মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ডাক বিভাগের ক্যালেন্ডার ‘মুক্তির ডাক’
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষ্যে মহান মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে ‘মুক্তির ডাক’ নামে বিশেষ ক্যালেন্ডার প্রকাশ করেছে ডাক অধিদপ্তর। বৃহস্পতিবার (৭ মার্চ) গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই বিশেষ ক্যালেন্ডারের মোড়ক উন্মোচন করেন।
ক্যালেন্ডারটিতে রয়েছে ২০২৪ সালের দিনপঞ্জিকে ৩ মাস করে বিভক্ত করে ৪টি পাতা। প্রতিটিতে ১৯৭১ সালের ঐ ৩ মাসের ঘটনার সঙ্গে ডাকটিকিট সম্পৃক্ত করে সেসব বিষয়সহ মুক্তিযুদ্ধকালীন বিশেষ ঘটনাবলী স্থান পেয়েছে।
বিজ্ঞাপন
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক জানান, এই ক্যালেন্ডারটি মুক্তিযুদ্ধে ডাক বিভাগের নেতৃত্বে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে একটি সংকলন। এর প্রথম পাতায় আছে ঘটনাটির প্রেক্ষাপট।
২০২৪ সালের দিনপঞ্জিকে ৩ মাস করে বিভক্ত করে ৪টি পাতার প্রতিটিতে আছে ১৯৭১ সালের ঐ ৩ মাসের যে যে ঘটনার সঙ্গে ডাকটিকিটগুলোকে সম্পৃক্ত করে, তার সংশ্লেষ।
শেষ পাতায় ২০২৫ সালের দিনপঞ্জিতে তুলে ধরা হয়েছে গত ৫ দশকেরও দীর্ঘ সময় জুড়ে প্রকাশিত বিষয় ভিত্তিক ডাকটিকিটের বৈচিত্র্য।
প্রথম পাতা প্রেক্ষাপটে যা রয়েছে
মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সার্বিক জাতীয় চেতনায় এক গভীর আবেগ, আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের শেকড় আমাদের সম্মিলিত প্রথম বিজয়! মুক্তিযুদ্ধকালীন নানা কার্যক্রম আমাদের তাই ব্যাপক আলোড়িত করে, প্রেরণা দেয় নতুন করে ঐক্যবদ্ধ হতে, দেশকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে উদ্যমী করে তোলে।
যুদ্ধকালীন সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ৮টি ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধ চলকালে ১৯৭১ সালের ২৬ জুলাই ব্রিটিশ হাউস অব কমনসে এক সংবাদ সম্মেলনে ব্রিটেনে নিযুক্ত বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী উপস্থিত সাংবাদিক ও আমন্ত্রিত অতিথিদের সামনে ডাকটিকিটগুলো প্রথম প্রদর্শন করেন। এরপর ২৯ জুলাই মুজিবনগর, বিভিন্ন মুক্তাঞ্চল, কলকাতার বাংলাদেশ মিশন ও লন্ডন থেকে একযোগে এই ডাকটিকিটগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়। বিমানচাঁদ মল্লিকের নকশায় ছাপানো ডাকটিকিটগুলো মুক্তিযুদ্ধকালীন দেশের বিভিন্ন মুক্তাঞ্চল থেকে পাঠানো বিভিন্ন চিঠি, রসদ ও গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রে ব্যবহৃত হতো। এই ডাকটিকিটগুলোই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশকে বিশ্বের সামনে পরিচিত করার বড় মাধ্যম। এই আটটি ডাকটিকেটের পেছনের গল্প নিয়েই আমাদের এই সংকলন ‘মুক্তির ডাক’।
জানুয়ারি-মার্চ মাস
মুক্তিযুদ্ধের দিনপঞ্জিতে গুরুত্বপূর্ণ একটি তারিখ ২ মার্চ। ১৯৭১ সালের এই দিনে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করা হয়। সবুজ জমিনের ওপর লাল বৃত্তের মাঝখানে সোনালী মানচিত্র খচিত পতাকাটি স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা চাঙ্গা করে তোলে। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণে সে আকাঙ্ক্ষা স্পষ্ট হবার ধারাবাহিকতায় কাপুরুষ হানাদার বাহিনী রাজনৈতিক ছলচাতুরীর আড়ালে পরিকল্পনা করে ইতিহাসের নারকীয়তম গণহত্যার। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরস্ত্র ছাত্রদের গণহারে হত্যার মাধ্যমে শুরু হওয়া এই হত্যাযজ্ঞ সূচিত করে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রকাশিত বাংলাদেশের প্রথম ৮টি ডাকটিকিটের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধরত দেশের গল্প বলতে গিয়ে দুটি ডাকটিকিটে উঠে এসেছে স্বাধীনতার পতাকা ও নারকীয় গণহত্যার বয়ান।
এপ্রিল-জুন মাস
