নির্বাচন এলে উদার হয়ে যান রাজনৈতিক নেতারা। খোলা হস্তে কাপড়চোপড়, বিভিন্ন সামগ্রী, বকশিশ বা ‘ভালোবাসার’ উপহার বিলি করেন। ভোটারদের কাছে টানতে নানা কৌশল খাটান তারা। ঈদ-পরবর্তী নির্বাচন হলে তো রমজানে রীতিমতো উপহার বিলির ধুম পড়ে যায়। পদ প্রত্যাশীরা নিজেদের ‘জনতার সেবক’ প্রমাণ করতে দানবীর মহসীনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।

কিছুদিন আগে জাতীয় নির্বাচন শেষ হয়েছে, চট্টগ্রামে ঈদ-পরবর্তী কোনো নির্বাচন নেই। তাই এবার ঈদ উপহার বিতরণও তেমন চোখে পড়ছে না। প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নেতারাও সেটি স্বীকার করেছেন।

নগরীর বায়েজিদ, বাকলিয়া, চকবাজার ও বহদ্দারহাট এলাকার নিম্ন আয়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলেছে এই প্রতিবেদক। তারা জানান, নির্বাচন এলে উপহার বেশি পান। এবছর তাদের খবর কেউ নিচ্ছেন না।

নগরবাসী বলছে, নির্বাচন কেন্দ্রিক পদ প্রত্যাশীরা সক্রিয় হন। নিজেদের অবস্থান জানান দিতে নানাভাবে মানুষের পাশে থাকার কথা বলেন। ভোটারদের মন জয় করতে নগদ টাকা, বিভিন্ন সামগ্রী উপহার দেন তারা। এবার ঈদের পরিস্থিতি ভিন্ন। নিকটবর্তী সময়ে কোনো নির্বাচন নেই, তাই নেতাদের দেখা যাচ্ছে না।

চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপি সূত্র বলছে, সরকারের দমনপীড়ন, মামলা-হামলায় বিপর্যস্ত হয়েছে তাদের জীবন। এসব কারণে তাদের অনেকে স্বাচ্ছন্দ্যে ঈদ পালনের সামর্থ্য হারিয়েছেন। তবুও তারা মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন।

আওয়ামী লীগ সূত্র বলছে, নির্বাচন কেন্দ্রিক দলীয় মনোনয়ন ভাগিয়ে নিতে অনেকে নানাভাবে শো-অফ করেন। এবার নির্বাচন ও কমিটি হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তাই তারা শো-অফ করছেন না। তাদের মতে, প্রকৃত আওয়ামী লীগ নেতারা সামর্থ্য অনুযায়ী মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন।

তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনের নেতারা অন্যবারের চেয়ে নিষ্ক্রিয় কেন– এ প্রশ্নে দুটি বিষয় সামনে এসেছে। সেগুলো হলো– প্রথমত নির্বাচন নেই, দ্বিতীয়ত অঙ্গ সংগঠনের কমিটি গঠনের সম্ভাবনা নেই।

চট্টগ্রাম নগরীর ৪১ ওয়ার্ডেই শুধু কাউন্সিলর প্রার্থী থাকে দুই শতাধিক। তারা নির্বাচন এলে মাঠে দাপিয়ে বেড়ান, ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যান। ঈদে প্রতিযোগিতা করে উপহার বিতরণ করেন।

এ ছাড়া ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠনের কমিটিতে বড় পদ পেতেও একই প্রতিযোগিতা চলে। কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে ‘ক্লিন ইমেজ’ ও নিজেদের অবস্থান জানান দিতে উপহার বিতরণসহ নানা পন্থা অবলম্বন করে চলেন তারা। কিন্তু এবার ঈদে তেমন কোনো পরিবেশ তৈরি হয়নি। যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের কমিটি হয়েছে, তবে এখনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি। তাই কমিটি ভাঙার বিষয়ে সেফ জোনে আছেন তারা। আবার ছাত্রলীগের কমিটি হওয়ার তোড়জোড় চললেও বড় পরিসরে উপহার বিলি করার মতো সামর্থ্য তাদের নেই। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন হবে আরও প্রায় দুই বছর পরে। এসব কারণে নেতাদের ‘হাত বন্ধ’ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

অন্যদিকে জনপ্রতিনিধি ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের বিভিন্ন উপহার সামগ্রী বিতরণ করতে দেখা গেলেও তা অন্য বছরের তুলনায় অনেক কম। আবার বিএনপির নেতারাও তাদের কর্মীদের মধ্যে নগদ টাকা ও উপহার সামগ্রী বিতরণ করছেন। কিন্তু উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অসচ্ছল সাধারণ মানুষের পাশে দেখা যাচ্ছে না রাজনৈতিক নেতাদের।

নির্বাচন ছাড়া মানুষের পাশে দাঁড়ানোর তৎপরতা কমার ব্যাপারে একমত চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান।

দীর্ঘদিন ধরে বিরোধী দলীয় রাজনীতিতে সক্রিয় থাকা এ নেতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের আমলে আমাদের কর্মীদের ওপর নানাভাবে মামলা-হামলা হচ্ছে। নির্যাতনের কারণে অনেক নেতাকর্মী পরিবার নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে ঈদ করার সামর্থ্যও হারিয়েছেন। নেতাকর্মীদের ব্যবসা-বাণিজ্যেও নানা হয়রানি করছে সরকার। এসবের প্রভাব পড়েছে। তবুও আমরা সামর্থ্য অনুযায়ী মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছি।’

এবার ঈদে নিম্নবিত্তের পাশে দাঁড়ানোর বিষয়ে চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. দিদারুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এটি সত্য যে অন্য বছরের চেয়ে এখন উপহার কম বিতরণ হচ্ছে। অনেকে ভোট বা কমিটি নিয়ে উদ্দেশ্য হাসিল করতে মাঠে শো-অফ করেন। কে কত টাকা দিচ্ছে তা নিয়ে তাদের প্রতিযোগিতা হয়। যুবলীগের কমিটিতে অনেক পদ প্রত্যাশীও একইভাবে মাঠে ছিল। এখন কমিটি হয়ে গেছে, তারাও মাঠে নেই। কিন্তু সামর্থ্য অনুযায়ী আমরা মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছি। আজও ৪১নং ওয়ার্ডে উপহার সামগ্রী বিতরণ আছে, আমি এখন সেখানে যাচ্ছি।’

নগরীর ষোলশহর এলাকার টংয়ের দোকানি মহসীন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘অন্য বছর নিম্নবিত্ত পরিবারের মধ্যে অনেককে ইফতার সামগ্রী ও ঈদ উপহার বিতরণ করতে দেখা যেত। এবছর সেভাবে দেখা যাচ্ছে না।’

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে তিন সদস্যের পরিবার চালাতে বেকায়দায় পড়তে হচ্ছে  চকবাজারের কালাম কলোনির বাসিন্দা শফিকুল আলমকে। পেশায় রিকশাচালক শফিক বলেন, ‘গত বছর রমজানে টাকা ও লুঙ্গি পেয়েছিলাম। এবার কিছুই পেলাম না।’

আরএমএন/এসএসএইচ