টোলপ্লাজায় ‘ধীরগতি’ সড়কে চাপ বাড়াচ্ছে
রমজানে নগরবাসীকে স্বস্তি দিতে কী করেনি ট্রাফিক পুলিশ। সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। রোস্টার ডিউটি বাতিল, বিকেলে সড়কে ডিউটি বাড়ানোর পাশাপাশি সড়কে পুলিশ সদস্যদের ইফতারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, সড়কে কাটাছেঁড়া বন্ধে সিটি কর্পোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে চিঠি দিয়েছে, সমন্বয় সভাও করেছে। কিন্তু ইফতারের আগে ঠিকই সড়ক হয়ে পড়ছে বেসামাল।
ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রমজানকে টার্গেট করে রমজানের আগে থেকেই ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা কঠোর করার নির্দেশনা দেন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান। যেকোনো মূল্যে রমজানে নগরবাসীকে যানজটের ভোগান্তি থেকে রেহাই দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
নির্দেশনা অনুযায়ী, রমজান শুরুর এক সপ্তাহ আগে থেকে প্রথম রমজান পর্যন্ত ভালোই যায় সড়কের অবস্থা। তবে দ্বিতীয় রমজানেই বাড়তে থাকে চাপ। দ্বিতীয় রমজানের যানজটের কারণ খুঁজতে গিয়ে ট্রাফিক পুলিশ আবিষ্কার করে রাজধানীতে চালু করা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ধীরগতির গাড়ির পাসিং। মিনিটে মাত্র ৬০টি করে গাড়ি পার হওয়ার কারণে এর প্রভাব পড়ছে আউটগোয়িং বা ঘরমুখো সড়কে। যার খেসারত যানজট।
মাঠ পর্যায়ের ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা বলছেন, ট্রাফিক বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও এবার সড়কে দাঁড়িয়ে যানজট সহনশীল করার চেষ্টা করছেন। সকালে চাপ থাকে, সেটা সামলানো যাচ্ছে। এরপর দিনভর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বা স্বাভাবিক থাকলেও বিকেল ৪টার পর থেকে বেসামাল অবস্থা তৈরি হয়।
রমনা এলাকার মাঠ পর্যায়ের এক ট্রাফিক সদস্য ঢাকা পোস্টকে বলেন, সামনে যদি গাড়ি না যায়, পেছন থেকে হর্ন দিয়ে কোনো লাভ নেই। বরং পরিস্থিতি নিমেষেই অস্বাভাবিক করে তোলে। দ্রুত যানজট পেছনে পৌঁছে যায় ইন্টারকানেকশনের সড়কগুলোতেও। সিনিয়র কর্মকর্তারা চেষ্টা করছেন ইউটার্ন করে হলেও সড়ক সচল রাখার। সচল সড়ককে যেন অবৈধ পার্কিং অচল করতে না পরে সেদিকেও বাড়তি সতর্কতা রাখা হয়েছে। তারপরও বিকেলটা কষ্টের।
রমজানে অফিসের সময়সূচি বদলেছে, অফিস থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা যেন বাসায় গিয়ে প্রিয়জনের সঙ্গে ইফতার করতে পারেন সে লক্ষ্য ট্রাফিক পুলিশের পাশাপাশি ক্রাইম বিভাগও কাজ করছে সড়কে। বিশেষ করে বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত সড়কে পুলিশের বাড়তি নজর থাকে বলে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
রোববার (৩১ মার্চ) সকাল থেকে সড়কে ট্রাফিক বিভাগের বাড়তি চেষ্টা লক্ষ্য করা গেছে। যার ফলে দিনভর সড়ক সচল ছিল। সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে চাপ তৈরি হয়েছে। তবে যানজট তৈরির আগেই সেটা আবার স্বাভাবিক হয়েছে। তবে বিকেল গড়াতেই চিত্র একদম উল্টো, যানজট যেন অবধারিত। এ অবস্থায় যানজটকে সহনশীল মাত্রায় নেওয়ার চেষ্টার কথাই বলছিলেন মাঠ পর্যায়ের ট্রাফিক কর্মকর্তারা।
সরেজমিনে দেখা যায়, কাকরাইল, মৎস্যভবন, শাহবাগ, প্রেস ক্লাব, পল্টন, মগবাজার, মগবাজার ফ্লাইওভার, বিজয় সরণি, শেরেবাংলা নগর এলাকায় প্রচন্ড গাড়ির চাপ। এ চাপের নেপথ্যে বড় কারণ তেজগাঁও ফ্লাইওভারের পাশে চালু হওয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোলপ্লাজা। চালু করা নতুন এ লেনের চাপ তেজগাঁও ফ্লাইওভার শুধু নয়, মগবাজার ছাপিয়ে কাকরাইল পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ট্রাফিক তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার মোস্তাক আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিকেলে সড়কে যে অবস্থা তৈরি হচ্ছে এটাকে আমি যানজট না বলে বলতে পারি চাপ। অফিস ছুটির পর সব মানুষ একসঙ্গে সড়কে নামছে। যার চাপ সড়কের আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে। এরপর রাজধানীর সড়কগুলো যে ধরনের, তার ইন্টারসেকশনগুলো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বাধ্য হয়ে চাপের সময় ম্যানুয়ালি ইন্টারসেকশন সচল রাখতে হচ্ছে।
ম্যানুয়ালি হলেও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোলপ্লাজা সচল করার অনুরোধ ডিএমপির
