কূটনীতি নিয়ে সাংবাদিকদের কঠিন প্রশ্নের ‘চ্যালেঞ্জ’ নেন যে নারী
সেহেলী সাবরীন, পেশাদার কূটনীতিক। বর্তমানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনকূটনীতি অনুবিভাগের মহাপরিচালক এবং মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র। তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রথম আনুষ্ঠানিক মুখপাত্র। কূটনৈতিক অঙ্গনের খবরা-খবর নিয়ে যাকে নিয়মিত সাংবাদিকদের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। মুখপাত্র হিসেবে তাকে দায়িত্ব দেওয়ার পর থেকে বিভিন্ন ইস্যুতে নিয়মিত ব্রিফিং করার চেষ্টা করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
মুখপাত্র হিসেবে ইতোমধ্যে বছর পার করেছেন এ নারী কূটনীতিক। এই সময়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের চাপ, অন্যদিকে চীন-রাশিয়ার বাংলাদেশ ইস্যুতে মার্কিনিদের বিপরীত অবস্থান কিংবা ভারতের নীরব কূটনীতি- এসব বিষয়ে বহু ব্রিফিং সামলেছেন সেহেলী। এ ছাড়া বাংলাদেশ নিয়ে কংগ্রেসম্যান, জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে চিঠির পর চিঠি নিয়ে অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে তাকে।
বিজ্ঞাপন
মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে এসব ইস্যুতে কিংবা অন্য যেকোনো প্রসঙ্গে বরাবরই কৌশলী ভূমিকায় দেখা গেছে মুখপাত্র সেহেলীকে। কূটনীতিক হিসেবে কূটনৈতিক উপায়েই প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন তিনি। ‘কঠিন সময়ে’ পাওয়া দায়িত্ব বেশ ভালোভাবে পালন করে চলেছেন এই নারী মুখপাত্র।
আরও পড়ুন
সেহেলীর জন্মস্থান ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর গ্রামে। প্রকৌশলী বাবার চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন্ন জেলায় পড়ালেখা করতে হয়েছে সেহেলীকে। ২০০৫ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফরেন ক্যাডার হিসেবে যোগ দেন তিনি। সদর দপ্তরে (ঢাকা) কাজ করার পাশাপাশি বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের কয়েকটি মিশনে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
পররাষ্ট্র ক্যাডারের ২৪ ব্যাচের কর্মকর্তা সেহেলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। পরিবারের আগ্রহেই বেছে নেন কূটনীতিকের পেশা। এ প্রসঙ্গে সেহেলী বলেন, আমার পরিবারে সরকারি চাকরিজীবী বয়োজ্যেষ্ঠরা সবসময় বিসিএস দিতে উৎসাহ দিতেন এবং দিকনির্দেশনা দিতেন। পররাষ্ট্র ক্যাডারকে প্রথম পছন্দ হিসেবে দেওয়ার পরামর্শ দেন আমার ফুফা। পরিবোরের সবার আস্থা ও বিশ্বাসের কারণেই এখানে আসতে পেরেছি।
আরও পড়ুন
কূটনীতিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পরিবারের পাশাপাশি স্বামীর অবদানকেও সামনে রাখতে চান সেহেলী। তার ভাষ্য, কূটনীতির মতো চ্যালেঞ্জিং পেশায় কাজ করার জন্য একজন নারী কূটনীতিককে চাকরি ও পরিবারের মধ্যে সমন্বয় করে চলতে হয়। এজন্য পরিবারের সহযোগিতা খুব গুরুত্বপূর্ণ। চাকরিসূত্রে দেশের বাইরে দীর্ঘসময় সন্তানসহ থাকার সময় আমার স্বামী ও পরিবারের সদস্যরা মানসিক সাহস দিয়েছেন। তাদের সহযোগিতা ছিল বলেই ছোট বাচ্চা নিয়ে অনেক কঠিন পরিস্থিতি সামাল দিয়েও মন্ত্রণালয় ও দূতাবাসের অনেক কঠিন দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি।
একসময় মেয়েদের কূটনীতিকের পেশায় যাওয়াকে বাঁকা চোখে দেখা হতো। বিশেষ করে অনেক পুরুষ সহকর্মী বিষয়টিকে ভালোভাবে নিতে পারতেন না। তবে সময়ের ব্যবধানে সেখানে পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে দেশে-বিদেশে অনেক নারী কূটনীতিক কাজ করছেন।
নারী কূটনীতিকদের চ্যালেঞ্জের বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেহেলী বলেন, পররাষ্ট্র ক্যাডারে কাজের জন্য অনেক সময় দেশের বাইরে থাকতে হয়। তাই অনেক ক্ষেত্রে নারীর জন্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। তবে বর্তমানে এই ক্যাডারে নারী কর্মকর্তার সংখ্যা অনেক বেড়েছে। বর্তমানে মোট ৮৩ জন নারী কূটনীতিক মন্ত্রণালয়ে কর্মরত আছেন।
