গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সুরক্ষা একে অন্যের পরিপূরক
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, মানবাধিকার বিষয়টি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গণমাধ্যমের নিত্য চর্চার বিষয়। এ কারণে গণমাধ্যম ও মানবাধিকার কর্মীদের কাজ সমমুখী। বৈশ্বিক শান্তি, সহাবস্থান, সহযোগিতা ও সর্বাত্মক কল্যাণের জন্যই যথার্থ মানবাধিকার চর্চা প্রয়োজন। মুক্ত গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সুরক্ষা একে অন্যের পরিপূরক।
মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) বিকেলে হোটেল সোনারগাঁওয়ে মানবাধিকার বিষয়ক বিটে দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংবাদিকের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত ‘মানবাধিকার সুরক্ষা ও উন্নয়ন’ বিষয়ক মতবিনিময় সভায় এ কথা বলেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
মতবিনিময় সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পরিপ্রেক্ষিতের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ বোরহান কবীর। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন ইউএনডিপির বাংলাদেশের সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি আনোয়ারুল হক ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত। সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সচিব সেবাষ্টিন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বিষয়ক উপস্থাপনা করেন পরিচালক কাজী আরফান আশিক।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষায় কমিশন নিবিড়ভাবে কাজ করে থাকে। এ পর্যন্ত দেশের যে প্রান্তেই সাংবাদিক আক্রান্ত হয়েছেন, কমিশন সাথে সাথেই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, গণমাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে মানবাধিকার কমিশন আরও বেশি জোরালো পদক্ষেপ নেবে। মানবাধিকার কমিশন কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকারকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ দিচ্ছি। যেকোনো তথ্য চাইলে তা আমরা সরবরাহে সর্বোচ্চ চেষ্টা করি। সাংবাদিকদের ওপর হামলা নির্যাতন ও মামলায় আমরা সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছি। কথা বলেছি। সত্যের সন্ধানে কাজ করা সাংবাদিক গোলাম রব্বানীকে টার্গেট করেছিল ইউনিয়ন চেয়ারম্যান। যিনি একটি পার্টিরও নেতা। তখন সাংবাদিক ও কমিশনের জোরালো ভূমিকার কারণে আসামি ধরা পড়েছে।
দেশের স্বাস্থ্যখাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনা বেশি ঘটছে বলে মন্তব্য করে ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, স্বাস্থ্যখাত ও এর সেবা নিম্নমুখী মানে পৌঁছেছে, শত শত হসপিটালের কোনো লাইসেন্স নেই। এর দায়িত্বে যারা রয়েছেন, তারা আখের গোছানোর চেষ্টায় আছেন, কাজের কাজটা করছেন না। যে কারণে বেআইনিভাবে ও অননুমোদিতভাবে স্বাস্থ্যসেবা চলছে। এখানে গণমাধ্যম কর্মীদের মানবাধিকারের জায়গা থেকে কাজ করার বড় সুযোগ রয়েছে।
বেইলি রোডের আগুনের প্রসঙ্গ টেনে মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান বলেন, বেইলি রোডে আগুনের ঘটনার পর আমরা কী দেখলাম! আট শতাধিক লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার কাদের করা হয়েছে? যে রান্নার কাজ করে, শ্রমিক, হোটেল রেস্তরাঁর সহযোগী তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যার কোনো দায়িত্ব নেই লাইসেন্স দেখার, যে সব শর্তে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল... সেগুলো মানা হয়েছিল কি-না তা যারা দেখে তাদের কিন্তু গ্রেপ্তার করা হয়নি। এসব কিন্তু কোনো চ্যানেলে বা পত্রিকায় আমরা দেখছি না। প্রতিটি সেবাখাতে জবাবদিহিতার সমস্যা রয়েছে। নানা ঘটনায় যারা জড়িত বা দায় রয়েছে, তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়নি।
মানবাধিকার কমিশনের কার্যক্রমের বিভিন্ন পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি বলেন, মানবাধিকার কমিশনের সিদ্ধান্ত যে কাজে আসে না তা নয়। গত বছরের জুলাই-ডিসেম্বর পর্যন্ত মানবাধিকার কমিশনে মোট অভিযোগ এসেছিল ২৮২টি। এর মধ্যে তদন্ত চলমান ১২৯টির। ১৩০টি অভিযোগের নিষ্পত্তি করা হয়েছে, ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, অত্যন্ত নিষ্ঠুরতার মধ্য দিয়ে বিশ্বে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। অনেকে ইনিয়েবিনিয়ে বলছেন, পদে পদে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। অথচ গাজায় হাজার হাজার মানুষ হামলায় মরে গেলেও সেটি নিয়ে কেউ কথা বলছে না।
কমিশনের সার্বক্ষণিক সদস্য মো. সেলিম রেজা বলেন, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে সাংবাদিকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে শহীদুল্লাহ কায়সার, শহীদ সাবের, সিরাজুদ্দীন আহমেদ ও সেলিনা পারভীনসহ অগণিত সাংবাদিক প্রাণ দিয়েছেন। আমরা তাদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি।
সুয়োমটো অভিযোগের পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেন, পত্রপত্রিকায় উঠে আসা খবরের সূত্র ধরে মানবাধিকার কমিশনের মাধ্যমে সপ্রণোদিতভাবে ৫১টি ঘটনায় সুয়োমটো দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১২টি ঘটনা নিষ্পত্তি হয়েছে। ৩৯টি ঘটনার তদন্ত এখনো চলমান। বাল্যবিবাহ নিয়ে আমরা জোরালোভাবে কাজ করছি। নারী নির্যাতন ও দারিদ্র বিমোচন নিয়ে সোচ্চার ভূমিকা পালন করতে হবে। সত্যিকার অর্থে আমরা গণমাধ্যমের সঙ্গে কমিশনের যোগাযোগ বৃদ্ধির সর্বাত্মক চেষ্টা করব। কারণ গণমাধ্যম ছাড়া মানবাধিকারের সুরক্ষা সম্ভব না।
সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপক সৈয়দ বোরহান কবীর বলেন, মানবাধিকার সুরক্ষায় সবচেয়ে বড় অস্ত্র হচ্ছে জনগণ। যে দেশে জনগণ মানবাধিকারের প্রশ্নে যতটা সচেতন, সেই দেশ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও সুরক্ষায় ততো এগিয়ে। বিশ্বের সব মহান ও জনপ্রিয় নেতাই ছিলেন মানবাধিকারের পক্ষে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আব্রাহাম লিংকন ও নেলসন মেন্ডেলা কিংবা মহাত্মা গান্ধী তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, গণমাধ্যম ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কীভাবে এক হয়ে কাজ করলে গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে, সে বিষয়ে আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ, আমরা পারস্পরিক সম্পর্ক কীভাবে নির্মাণ করতে পারি সে বিষয়ে আমাদের ভাবতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে মাত্র নয় মাসে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। আবার ৭৫ এর আগস্টে জাতির পিতাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। এ ঘটনাগুলো ইতিহাসে বর্বরোচিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের দৃষ্টান্ত।
সভায় মানবাধিকারের বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ, সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও আইনি সুরক্ষা, গণমাধ্যম কর্মীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়ে আলোচনা করা হয়। পাশাপাশি বক্তারা জনগণের মাঝে অধিকার সচেতনতা বৃদ্ধি, সংবিধান, আইন ও অধিকার সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় জ্ঞানের প্রসারে গণমাধ্যমকে সার্বিক উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান। মতবিনিময় সভায় একটি উন্মুক্ত আলোচনায় সাংবাদিকরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে নিজ নিজ মন্তব্য উপস্থাপন করেন।
জেইউ/কেএ