রমজানে বিষ ও ভেজালমুক্ত ইফতারি ও খাদ্যের নিশ্চয়তার লক্ষ্যে দশ‌টি সুপা‌রিশ করেছে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)।

শ‌নিবার (৯ মার্চ) রাজধানীর জাতীয় জাদুঘরের সামনে পবাসহ কয়েকটি প‌রিবেশবাদী সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে এক মানববন্ধন থেকে এসব সুপা‌রিশ করা হয়।

মানববন্ধনে বলা হয়, পবিত্র রমজান মাস শুরু হতে আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। প্রতি বছরই আমরা দেখতে পাই রমজানে স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর পোড়া তেল ও মবিল মিশ্রিত তেল দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ইফতারসামগ্রী ভাজা হয়। এছাড়াও একই তেল বারবার ব্যবহার করা হয।রাসায়নিক রং ও বিভিন্ন উপাদান মিশিয়ে ভোজ্য তেল তৈরি করা হয়। বিষাক্ত রং ব্যবহার করে সাদা ডিম লাল করা হয়। 

এছাড়া পচা-বাসিসহ বিভিন্নভাবে ভেজাল ও বিষাক্ত খাদ্যেও ব্যাপকতা বেড়ে যায়। এতে ক্যান্সার, কিডনি ও লিভারের জটিল রোগ সৃষ্টিসহ গর্ভের শিশু প্রতিবন্ধী হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

পবার কার্যকরী সভাপতি জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, প্রতি বছর রাজধানীসহ সারা দেশে প্রচুর ইফতারজাতীয় খাবার বিক্রি হয়। এই সুযোগেই মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত লাভের আশায় ইফতারিতে ভেজাল মেশায়।

খাদ্যে ভেজালের কারণে দেশের অধিকাংশ মানুষ গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ইফতারিসহ সব খাদ্য বিষ ও ভেজালমুক্ত করতে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এবং সংশ্লিষ্ট সবার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।

পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, আমরা বিশুদ্ধ ভেজাল ও বিষমুক্ত খাদ্য চাই। তাছাড়া সুস্থ ও সমৃদ্ধশালী জাতি গঠনে বিশুদ্ধ খাদ্য একান্ত অপরিহার্য। আমাদের বাংলাদেশের বিশুদ্ধ খাবার প্রাপ্তি কঠিন করে ফেলছে কিছু বিবেকহীন ব্যবসায়ী ও আড়তদার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও এদের নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খাচ্ছে। আমরা মনে করি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীদের তদারকি আরো বাড়াতে হবে। সব বাজারগুলোতে। 

তি‌নি বলেন, শুধু ছোটো দোকানদারদের উপর চাপ সৃষ্টি করে হবে না, কারখানাগুলোতে তদারকি বাড়াতে হবে। কেননা, মানুষের অতি প্রয়োজনীয় খাদ্য নিয়ে অনিয়ম মেনে নেওয়া যায় না। খাদ্যে ভেজাল অমানবিক ও ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। এর বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা নিতে হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও গণমানুষকে সচেতন করার মাধ্যমেই ভেজালমুক্ত খাদ্য নিশ্চিত করা সম্ভব।

পবার সম্পাদক মো. তৈয়ব আলী বলেন, রমজান আসলে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী মুনাফা লাভের আশায় খাবারে ভেজাল মিক্স করেন। ইফতারিতে সব থেকে বেশি চাহিদা মুড়ির। সেই মুড়িকে সাদা করতে ব্যবহৃত হচ্ছে ট্যানারির বিষাক্ত রাসায়নিক সোডিয়াম হাইড্রো সালফাইড। মুড়ি বড় বড় দানায় পরিণত করতে ব্যবহার হয় ইউরিয়া সার। নিরাপদ ও পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাবার পেতে আধুনিক কীটনাশকমুক্ত চাষাবাদ ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন।

পবার সম্পাদক ও বাংলাদেশ নিরাপদ পানি আন্দোলনের সভাপতি মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, অনিরাপদ খাদ্য বা ভেজাল খাদ্যে সংক্রান্ত আইনগুলো যথাযথভাবে প্রয়োগ না হওয়ার কারণে অসাধু ব্যবসায়ীরা খাদ্য ভেজাল মিশিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছেন।

তিনি বলেন, নিরাপদ ইফতারের জন্য প্রথম এবং প্রধান হলো পানযোগ্য পানি। কিন্তু বাজারে যার দাম অনেক বেশি। এই রমজানে পানযোগ্য সুপেয় পানি পাবলিক প্লেসগুলোতে সহনীয় মূল্যে পরিবেশনের/বিতরণের ব্যবস্থা করতে হবে।

পুরান ঢাকা নাগরিক উদ্যোগের সভাপতি নাজিম উদ্দিন বলেন, সুস্বাস্থ্যের জন্য চাই স্বাস্থ্যসম্মত নিরাপদ খাদ্য। বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যের বিকল্প কিছু নেই। আমরা খাদ্যের সঙ্গে বিষও খাচ্ছি।

নগরবাসী সংগঠনের সভাপতি হাজী শেখ আনসার আলী বলেন, রমজান মাসে রোজাদাররা তাজা শাকসবজি, মৌসুমি ফলমূল, মাছ-মাংসসহ অন্যান্য দ্রব্যাদির পরিপূর্ণ নির্ভেজাল স্বাদ গ্রহণ করতে চান। কিন্তু বর্তমান বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি খাদ্য ও পণ্যদ্রব্যই ভেজালমিশ্রিত। খাবারে ভেজাল মেশানো আমাদের দেশে ব্যবসায়ীদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

পবার ১০ সুপারিশ

১. খাদ্যে রাসায়নিক দ্রব্যাদি মেশানোর সঙ্গে জড়িত এবং রাসায়নিক দ্রব্যাদিযুক্ত ও ভেজাল খাদ্য বিক্রয়কারীদের মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে দণ্ড প্রদান অব্যাহত রাখা।

২. ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯, নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ এবং ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৫ কঠোরভাবে বাস্তবায়ন এবং অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা।

৩. জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে খাদ্যে বিষ বা ভেজালরোধে কোনোরকম বৈষম্য বা রাজনৈতিক বিবেচনা ছাড়াই আইন প্রয়োগে সরকারের প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

৪. বিষ ও ভেজালমুক্ত খাদ্য নিশ্চিত করতে সরকারকে খাদ্যে বিষ ও ভেজাল মিশ্রণের উৎসমূল থেকে শুরু করে খুচরা বিক্রেতা পর্যায়ে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা।

৫. সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ রাসায়নিক পদার্থের আমদানিকারক ও ব্যবহারকারী এবং লেবেল ছাড়া বা মিথ্যা লেবেলের অধীন কীটনাশক বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

৬. সময়োপযোগী কীটনাশক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করা।

৭. গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে কৃষক, উৎপাদনকারী, ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের রাসায়নিক দ্রব্যাদি, কীটনাশক, ভেজাল মিশ্রণের ক্ষতিকর দিক এবং আইনে বর্ণিত দণ্ড তুলে ধরে সচেতন করা।

৮. পণ্য আমদানি পর্যায়ে এনবিআর কর্তৃক বন্দরসমূহে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যাদি পরীক্ষা করা।

৯. খাদ্যে ভেজাল নিয়ন্ত্রণে বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদারকরণ এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ করা।

১০. বিষযুক্ত খাদ্যের ভয়াবহ বিপদ থেকে পরিত্রাণ পেতে দেশে জৈব কৃষি ব্যবস্থার প্রচলন ও একে জনপ্রিয় করে তোলা।

এনআই/পিএইচ