সরু সড়কের পাশে ৭ তলা আবাসিক ভবন। পুরো ভবনটিই ব্যবহৃত হচ্ছে ব্যবসায়িক কাজে। নিচতলায় কাপড়ের শো-রুম আর উপরে সবগুলো ফ্লোরে রেস্তোরাঁ ও ফাস্টফুডের দোকান। বাদ যায়নি ছাদও—সেখানে গড়া হয়েছে রুফটপ রেস্তোরাঁ! পুরো ভবনজুড়ে নেই আগুন নেভানোর কোনো ব্যবস্থা। নেই কোনো ইমার্জেন্সি এক্সিট।

রাজধানীর খিলগাঁও তালতলা এলাকার সি ব্লকের ৯১৯/১ নম্বর বাড়ির চিত্র এটি। এই ভবনের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা দেখে আঁতকে উঠেছেন খোদ ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা।

দুদিন আগে রাজধানীর বেইলি রোডে বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ডে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনার পর শনিবার (২ মার্চ) তালতলার ওই ভবনে অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখতে যান ফায়ার সার্ভিসের খিলগাঁও জোনের কর্মকর্তারা।

পরিদর্শন দলের নেতৃত্ব দেন সিনিয়র স্টেশন অফিসার আরিফ উল ইসলাম। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, এটি আমাদের আকস্মিক পরিদর্শন নয় বরং নিয়মিত পরিদর্শনের অংশ। এটি একটি আবাসিক ভবন। এই ভবনে ফায়ার সেফটি বলতে কিছুই নেই। পানির রিজার্ভারও তেমন নেই। পরিদর্শনের পর আমরা তাদের বলে এসেছি দ্রুত অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা স্থাপন করার জন্য। কিছুদিন সময় দিয়েছি। এর মধ্যে যদি তারা ব্যবস্থা না নেন তাহলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ভয়াবহ এমন চিত্র পুরো খিলগাঁও এলাকার অধিকাংশ রেস্টুরেন্টের। যে যেভাবে পেরেছেন ইচ্ছেমতো ফুডকোর্ট ও রেস্টুরেন্ট নির্মাণ করেছেন। এসব রেস্টুরেন্টে অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থার কোনো বালাই নেই।

এখানকার আরেকটি ভবনে দেখা যায়, নিচতলায় দোকান, দ্বিতীয় তলায় স্কুল, তৃতীয় তলায় রেস্টুরেন্ট এবং ছাদে বনানো হয়েছে রুফটপ রেস্তোরাঁ। নিয়মের তোয়াক্কা না করে যত্রতত্র তৈরি করা হয় এসব ফুডাকোর্ট।

খিলগাঁওয়ের বি ব্লকের ৯ তলা একটি ভবনের ৮ তলা জুড়ে দেখা গেছে অনেকগুলো রেস্তোরা। ৩৬৮ নম্বর ওই বাড়িটিতে রয়েছে ডিগার, ২৪ কে, ডি নভো, টাইম স্কয়ার ডাইন, গ্রান্ড হাউজ, কশফিয়াসহ আরো বেশ কয়েকটি রেস্টুরেন্ট। ওই ভবনে একটিমাত্র সরু সিঁড়ি রয়েছে। যেকোনো দুর্ঘটনায় দ্রুত বের হওয়ার জন্য কোনো ইমার্জেন্সি এক্সিট পয়েন্ট নেই।

নাঈম হাসান নামে স্থানীয় এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘ব্যাঙের ছাতার মতো যে যেভাবে পেরেছেন রেস্টুরেন্ট গড়ে তুলেছেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আমরা সম্প্রতি বেইলি রোডে যে ঘটনা দেখেছি সেখানে যদি বের হওয়ার জায়গা থাকত তাহলে হয়তো আরো কম প্রাণহানি হতো। তাই এসব সমস্যা সমাধানে কর্তৃপক্ষের যথাযথ নজর দেওয়া দরকার।’

আব্দুর রহমান নামে এক বাসিন্দা বলেন, ‘আমি যে বাসায় ভাড়া থাকি সেটির দ্বিতীয় তলায় রেস্টুরেন্ট। একটা মাত্র সিঁড়ি। যদি কখনো দ্বিতীয় তলায় আগুনের সূত্রপাত হয় তাহলে উপর থেকে আমরা কীভাবে নিচে নামব সেটি জানি না। বাড়ির মালিকের সঙ্গে তো আমরা পারব না। এ বিষয়গুলো যাদের দেখা দরকার তারা চুপ করে আছেন। দুর্ঘটনা ঘটলেই কেবল কিছুদিন এসব বিষয়ে কথাবার্তা হয়। পরে আবার আগের মতো হয়ে যায়। এখানে এমন অসংখ্য রেস্টুরেন্ট রয়েছে যাদের অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। তাই দুর্ঘটনা ঘটার আগেই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ভবনের মালিক বলেন, ‘কিছু লোভী বাড়িওয়ালা এসব কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের কারণে আমাদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আপনার যদি রেস্টুরেন্ট বানাতে ইচ্ছা করে তাহলে সেটা কেন আবাসিক ভবনে করবেন। আর করলেও পর্যাপ্ত অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। এখনও সময় আছে, আমরা চাইলে এই বিষয়গুলো শুধরে নিতে পারি। পরে দুর্ঘটনা ঘটলে সবারই ক্ষতি হবে।’

এদিকে বেইলি রোডের দুর্ঘটনার পর রেস্টুরেন্ট ও ফুডকোর্টে মানুষের উপস্থিতি কমে গেছে বলে জানিয়েছেন তালতলার বিভিন্ন রেস্টুরেন্টের একাধিক কর্মচারী। নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মচারী বলেন, ‘রেস্টুরেন্ট ও ফুড কোর্টের অধিকাংশ ক্রেতাই শিক্ষার্থী কিংবা তরুণ-তরুণী। বেইলি রোডে আগুনের ঘটনার পর ক্রেতা কমেছে। আগে সারাদিনই মানুষের সমাগম থাকত। এখন বলতে গেলে এক প্রকার ফাঁকাই থাকে সারাদিন। বিকেলে ও রাতে কিছু মানুষ আসেন। মানুষের মধ্যে একটা ভয় কাজ করছে।’

খিলগাঁও-তালতলা ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. শাহ আলম বলেন, ‘এসব ভবন আবাসিক সেটা ঠিক, কিন্তু বাণিজ্যিক করার জন্য আমরা আবেদন দিয়ে রেখেছি। এখনো সেটি প্রক্রিয়াধীন। শিগগিরই এসব বিষয়ে সবাইকে নিয়ে বসে কার্যকর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যাপ্ত না রাখলে সেটি আমাদেরই ক্ষতি। আমরা বড় ধরনের কোনো ঝামেলার মুখোমুখি হতে চাই না। ফায়ার সার্ভিসের যারা কর্মকর্তা আছেন তাদের সঙ্গেও আমরা কথা বলেছি। সব মালিকদের সঙ্গে বসে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

আরএইচটি/এমএসএ/এমজে