ফাতেমা-তুজ-জোহ্ রা বাংলাদেশ পুলিশের একজন সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি)। বিসিএস ৩৬তম ব্যাচের এই কর্মকর্তার স্কুল ও কলেজের পড়াশোনা রাজবাড়ীতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এপ্লাইড ফিজিক্সে। অনার্স মাস্টার্স শেষ করে বিসিএস দিয়ে পুলিশ যোগদান করেন। ২০২০ সালে প্রথম পোস্টিং হয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার সেলে। সেখানে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। 

এরই মধ্য পুলিশ সদরদপ্তর থেকে পুলিশ এভিয়েশনের জন্য সার্কুলার হয়। সেখানে বলা হয় পুলিশ চারজন এএসপিকে পাইলটের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এটি দেখে ছোটবেলার উড়োজাহাজ ওড়ানোর স্বপ্ন আবারও দেখতে শুরু করেন  ফাতেমা। সার্কুলার অনুযায়ী আবেদন করেন। এরপর পাইলট প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত হন।

আর্মি এভিয়েশন স্কুলে প্রশিক্ষণ শেষে ফাতেমা-তুজ-জোহরা এখন একজন পাইলট। বর্তমানে তিনি র‍্যাপিড একশন ব্যাটালিয়নের এয়ার উইংয়ে কর্মরত আছেন। 

আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষ্যে পুলিশ থেকে পাইলট হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করা ফাতেমা-তুজ-জোহরার সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা পোস্টের নিজস্ব প্রতিবেদক মনি আচার্য্য।

ঢাকা পোস্ট: পুলিশে যোগদানটা কীভাবে হয়েছিল?

ফাতেমা-তুজ-জোহ্ রা : আমার গ্রামের বাড়ি পাবনায়। তবে বড় হয়েছি নানার বাড়িতে রাজবাড়ীর পাংশায়। সেখানে আমার স্কুল ও কলেজে পড়াশোনা। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এপ্লাইড ফিজিক্সে ভর্তি হই। আগে থেকে কোনো স্বপ্ন ছিল না পুলিশে যোগদানের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষে বিসিএস-এর জন্য প্রস্তুতি শুরু করি। ৩৬তম বিসিএস-এ পুলিশে নিয়োগ পাই। ছোট বেলা থেকে স্বপ্ন ছিল উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়া এবং গবেষণা করা। বিসিএস দিতে গিয়ে স্বপ্ন পরিবর্তন হয়ে গেছে। 

ঢাকা পোস্ট : পুলিশে থেকে পাইলট হওয়ার ইচ্ছেটা কীভাবে এলো?

ফাতেমা-তুজ-জোহ্ রা : পুলিশে আমার প্রথম পোস্টিং ছিল সিআইডির সাইবার সেলে। ২০২০ সালে সিআইডির সাইবার সেলের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের দায়িত্ব পাই। প্রথম পোস্টিং-এর দায়িত্বগুলো ভালোই ছিল। সেখানে কাজ করে আমি সন্তুষ্ট ছিলাম। কারণ সেখানে কাজ করে আমি ভিকটিমদের পাশে দাঁড়াতে পেরেছি। সেখানে কাজ করা অবস্থায় পুলিশ সদরদপ্তর থেকে একটি চিঠি বের হয় যে পুলিশে এভিয়েশনের জন্য পাইলট প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এএসপিদের মধ্য থেকে চার জনকে বাছাই করা হবে। এই চিঠিটা দেখার পর আমার কাছে মনে হলো এটি একটি বড় সুযোগ। সুযোগটা কাজে লাগানোর জন্য চেষ্টা করা উচিৎ। আকেটা বিষয় ছিল-- যখন আমি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি, তখন ইচ্ছে ছিল বড় হয়ে পাইলট হবো। উড়োজাহাজ চালানোর ইচ্ছে অনেক বাচ্চার মনের মধ্যে থাকে। আমারও তেমনি একটা ইচ্ছে ছিল। সেই ইচ্ছে থেকে পুলিশ সদরদপ্তরের চিঠিটা দেখে আমি আগ্রহী হয়ে নাম পাঠাই। ৩০ জন আবেদন করেছিলাম পাইলট হওয়ার জন্য। বাছাই প্রক্রিয়া শেষে সাতজন ছিলাম। সেই সাতজনের মধ্যে আবারও বাছাই হয়। সর্বশেষ বাছাইয়ে আমরা ৪ জন নির্বাচিত হই। পরে আর্মি এভিয়েশন স্কুলে শুরু হয় আমাদের প্রশিক্ষণ।

ঢাকা পোস্ট: প্রশিক্ষণের সময় আকাশে ওড়ার অনুভূতি কেমন ছিল?

