অগ্নি নিরাপত্তায় সংশ্লিষ্টদের ভূমিকা নিয়ে মানবাধিকার কমিশন
শুধু নোটিশ দেওয়াই কি তাদের কাজ?
ধারাবাহিক অগ্নিকাণ্ডে সংশ্লিষ্টদের গাফিলতি মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে মন্তব্য করেছেন মানবাধিবার কমিশন চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেছেন, বেইলি রোডের ভবনটিতে বাণিজ্যিক অনুমোদন নেওয়ার ক্ষেত্রেও প্রভাবশালী মহলের চাপ ছিল বলে শোনা যাচ্ছে। যে কারণে ভবনটিকে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনায় শর্ত সাপেক্ষে অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে বাণিজ্যিক ব্যবহার ও রেস্তোরাঁ পরিচালনা দুটি ভিন্ন ব্যবহার। যেখানে মাত্র একটি সিঁড়ি, এমন একটি ভবনে রেস্তোরাঁ চলতে পারার কথা না। তাহলে রাষ্ট্রীয় সংস্থা হিসেবে রাজউক, ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশন তাদের ভূমিকা কী কেবল নোটিশ দেওয়া?
তিনি বলেন, যারা প্রভাবশালী তারা কী এতোগুলো মানুষের জীবনের চেয়েও প্রভাবশালী? তারা কীভাবে দিনের পর দিন এগুলোর পুনরাবৃত্তি করছেন? এতো দুর্ঘটনার পরও কী রাষ্ট্রের টনক নড়বে না?
বিজ্ঞাপন
রোববার (৩ মার্চ) বিকেল ৩টায় নিজ কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি।
মানবাধিবার কমিশন চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে অগ্নিদগ্ধ ও বিষাক্ত কার্বন মনোঅক্সাইডের ধোঁয়ায় শ্বাসরোধ হয়ে ৪৬ জনের মৃত্যুর ঘটনার মধ্য দিয়ে সামগ্রিক গাফিলতির আরেকটি উদাহরণ আবার সামনে এলো। অগ্নিকাণ্ড বা দুর্ঘটনা একটি আকস্মিত ও সহজাত বিষয়। এটি ঘটতেই পারে। বিশ্বের অনেক বড় বড় শহরেও অগ্নিকাণ্ড হয়, কিন্তু ঢাকার সংগঠিত অগ্নিকাণ্ডের মতো নির্মমতা থাকে না।
অগ্নিকাণ্ডে মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনা আঁতকে উঠার মতো। কারণ এদেশে নগর উন্নয়নের জন্য পৃথক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, রয়েছে সেবাসুবিধা নিশ্চিত করার মত প্রতিষ্ঠানও। নাগরিক সুবিধাসমূহ প্রদানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এসব প্রতিষ্ঠান কাগজে কলমে বেশ সক্রিয় এবং বেশ কঠোরও। দেশে ভবন নির্মাণ ও ব্যবহারের জন্য আইন আছে, ফায়ার সেফটি সম্পর্কিত আইনও যথেষ্ট রয়েছে; অগ্নিকাণ্ড বিষয়ে দেশে মোট ২২টি আইন এবং হাইকোর্টের একটি জাজমেন্ট রয়েছে। এই ২২টি আইনের মধ্যে ১৩টি মৌলিক আইন এবং ৯টি হল সাব-অর্ডিনেট। কিন্তু সেগুলো কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
তিনি বলেন, বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের মৃত্যু প্রসঙ্গে কাঠামো প্রকৌশলী ও অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন- এটি অবহেলাজনিত ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। কারণ এই ভবনগুলোর জন্য আটটি সরকারি সংস্থার অনুমোদন প্রয়োজন (জেলা প্রশাসন, রাজউক, সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদফতর, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও বিস্ফোরক অধিদপ্তর)। প্রতিটি সংস্থার বিরুদ্ধে দায়িত্বের অবহেলার কারণে হত্যার অভিযোগ আনা যেতেই পারে। কেউ কেউ এই ঘটনাকে কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড মনে করছেন। এটা দুর্ঘটনা নয়, এর পেছনে অনেক ধরনের গাফিলতি জড়িত। এ পরিস্থিতির খুব দ্রুত পরিবর্তন এবং আপাতদৃষ্টে একটি নিরাপদ নগরে পরিণত হবে ঢাকা এমন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।
আরও পড়ুন
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর বেইলি রোডের ওই ভবনে যারা খেতে গিয়েছিলেন বা কোনো কাজে গিয়েছিলেন, তারা রাষ্ট্রের উপর ভরসা করেছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই ভরসা করাটা কি অপরাধ? কারণ, রাষ্ট্র ওই ভবনের অনুমোদন দিয়েছে। জনগণের নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র তার সংস্থাগুলোর মাধ্যমে মূলত অনুমোদন দেয়, নোটিশের কিছু কাগজ তৈরি করে। কিন্তু পৃথিবীতে যেসব শহরে সুশাসন এবং মানুষের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত, সেখানকার সংস্থাগুলো শুধু কাগজ তৈরি করে না; নিয়মিত পরিদর্শন করে, কারো দোষ পেলে শাস্তি দেয়।
তিনি বলেন, অনিরাপদ অবস্থায় ভবন পরিচালিত হবে, সেখানে মানুষ যাবে এবং আগুন লাগলে মারা যাবে, এটা কোনোভাবেই অনুমোদন দেয় না তারা। যখনই অনিয়ম পায়, দৃষ্টান্তমূলক শান্তি দেয়। আমাদের সেই সংস্কৃতি তৈরি হয়নি বরং অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন মালিক ও প্রভাবশালীরা সংস্থাগুলোকে ম্যানেজ করে ফেলে। যারা প্রভাবশালী, তারা কী এতোগুলো মানুষের জীবনের চেয়েও প্রভাবশালী? তারা কীভাবে দিনের পর দিন এগুলোর পুনরাবৃত্তি করছেন? এত দুর্ঘটনার পরও কী রাষ্ট্রের টনক নড়বে না?
