার জন্য নয়। গাড়ির ফিটনেসের ক্ষেত্রে সেটি আমরা দেখছি না। আসলে সবাই নিজের দায়িত্বটা পালন করলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

জেইউ/এসকেডি