ফাতেমা-তুজ-জোহ্ রা: প্রশিক্ষণের সময় প্রথম আকাশে উড়ি একজন সিনিয়র প্রশিক্ষক পাইলটের সঙ্গে। তার আগে আমি উড়োজাহাজে চড়েছি। কিন্তু ককপিটে বসে আকাশে ওড়ার অনুভূতিটা অন্যরকম। ককপিটে বসে পৃথিবীটা দেখতে অন্যরকম লাগে। তবে প্রশিক্ষণের সময় আমি একবার একা এয়ারক্রাফট নিয়ে আকাশে উড়েছি। এই অনুভূতিটা আরও স্পেশাল। আর্মি এভিয়েশনের অধীনে ৫ ঘণ্টার ফ্লাইং টেস্ট ছিল সেটি। জীবনে প্রথমবার ককপিটে বসার সেই অনুভূতি ভাষায় বর্ণনা করার মতো নয়। থ্রটল, কন্ট্রোল কলাম, অল্টিমিটার, এয়ার স্পিড ইন্ডিকেটর, ডিরেকশনাল জাইরো- আরও কত কিছুর সঙ্গে পরিচয়। সেই সঙ্গে, মাত্র ১ হাজার ফিট ওপর থেকে দুনিয়াটাকে দেখার দুর্লভ অভিজ্ঞতা- সবুজ ফসলের ক্ষেত, বিল, একটার পর একটা নদী, এমনকি পদ্মা ব্রিজের নির্মাণ কাজও পরিদর্শন করে আসা ছিল অভাবনীয়!

ঢাকা পোস্ট : পাইলটের প্রশিক্ষণের সময়টা কেমন কেটেছে?

ফাতেমা-তুজ-জোহ্ রা: আমাদের প্রশিক্ষণ শুরু হয় ২০২১ সালের মে মাসে। বেসিক কোর্স শেষ হয় ২০২২ সালের জুন মাসে। হেলিকপ্টার প্রশিক্ষণ শুরু হয় ২০২২ সালের জুলাই মাসে। ২০২৩ সালের মার্চ মাসে হেলিকপ্টার প্রশিক্ষণ শেষ হয়। প্রশিক্ষণের সময়টা অনেক কঠিন ছিল। একটা সময় আমার মনে হয়েছিল এখানে আমার আসা উচিৎ হয়নি। এই কঠিন প্রশিক্ষণ পার হতে পেরেছি আমাদের প্রশিক্ষকদের জন্য। এছাড়া তৎকালীন আইজিপি স্যারসহ র‍্যাব ডিজি স্যার নিয়মিত আমাদের খোঁজ খবর নিতেন। স্যাররা রেগুলার ম্যাসেজ পাঠাতেন আমরা যেন হাল না ছাড়ি। সবার সহযোগিতায় কঠোর প্রশিক্ষণের সময়টা পার হতে পেরেছি। 

ঢাকা পোস্ট : সফলতার সিঁড়িতে উঠতে কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল কি না?

ফাতেমা-তুজ-জোহ্ রা: বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পর্যায়ে নানা প্রতিবন্ধকতা থাকে। তবে কোনো মেয়ের পাশে যদি তার মা, বাবা ও পরিবার থাকে তাহলে কোনো প্রতিবন্ধকতাই তাকে আটকে রাখতে পারে না। সেদিক থেকে আমি ভীষণ সৌভাগ্যবান। আমি আমার বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান। আমি যে তাদের কন্যা সন্তান এ বিষয়টি কখনো মুখ্য ছিল না। আমি তাদের প্রথম সন্তান এটাই সবসময় মুখ্য ছিল। আমার মা, বাবা সব সময় চেষ্টা করেছেন যেন তার সন্তান ছেলে হোক কিংবা মেয়েকে হোক সে যেন আত্মসম্মান নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। তাদের ইচ্ছেটা আমাকে অনেকখানি এগিয়ে নিয়ে গেছে।

মেয়েরা অনেক কিছু করতে পারবে না সমাজে তথাকথিত কিছু ধারণা আছে। আমার পরিবারের সাপোর্টের কারণে এসব তথাকথিত ধারণা নিয়ে আমি বড় হইনি। তাই আমি বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ সহজে মোকাবিলা করতে পেরেছি। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে মেয়েদের ক্ষেত্রে যতটা না বাস্তবিক বাধা তার চেয়ে বেশি থাকে মনস্তাত্ত্বিক বাধা। এসব বাধা সামাজিক ও পারিবারিক-ভাবে সৃষ্টি হয়। সমাজ ও পরিবার যদি কোনো মেয়েকে মনস্তাত্ত্বিক বাধা থেকে বের করে আনতে পারে তাহলে সে সকল চ্যালেঞ্জ সহজে মোকাবিলা করতে পারে। সামনে এগিয়ে যেতে হলে মনস্তাত্ত্বিক বাধাকে উপেক্ষা করে এগিয়ে যেতে হবে। তবে এখন সামাজিকভাবে এসব ধারণা পাল্টে যাচ্ছে। এর ফলে এখন দেখা যাচ্ছে স্কুল কিংবা কলেজে মেয়েরা বিভিন্ন পরীক্ষায় পাসের হারে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে কর্মজীবন বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে মেয়েদের এখনো বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সামাজিকভাবে এখনো শতভাগ সচেতনতা সৃষ্টি হয়নি।

ঢাকা পোস্ট: কর্মজীবন বেছে নিতে নারীদের এখনো কে আটকাচ্ছে?

