ঝুঁকির তালিকায় ভবন, নেই সেখানকার ‘অবৈধ’ রেস্টুরেন্টের তথ্য
* আবাসিকের অনুমতি নিয়ে বাণিজ্যিক কারবার
* অগ্নিঝুঁকিতে থাকা রেস্টুরেন্টের তালিকা এখনো হয়নি
* পাঁচ হাজার রেস্টুরেন্টের ৯৬ শতাংশই ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে
* সরকারি তিন সংস্থার তথ্যে বিস্তর অমিল
* মামলা হলেও সাজার নজির নেই
রাজধানীর বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের মৃত্যুর পর প্রশ্ন উঠেছে ঢাকায় আসলে কতগুলো রেস্টুরেন্ট রয়েছে এবং অগ্নিঝুঁকিতে থাকা ভবনে কী পরিমাণ রেস্টুরেন্ট চলছে, কীভাবে চলছে? গত দুদিন সংশ্লিষ্ট কয়েকটি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর মেলেনি।
ফায়ার সার্ভিস বলছে— ঢাকায় আবাসিক, বাণিজ্যিক, বিপণিবিতান, মিডিয়া হাউজ, হাসপাতাল-ক্লিনিকসহ অগ্নিঝুঁকিতে থাকা ভবনের পরিসংখ্যান আছে। তবে আলাদাভাবে অগ্নিঝুঁকিতে থাকা রেস্টুরেন্টের কোনো তালিকা তারা করেননি।
বিজ্ঞাপন
ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের সিনিয়র স্টাফ অফিসার (মিডিয়া সেল) মো. শাহজাহান শিকদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, শুধু রাজধানীতে নয়, ঢাকাসহ সারা দেশে আবাসিক, বানিজ্যিকসহ নানা ভবনে গড়ে তোলা রেস্টুরেন্টের সঠিক সংখ্যা জানতে পরিদর্শনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ভবন বৈধ কিন্তু আবাসিকের অনুমতি নিয়ে অবৈধভাবে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলছে— এমন ভবনের পরিসংখ্যানও তৈরি করা হচ্ছে।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকা শহরে প্রায় পাঁচ হাজার রেস্টুরেন্ট ও খাবারের হোটেল রয়েছে। এর ৯৬ শতাংশই নিয়ম না মেনে কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে বিপজ্জনক পরিবেশে চলছে। এছাড়া আবাসিকের অনুমতি নিয়ে বাণিজ্যিক ভবন করা হয়েছে বহু জায়গায়। যেখানে অবৈধভাবে চালানো হচ্ছে রেস্তোরাঁসহ নানা বাণিজ্যিক কারবার। অগ্নিদুর্ঘটনা এবং এতে হতাহতের ঘটনা এড়াতে অবৈধ ও নিয়ম না মেনে চালানো এসব রেস্টুরেন্ট বন্ধের দাবি জানান তারা।
রাজধানীতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা আসলে কত?
রাজধানী ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা নিয়ে সরকারের একেক প্রতিষ্ঠান একেক সময় ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যা জানিয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও সিটি করপোরেশনের তথ্যে বিস্তর অমিল। এছাড়া কোনো ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করার প্রক্রিয়াও প্রশ্নবিদ্ধ।
২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকাসহ সারা দেশে সরকারি ১৩৩৭টি, বেসরকারি ৪৫৩২টি ভবন পরিদর্শন করে ফায়ার সার্ভিস। এর মধ্যে অগ্নিনিরাপত্তায় সন্তোষজনক ভবন হিসেবে দেখানো হয় ৩০৯৬টি। বাকিগুলোর মধ্যে অগ্নিনিরাপত্তার ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ দেখানো হয় ১৬০৬টি এবং অতি ঝুঁকিপূর্ণ দেখানো হয় ৬১৭টিকে
জানা যায়, ঢাকায় ফায়ার সার্ভিস ১১৬২টি বহুতল ভবন ও শিল্পকারখানা পরিদর্শন করে। এর মধ্যে সরকারি ৪৯৭ ও বেসরকারি ভবন ৬৬৫টি। পরিদর্শনে ৫২৭টি ভবন সন্তোষজনক পায় পরিদর্শক টিম। বাকিগুলোর মধ্যে ৪৯৯টি ঝুঁকিপূর্ণ এবং ১৩৬টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ।
আরও পড়ুন
ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, অগ্নিনিরাপত্তা জোরদার করার লক্ষ্যে বিভিন্ন শর্তে ফায়ার সার্ভিস বিদ্যমান ও প্রস্তাবিত বহুতল ভবন বা বাণিজ্যিক ভবনের ছাড়পত্র প্রদান করে থাকে। সেবা গ্রহণকারীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে পরিদর্শন প্রতিবেদন এবং সেফটি প্ল্যান যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে নির্ধারিত নিরাপত্তা শর্ত পূরণ সাপেক্ষে এসব ছাড়পত্র প্রদান করা হয়।
২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যমান বহুতল ভবন বা বাণিজ্যিক ভবনের মধ্যে ১৩৯৭টি আবেদনের বিপরীতে ১০৯০টিকে ছাড়পত্র দেয় প্রতিষ্ঠানটি। বাকি ৩০৭টি আবেদন ফেরত দেওয়া হয়। একই সময়ে প্রস্তাবিত বহুতল ভবন বা বাণিজ্যিক ভবনের ১১৯২টি আবেদন যাচাই-বাছাই করে ৯৫৫টিকে ছাড়পত্র দেয় ফায়ার সার্ভিস। বাকি ২৩৭টিকে ফেরত দেওয়া হয়
রাজউকের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) জরিপ অনুযায়ী, সংস্থাটির আওতাধীন এলাকায় (ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, সাভার উপজেলা, কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের আংশিক) প্রায় ২১ লাখ ৪৫ হাজার স্থাপনা আছে।
২০১০ সালে প্রথম ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। পরে ২০১৬ সালে তালিকাটি হালনাগাদ করে রাজউক। তাদের তথ্য অনুযায়ী— রাজধানীতে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা ৩২১টি। এর মধ্যে বিধিবিধান লঙ্ঘন করে নির্মিত ভবন রয়েছে ৫ হাজার। অতি ঝুঁকিপূর্ণ ৩২১টি ভবনের বেশিরভাগই রয়েছে পুরান ঢাকায়। তাদের হিসেবেও নেই রেস্তোরাঁ বা রেস্টুরেন্টের সংখ্যা।
২০১৯ সালের ২৫ জুন তৎকালীন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম পরিবেশবান্ধব আবাসিক এলাকা তৈরি করতে রাজধানী ঢাকার অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন পর্যায়ক্রমে ভেঙে ফেলা হবে বলে জানিয়েছিলেন। তখন ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে এক হাজার ৮১৮টি ভবন তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ফায়ার সার্ভিসের মূল কাজ অগ্নিনির্বাপণ, অগ্নিপ্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করা এবং যেকোনো দুর্ঘটনা বা দুর্যোগে অনুসন্ধান ও উদ্ধারকার্য পরিচালনা। এছাড়া দুর্ঘটনা ও দুর্যোগে আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান, গুরুতর আহতদের দ্রুত হাসপাতালে প্রেরণ এবং রোগীদের অ্যাম্বুলেন্স সেবা প্রদান, অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়পূর্বক অগ্নিদুর্ঘটনাসহ যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলা ও জান-মালের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা; বহুতল ভবন, বাণিজ্যিক ভবন, শিল্প কারখানা ও বস্তি এলাকায় অগ্নিদুর্ঘটনা রোধকল্পে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, পরামর্শ প্রদান ও মহড়া পরিচালনা করা; বহুতল ভবনের অগ্নিনিরাপত্তামূলক ছাড়পত্র প্রদান ও ছাড়পত্রের শর্তগুলো বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা আমাদের কাজ। অনেকে অনেক কথা বলেন। কিন্তু আমরা সবসময় চুপচাপ থেকে নিজেদের কাজটা করে যাওয়ার চেষ্টা করছি।
তিনি বলেন, ঢাকায় অসংখ্য আবাসিক ভবনের অনুমতি নিয়ে বাণিজ্যিক করা হয়েছে। এসব বন্ধ করতে হবে। যথাযথ প্রক্রিয়া ও ফায়ার সেফটি রীতি অনুসরণ না করে গড়ে তোলা হোটেল রেস্তোরাঁ-রেস্টুরেন্টের ব্যাপারে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবি।
তিনি আরও বলেন, ঢাকাসহ সারা দেশের অগ্নিঝুঁকিতে থাকা ভবনগুলোর হোটেল রেস্তোরাঁর তালিকা করছি। শিগগিরই সে তালিকা ধরে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেব কোথা?
ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা(নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, ঢাকা শহরে যত অবৈধ, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে সেগুলো দিনের পর দিন কীভাবে চলছে? এটা সবারই জানা। গত বছর দুই শতাধিক ভবনকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের ভবনকেও তিনবার নোটিশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তোয়াক্কা করা হয়নি। এত প্রাণহানিতেও টনক যদি না নড়ে তাহলে সামনের দিনগুলোতে অবস্থা আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে।
তিনি বলেন, পুরান ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের কথা বলতে বলতে কথাই পুরান হয়ে গেছে। আপনি ধানমন্ডি, খিলগাঁও, বনানী, বেইলি রোড, মতিঝিল, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, উত্তরার অবস্থা দেখেন। কত কত রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছে? যার অধিকাংশই অবৈধভাবে হয়েছে। আবাসিক ভবনের অনুমতি নিয়ে বাণিজ্যিক কারবার চলছে। সামগ্রিক চিত্র ভয়াবহ, অবস্থা এমন যে সর্বাঙ্গে ব্যথা, ঔষধ দেবেন কোথায়!
আগুনের কারণ বৈদ্যুতিক গোলযোগ ও বিড়ি-সিগারেট
ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান বলছে, গত ২০২৩ সালে সারা দেশে ২৭ হাজার ৬২৪টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। গড়ে দিনে ৭৭টি আগুনের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। এসব আগুনের মধ্যে সর্বোচ্চ আগুন বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে, এরপরই বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরো, চুলা এবং গ্যাসের লাইন থেকে আগুনের ঘটনা বেশি ঘটেছে। এসব আগুনের ঘটনায় সারা দেশে ২৮১ জন আহত ও ১০২ জন নিহত হয়েছেন। সেই সঙ্গে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৭৯২ কোটি ৩৬ লাখ ৮২ হাজার ১৪ টাকা সম্পদের ক্ষতি হয়েছে।
এ ছাড়া, ফায়ার সার্ভিস আগুন নির্বাপণের মাধ্যমে এক হাজার ৮০৮ কোটি ৫৩ লাখ ৫০ হাজার ৩২৯ টাকার সম্পদ রক্ষা করে। এছাড়া অগ্নিকাণ্ডে সারা দেশে ২৮১ জন আহত ও ১০২ জন নিহত হন।
মামলা হলেও সাজার কোনো নজির নেই
শিক্ষাগ্রহণ ও সতর্ক না হওয়া এবং তদন্তের সুপারিশ পূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়ায় বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে জানিয়েছেন মানবাধিবার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ।
গত ২০২৩ সালে সারা দেশে ২৭ হাজার ৬২৪টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। গড়ে দিনে ৭৭টি আগুনের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। এসব আগুনের মধ্যে সর্বোচ্চ আগুন বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে, এরপরই বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরো, চুলা এবং গ্যাসের লাইন থেকে আগুনের ঘটনা বেশি ঘটেছে। এসব আগুনের ঘটনায় সারা দেশে ২৮১ জন আহত ও ১০২ জন নিহত হয়েছেন। সেই সঙ্গে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৭৯২ কোটি ৩৬ লাখ ৮২ হাজার ১৪ টাকা সম্পদের ক্ষতি হয়েছে
তিনি বলেন, প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের পর একাধিক সংস্থা তদন্ত কমিটি গঠন করে। শুরু হয় নানা রকম আলোচনা। আগুনের সূত্রপাত, ক্ষয়ক্ষতির হিসাব ও বেশ কিছু সুপারিশ সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পৌঁছায়। কিন্তু মাস ঘুরে বছর যায়, সেই সুপারিশ আর বাস্তবায়ন হয় না। সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতায় একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মামলা হয়নি। আবার দু’ একটি ক্ষেত্রে মামলা হলেও সাজার কোনো নজির নেই! অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়ীদের চিহ্নিত করা হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
তিনি বলেন, অগ্নিনির্বাপণ বিশেষজ্ঞদের মতে— বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলোর তদন্ত প্রতিবেদন ফাইলবন্দি থেকে যায় বছরের পর বছর। কমিটির সুপারিশগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আলোর মুখ দেখে না। কমিশন মনে করে— অগ্নিনির্বাপণে শুধু দমকল বিভাগ নয়, পানি-গ্যাস-বিদ্যুৎ পরিষেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান, পুলিশ, সশস্ত্র বাহিনী এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতাধীন দপ্তরগুলোর সমন্বয়ের প্রয়োজন রয়েছে। এসব বিভাগ সমন্বিতভাবে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণ মোকাবিলায় একটি রূপরেখা তৈরি করে, সে অনুসারে অগ্নিনির্বাপণ কর্মকাণ্ড সমন্বয় করতে কেন ব্যর্থ হচ্ছে সেটি বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
জেইউ/এমজে