কূটনীতিক হিসেবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দেওয়ার সাড়ে ছয় বছর পর ২০১২ সালে বিদেশে প্রথম পোস্টিংয়ে যান সেহেলী। তিনি প্রথম সচিব হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরায় বাংলাদেশ হাইকমিশনে যোগদান করেন। বিদেশে প্রথম পোস্টিং প্রসঙ্গে সেহেলী জানান, ক্যানবেরা ছিল বিদেশে আমার প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট। বাচ্চা ছোট ছিল এবং আমাকে একা বাচ্চা নিয়ে থাকতে হবে- তাই আমি একটু দেরিতে পোস্টিংয়ে যেতে হয়। পরে সেখান থেকে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় বাংলাদেশ দূতাবাসে কাউন্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করি।
বিদেশের মাটিতে কূটনীতিকের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে সেহেলীকে। ইন্দোনেশিয়ার বাংলাদেশ মিশনে দায়িত্ব পালনের সময় দেশটির আচেহ প্রদেশের প্রত্যন্ত উপকূল থেকে বাংলাদেশিদের উদ্ধার করে দেশে পাঠানোর গুরু দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
আরও পড়ুন
সেই কঠিন সময় প্রসঙ্গে মুখপাত্র বলেন, ২০১৫ সালে আচেহ প্রদেশের প্রত্যন্ত উপকূলে বাংলাদেশ থেকে নৌকা যোগে আসা অনিয়মিত বাংলাদেশিদের উদ্ধার করে তাদের জাতীয়তা নিশ্চিত করে দেশে পাঠানোর কাজটি খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার ডারউইন-এর ডিটেনশন সেন্টারে গিয়ে বাংলাদেশিদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার ঘটনাটাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
১৮ বছরের ক্যারিয়ারে কূটনীতিক হিসেবে নিজের সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন ইন্দোনেশিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসে কাজ করার সময়। ওই সময়টাকে সবার ওপরে রাখতে চান সেহেলী সাবরীন। তার ভাষায়, কূটনীতিক হিসেবে কাজ করতে গিয়ে মনে রাখার মতো ঘটনা তো অনেক আছে। তবে ইন্দোনেশিয়ায় দূতাবাসে কাজ করার সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আফ্রো এশিয়ান সামিটে অংশগ্রহণ সম্পর্কিত সফরটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সে সময় রাস্ট্রদূতের হঠাৎ অসুস্থতার মাঝে আমরা সফরটি আয়োজন করেছি এবং আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেক কাজ করেছি এবং শিখেছি। এ ছাড়া আসিয়ান সেক্রেটারিয়েটের সঙ্গে নেগোসিয়েশন-এর মাধ্যমে বাংলাদেশকে আসিয়ানের সেক্টরাল পার্টনার বিবেচনা করার কাজটি সেসময় আমরা প্রথম শুরু করি।
তিনি বলেন, ভবিষ্যতে বাংলাদেশ যদি আসিয়ানের সেক্টরাল পার্টনার হয়, তবে এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকায় নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করব। আবার পরিচালক (দক্ষিন এশিয়া) থাকার সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী নির্ভর বায়োপিক নির্মাণের জন্য বাংলাদেশ ও ভারতের তথ্য মন্ত্রণালয়ের মাঝে যে এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়, সেখানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিত্ব করি অঅমি। ২০২৩ সালে ‘মুজিব একটি জাতির রূপকার’ যখন বের হলো তখন কাজ করার সার্থকতা অনুভব করি।
জাকার্তা থেকে ২০১৭ সালে দেশে ফিরে দক্ষিণ এশিয়া অনুবিভাগের পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন সেহেলী সাবরীন। পরে পশ্চিম এশিয়া অনুবিভাগের পরিচালক এবং আমেরিকা অনুবিভাগের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। পরবর্তীতে কনসুলার ও কল্যাণ অনু বিভাগের মহাপরিচালক হিসেবে কাজ করেন। সবশেষ, ২০২৩ সালে জন কূটনীতি বিভাগের মহাপরিচালক এবং মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের দায়িত্ব দেওয়া হয় সেহেলীকে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আনুষ্ঠানিক মুখপাত্র হওয়া প্রসঙ্গে সেহেলী সাবরীন বলেন, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সালে মন্ত্রণালয় আমাকে মুখপাত্রের দায়িত্ব দেয়। আমার ১৮ বছরের চাকরি জীবনে এটি সম্পূর্ণ এক নতুন অভিজ্ঞতা। আমাকে যখন যে কাজ দেওয়া হয় আমি তা সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে করি এবং নতুন কিছু শিখে নিজের উন্নয়নে কাজে লাগাই। মুখপাত্র হিসেবে কাজ করতে গিয়ে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন-এর সাহস, উৎসাহ এবং দিক নির্দেশনা আমাকে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করেছে। পাশাপাশি সিনিয়র ও জুনিয়র সহকর্মীদের যেকোনো বিষয়ে তথ্য প্রদান আমার কাজকে সহজ করেছে।