মোস্তাক আহমেদ বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোলপ্লাজায় ধীরগতিতে গাড়ি পাসিং হচ্ছে। যার প্রভাবে সড়কে অনেকদূর পর্যন্ত চাপ বাড়ছে। কারণ টোলপ্লাজায় ঢোকার জন্য তেজগাঁও ফ্লাইওভারের উপরে আলাদা লেন করা হয়েছে। সেই লেন বিকেল থেকেই স্থবির হয়ে পড়ছে। বিষয়টি শনাক্ত করার পর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কর্তৃপক্ষকে ডিএমপির পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। বিকেলে অন্তত ম্যানুয়ালি হলেও যেন টোলপ্লাজা সচল রাখা হয়, গাড়ির চাপ যেন যানজটে রূপ না নেয়। যদিও তারা এখনো সে ধরনের কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি।
তিনি বলেন, এক্সপ্রেসওয়ের চাপটা সড়কে পড়ছে। যখন সবাই দৌড়ের উপরে তখন এই চাপটা কতদূর পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে চিন্তা করেন, রমনা পর্যন্ত চলে যায়।
মগবাজার থেকে মোটরসাইকেলে আগারগাঁওগামী আরোহী নুরুল ইসলাম বলেন, পয়েন্টে পয়েন্টে সতর্ক পুলিশ। খুব দৌড়-ঝাঁপও করছে দেখছি। কিন্তু সড়ক তো বেসামাল। আধা ঘণ্টা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। নড়াচড়াও যেন করা যাচ্ছে না। তেজগাঁও ফ্লাইওভারে ওঠার পর টের পেলাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোলপ্লাজা পুরো এলাকাকে অচল করে রাখছে।
এ ব্যাপারে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক-তেজগাঁও বিভাগের ট্রাফিক-শেরে বাংলা নগর জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. তারেক সেকান্দার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা সাধ্যমতো সড়কে দাঁড়িয়ে লেন সচল রাখার চেষ্টা করছি। কখনো কোনো লেন পুরো খালি করতে গেলে অন্য লেন অচল হয়ে পড়ছে। বিজয় সরণিকে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে গাড়ি দ্রুত পাস করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
বিকেল থেকে প্রায় একই অবস্থা তৈরি হয় হাতিরঝিলের বাড্ডা-রামপুরার প্রবেশ মুখে ও তেজগাঁও থেকে নিকেতন গেট এলাকায়। সেখানে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মূল সড়কের গাড়ি পাসিং সম্ভব না হলে ইনকামিং লেন বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছে ট্রাফিক পুলিশ।
ট্রাফিক মতিঝিলের (ট্রাফিক-রামপুরা জোন) সহকারী পুলিশ কমিশনার আরিফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, মূল সড়ক যদি স্বাভাবিক রাখা না যায় বা খালি না হয় তবে ইন্টারসেকশনের ইনকামিং লেন থমকে যাবে, এটাই স্বাভাবিক।
তিনি বলেন, আমার এলাকায় দুইটা সমস্যা। যেটা আমি দাঁড়িয়ে থেকে চাইলেও সমাধান করতে পারছি না। এক অফিস থেকে হেঁটে বাসাগামী পথচারী। দ্বিতীয়ত বিকেলে যে পরিমাণ গাড়ির চাপ বাড়ে তা নিতে পারে না ৩০ ফিটের বনশ্রী সড়ক। যে কারণে অটোমেটিক চাপ তৈরি হচ্ছে। এখানে ফুটওভার ব্রিজও নেই যে পথচারীদের বাধ্য করব সড়ক যত্রতত্র পারাপার না করতে। তারপরও আমরা কষ্ট করছি। পুরো ইউনিট নিয়ে সড়কে আছি।
রমজানে ঢাকার যানজট নিরসনে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট, সেবা সংস্থা, ব্যবসায়ী, দুই সিটি কর্পোরেশনসহ ২২টি সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করেন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান। রমজান শুরুর আগে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, যানজট লেগেই থাকে এবং জনসমাগম বেশি এমন শতাধিক স্পট চিহ্নিত করেছে ডিএমপি। ইফতারের আগমুহূর্তে অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য মোতায়েন ও প্রতিটি থানা পুলিশকে এসময়ে ট্রাফিক সদস্যদের সহযোগিতা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি পথচারীদের চলাচল নির্বিঘ্ন করতে থানা পুলিশকে ফুটপাথ হকারমুক্ত রাখতে বলা হয়েছে। সব ট্রাফিক ও ক্রাইম বিভাগকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া স্থানীয়দের সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে বলা হয়েছে। যানজট নিরসনে কমিউনিটি পুলিশকে কাজে লাগানো হবে। এ ছাড়া ট্রাফিক বিভাগে ফোর্স বাড়ানো হচ্ছে। রমজানে সড়কে উন্নয়নকাজ এবং খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে ওয়াসা, তিতাস, সিটি কর্পোরেশন ও বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোকে।
ডিএমপি কমিশনার বলেন, ৩০৬ বর্গ কিলোমিটারের ঢাকা শহরে সোয়া ২ কোটি মানুষ বাস করে। পুলিশ এখানে রাতারাতি যানজট সমস্যা সমাধান করতে পারবে না।
জেইউ/এসএসএইচ