ফাতেমা-তুজ-জোহ্ রা :  পড়াশোনা শেষে একটি মেয়ে কর্মজীবনে পা রেখে স্বাবলম্বী হবে সে বিষয়ে এখনো সেভাবে সচেতনতা সৃষ্টি হয়নি। ফলে এখনো নারীরা পড়াশোনা শেষ করে সাংসারিক জীবনে ব্যস্ত হয়ে যান। পারিবারিক দায়িত্বটা কিন্তু ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। পারিবারিক দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সঙ্গে যে একজন নারী কর্মজীবনেও দায়িত্ব পালন করতে পারে সে ধারণাটা এখনো আমাদের সমাজে সেভাবে সৃষ্টি হয়নি। এর ফলে অধিকাংশ মেয়ে গ্র্যাজুয়েশনের পর শুধু সাংসারিক জীবনে ব্যস্ত থাকেন।

ঢাকা পোস্ট: কর্মজীবনের পাশাপাশি আপনার নিজের পারিবারিক জীবন কেমন কাটছে?

ফাতেমা-তুজ-জোহ্ রা: আমার পরিবারে আছেন মা, বাবা ও ছোট ভাই। পুলিশের চাকরিতে অনেক কম সময় পাওয়া যায়। আমাদের কাছে নির্দিষ্ট কোনো কর্মঘণ্টা নেই। যখন তখন অফিসের কাজে মনোযোগ দিতে হয়। পারিবারিক কোনো প্রোগ্রাম থাকলেও হয়তো তাতে যোগ দিতে পারছি না। তবে কখনো কখনো পরিবারকে সময় দিতে হয়। আবার কখনো অফিসের কাজকে বেশি গুরুত্ব দিতে হয়। আমার পরিবারেরও ইচ্ছে আমি আমার কাজের জায়গায় ভালো করি। সেই রকম সাপোর্ট আমি আমার পরিবারের কাছ থেকে পাই। তবে পরিবারকে যে সময় দিই না তেমনও নয়। পরিবার ও অফিস দুটিকে সমান গুরুত্ব দিয়ে চলি।

ঢাকা পোস্ট: পাইলট হওয়াটা কি নারীদের জন্য একটু বেশি চ্যালেঞ্জিং?

ফাতেমা-তুজ-জোহ্ রা: কোনো কাজই নারীর জন্য অসম্ভব নয়। যেমন ফুটবল ও ক্রিকেট খেলা খুব কঠিন স্কিলের ব্যাপার। আমাদের দেশের মেয়েরা কিন্তু ক্রিকেট ও ফুটবল খেলছেন। এসব খেলা খেলে নারীরা কিন্তু আমাদের জাতিগতভাবে গর্বিত করছেন। যে কাজ যত কঠিন সেখানে নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ তত বেশি। আমার বিশ্বাস আমাদের দেশে অনেক মেয়ে আছেন যারা চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসেন। তারা নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ চান। তাই আমার কাছে মনে হয় পাইলট হওয়ার বিষয়টাতে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে ঠিক, একইভাবে অনেকে সেই চ্যালেঞ্জ নিতেও প্রস্তুত আছেন।

ঢাকা পোস্ট: কর্মজীবনে সহকর্মীদের সহযোগিতা কেমন পাচ্ছেন?

ফাতেমা-তুজ-জোহ্ রা: আমি যখন সিআইডির সাইবার সেলে ছিলাম তখন আমার সঙ্গে ৪০ জন উপ-পরিদর্শক (এসআই) কর্মরত ছিলেন। সেখানে আমাকে আবার সুপারভাইজ করতে একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ছিলেন। এই টিমে আমিই একমাত্র মেয়ে ছিলাম। আমি ছিলাম সেখানে নবীন একজন কর্মকর্তা। কিন্তু আমি সেখানে সবার সাপোর্ট পেয়েছি। সিআইডির সাইবার সেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করতে কোনো ক্লান্তি বোধ হতো না। তার একটাই কারণ, আমার পুরুষ সহকর্মীদের সহযোগিতা। তাদের কারণে আমি আমার কাজের জায়গাটাকে আপন করে নিতে পেরেছি।

ঢাকা পোস্ট: নারী দিবসে নারীদের জন্য আপনার কী বার্তা থাকবে?

ফাতেমা-তুজ-জোহ্ রা: যেকোনো মেয়ে তার নিজের জায়গা থেকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তার যদি কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকে সেটা প্রাথমিকভাবে মনস্তাত্ত্বিক। মনস্তাত্ত্বিক প্রতিবন্ধকতা ভেঙে কেউ যদি সামনে এগোয়, অন্য প্রতিবন্ধকতাগুলো আর কোনো সমস্যা হবে না। তাই নিজের মনের প্রতিবন্ধকতা দূর করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।

এমএসি/জেএস