মুখপাত্রের দায়িত্ব পেয়ে যেদিন প্রথম সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে গণমাধমের মুখোমুখি হলেন সেদিনের অনুভূতি কেমন ছিল? সেহেলী বলেন, প্রথম সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হবার অনুভূতিটা ছিল মিশ্র। একদিকে সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশ, তারপর গণমাধ্যমের সামনে সরাসরি প্রশ্নত্তোর পর্ব। পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় টেনশন লাগছিল। তবে সাংবাদিকরা আমার অনেক সীমাবদ্ধতাকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখেছেন এবং তাদের কারণে মন্ত্রনালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিং নিয়মিতভাবে করা সম্ভব হয়েছে।
নির্বাচনের আগে মুখপাত্রের দায়িত্ব পেলেন। খুব কঠিন সময় ছিল। ওই সময়ে পরাশক্তিগুলো বাংলাদেশ নিয়ে প্রতিনিয়ত কথা বলছিল। আপনাকেও সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে অনেক কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। সেই সময়টা তো উতরে গেলেন। ওই সময়টা নিয়ে কী বলবেন? মুখপাত্র বলেন, মুখপাত্র হিসেবে সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ের আগে আমরা জনকূটনীতি অনুবিভাগের সবাই প্রথমে সকল অনুবিভাগের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর তথ্য সংগ্রহসহ সম্ভাব্য প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করি।
তিনি বলেন, এরপর পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে সমসাময়িক ইস্যু নিয়ে আলোচনা করে আমাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করি। গণমাধ্যমে যেকনো তথ্য প্রদানের ব্যাপারে আমরা সবসময় সঠিক তথ্য প্রদানে লক্ষ্য রেখেছি।
কূটনীতি অঙ্গনে কোনো বার্নিং ইস্যু হলে মুখপাত্র হিসেবে সাংবাদিকরা আপনার দ্বারস্থ হয়, কতটুকু সহযোগিতা করতে পারেন? আর অনেক সময় তথ্য না জানাতে পারার কারণ বা কোনো প্রতিবন্ধকতা আছে বলে মনে করেন কি না? সেহেলী বলেন, জনকূটনীতি অনুবিভাগের মহাপরিচালক এবং মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হওয়ায় সাংবাদিকরা আমার কাছে বিভিন্ন ইস্যুতে তথ্য জানতে চান। আমি চেষ্টা করেছি, সংশ্লিষ্ট অনুবিভাগ বা দূতাবাসের মাধ্যমে তথ্যটি সংগ্রহ করে জানাতে। তবে সংবেদনশীল ব্যাপারে এবং কাজের গতিশীলতার স্বার্থে সবসময় সব তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে দেওয়া সম্ভব হয় না।
ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে প্রায়ই আপনাকে ‘জেনে জানাব- এরকম উত্তর দিতে দেখা যায়। এটা কি তথ্য না থাকার কারণে নাকি বিব্রত পরিস্থিতি এড়াতে কূটনৈতিক কৌশল? মুখপাত্র বলেন, আমি চাই সংবাদমাধ্যমকে নির্ভুল ও সঠিক তথ্য জানাতে। কারণ আমি ব্রিফিংয়ে যা বলব তা মিডিয়াতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতামত হিসেবে গৃহীত হবে। তাই কোনো ব্যাপারে আমার সম্পূর্ণ এবং সঠিক ধারণা না থাকলে আমি সাংবাদিকদের 'জেনে জানাব' বলেছি। পরে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমি প্রশ্নের উত্তরটা জেনে জানানোর চেষ্টা করেছি। এ কৌশল নেওয়ার কারণে আমি নিজে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়লেও মুখপাত্রের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের জন্য এটা সহায়ক হয়েছে বলে আমি মনে করি।
মুখপাত্র হিসেবে নিজেকে কতটা সফল মনে করছেন- এমন প্রশ্নে সেহেলীর ভাষ্য, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করতে গিয়ে আমি প্রতিনিয়ত শিখছি। সঠিক তথ্য প্রদানের মাধ্যমে আমি চেষ্টা করছি নিজের মন্ত্রনালয় তথা দেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরতে। যে নতুন দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়েছে অনেক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও আমি সর্বাত্মকভাবে তা পালনে সচেষ্ট থেকেছি। কতটুকু সফল হয়েছি তার বিচার করবে আমার মন্ত্রণালয়।
এনআই/জেএস