২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার পরপরই প্রত্যুষে গ্রেপ্তার হন বঙ্গবন্ধু। প্রতিরোধ যুদ্ধের নির্দেশনা বঙ্গবন্ধু দিয়েই রেখেছিলেন ৭ মার্চ এর ভাষণে। সে নির্দেশনা মোতাবেক মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় এবং বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করায় অবধারিত হয়ে পড়ে স্বাধীন দেশের সরকার গঠন। গ্রেপ্তারকৃত বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তাঁকে জাতির স্থপতি স্বীকৃতি দিয়ে ১০ এপ্রিল তারিখে আওয়ামী লীগ এর নেতৃত্বে গঠিত হয় স্বাধীন দেশের অস্থায়ী সরকার। এপ্রিল মাসেই বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত হয় বঙ্গবন্ধু'র নেতৃত্বে ‘পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধ’ শুরু হয়েছে। স্বাধীন দেশের প্রথম প্রকাশিত ডাকটিকিটগুলোর আরও দুটির মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বজুড়ে জানিয়ে দেয় এ যুদ্ধ গৃহযুদ্ধ নয়; বরং শেখ মুজিবুর রহমান এর নেতৃত্বে গঠিত স্বাধীন সরকার কর্তৃক পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধ।
জুলাই-সেপ্টেম্বর
স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠন এবং মুক্তিযুদ্ধের খবর বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। হানাদার বাহিনীর আন্তর্জাতিক কূটচাল এবং বিশ্বজুড়ে একপাক্ষিক ও পক্ষপাতদুষ্ট প্রচার সত্ত্বেও বাংলাদেশের গণহত্যা এবং শরণার্থী সংকট সারা বিশ্বের নজর কাড়ে। এ পরিস্থিতিতে ২৯ জুলাই তারিখে স্বাধীন বাংলাদেশের ৮টি ডাকটিকিট প্রকাশ ছিল একটা অসাধারণ কূটনৈতিক পদক্ষেপ, যার মাধ্যমে বাংলাদেশের পক্ষে দেশের সত্য পরিস্থিতি বিশ্বের সামনে উপস্থাপিত হয়। দুটো ডাকটিকিটে বিশেষভাবে ফুটিয়ে তোলা হয় বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান ও বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান। বিশ্বজুড়ে সাংস্কৃতিক ও সুশীল সমাজ প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। ১ আগস্ট তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের মেডিসন স্কয়ারে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ এবং ৮ আগস্ট তারিখে যুক্তরাজ্যের ট্রাফেলগার স্কয়ারে বাংলাদেশের পক্ষে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক সমাবেশ ছিল তেমনই দুটি অনন্য সাধারণ ঘটনা।
অক্টোবর-ডিসেম্বর মাস
মুক্তিযুদ্ধের শেষ তিন মাস ছিল প্রকৃত অর্থেই ধাপে ধাপে বিজয়ের দিকে অগ্রযাত্রা। এক বছর আগে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হওয়া সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এর নিরঙ্কুশ বিজয় ও তার ভিত্তিতে বাঙ্গালীর নেতৃত্বে পাকিস্তান এর সরকার গঠনের সম্ভাবনার ভিত রচিত হয়েছিলো। সে ভিত এর উপরেই দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতায় বঞ্চনার জিঞ্জির ভেঙে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে চূড়ান্ত বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম। বাংলাদেশের প্রথম ৮টি ডাকটিকিটের মধ্যে দুটি ডাকটিকিটে প্রতিভাত হয় সাড়ে সাত কোটি মানুষের একটি একক জাতিসত্তা এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশ গঠনের পক্ষে সে জাতিসত্তার ৯৮% অংশের সমর্থন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হবার পর ২০ ডিসেম্বর তারিখেই ৮টি ডাকটিকিটের উপর ‘বাংলাদেশের মুক্তি’ ছাপসহ পুনরায় প্রকাশ ছিল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংবাদ বিশ্বজুড়ে প্রচারের এক অনন্য নজির।
শেষ পাতা- ২০২৫
মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রকাশিত ৮টি ডাকটিকিট এর মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের গল্প ছড়িয়ে দেয়ার যে প্রয়াস শুরু হয়েছিল, বাংলাদেশের ডাক অধিদপ্তর তা অদ্যাবধি বহন করে চলেছে। বিভিন্ন দিবস ও সাফল্য উদযাপনে ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, শহীদ বুদ্ধিজীবী, ঐতিহ্য, প্রকৃতি, বিবিধ বিষয়সহ বাংলাদেশের বিস্ময়কর উন্নয়ন স্থান পেয়েছে শেষ পাতায়।
আরএইচটি/এমএ