সাবেক এ স্বরাষ্ট্র সচিব বলেন, অগ্নিনিরাপত্তা জোরদারে লক্ষ্যে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন শর্ত মেনে বহুতল ভবন ও বাণিজ্যিক ভবনের ছাড়পত্র প্রদান করে থাকে। সংস্থাটির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে গত ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে বিদ্যমান বহুতল ও বাণিজ্যিক ভবনের আবেদন পাওয়া যায় ১৩৯৭টি; সংস্থাটি ছাড়পত্র দেয় ১০৯০টি ভবনের। বাকি ৩০৭টি ভবনের বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিবেদনে কিছু উল্লেখ করেনি। পাশাপাশি, প্রস্তাবিত বহুতল ও বাণিজ্যিক ভবনের আবেদন আসে ১১৯০টি; কর্তৃপক্ষ ছাড়পত্র প্রদান করে নির্মাণের অনুমোদন দেয় ৯৫৫টি ভবনের। অনুমোদন ছাড়া ভবন নির্মিত হওয়া বা বিদ্যমান ভবনে ছাড়পত্র প্রদান না হওয়ার অর্থ দাঁড়ায় ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ। এ বিষয়ে সংস্থাটি কি কার্যক্রম নিয়েছে তা তাদের প্রতিবেদনে নেই।
কমিশন চেয়ারম্যান বলেন, চুড়িহাট্টার ঘটনার এত বছর পরও পুরান ঢাকার রাসায়নিক গুদামগুলো পুরোপুরি সরানো যায়নি। অথচ অন্য ক্ষেত্রে ঢাকার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ অনেক উড়ালসড়ক হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে আমরা সফল হতে পারলাম। কিন্তু রাসায়নিক গুদাম, যার সঙ্গে জীবনের নিরাপত্তা ভয়ংকরভাবে জড়িত, যেখানে অনেকগুলো অগ্নিকাণ্ডের মুখোমুখি হয়েছি, সে ক্ষেত্রে কেন পারলাম না?
ঢাকা এতোটাই অপরিকল্পিত যে এখানে পুরোপুরি পরিকল্পিত নগরায়ণ সম্ভব নয় উল্লেখ করে ড. কামাল উদ্দিন বলেন, কিন্তু যেটা সম্ভব, সেটা হচ্ছে ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন; যার মাধ্যমে অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে যে ক্ষতি হয়েছে, সেটাকে তুলনামূলক কিছুটা কমিয়ে আনা। এর জন্য প্রতিটি সংস্থা তার নজরদারি কার্যক্রমগুলো নিশ্চিত করবে। কিন্তু এর জন্য যে ধরনের অভিযান দরকার, সেটার অনুপস্থিতি আছে। সরকার জিরো টলারেন্স মুখে বললেও সংস্থাগুলো পরিচালনায় বিভিন্ন পর্যায়ে যারা যুক্ত, তাদের অনেকে অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। এ ধরনের ঘটনায় জমি বা ভবনের মালিক থেকে শুরু করে সরকারি সংশ্লিষ্ট সংস্থার কারা দায়ী, তাদের শনাক্ত করে শাস্তির আওতায় আনার দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে।
ভবনের মিশ্র ব্যবহার সম্পর্কে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, অনুমোদনের ক্ষেত্রে আরও ভাবা দরকার। ভবনে আলো-বাতাস প্রবাহের সুযোগ না রেখে কাচ দিয়ে ঘিরে পুরো ভবনকে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত করা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে বিপদকে যেভাবে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে, সেটা পেশাজীবী, স্থপতি, প্রকৌশলী ও পরিকল্পনাবিদ-সবাইকে নতুন করে ভাবতে হবে। পাশাপাশি, আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক রেস্ট্যুরেন্ট পরিচালনায় বাণিজ্যিকভাবে সিলিন্ডার ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকা উচিত ছিল; তদারকিতে থাকা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এর দায় এড়াতে পারে না।
বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজের দ্বিতীয় তলায় থাকা কাচ্চিভাই রেস্টুরেন্টে কোনো জানালা ছিল না, ভবনের সিঁড়িতেই গ্যাস সিলিন্ডার রাখা ছিল। ফলে দুর্ঘটনায় আটকে পড়া মানুষজনের সিঁড়ি দিয়ে উঠানামাই কঠিন হয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, প্রাথমিকভাবে মুত্যুবরণকারী ৩৫ জনের মৃতদেহে কোনো পোড়া-কাটা ছিল না; কারণ তারা সবাই বিষাক্ত কার্বন মনোঅক্সাইড গ্যাসের কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন।
জেইউ/পিএইচ