ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার শিমরাইল সাতপাড়া এলাকার বাসিন্দা মোস্তফা কামাল ওরফে উজ্জ্বল ওরফে জুয়েল রানা (৩১)। তার স্ত্রী প্রমি আক্তার (২৫)। স্বামী-স্ত্রী  মিলে গড়ে তুলেছেন শিশু অপহরণ চক্র। এই দম্পতি রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ফ্ল্যাট বাসায় সাবলেট ভাড়া নিয়ে কৌশলে বিভিন্ন পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে শিশু অপহরণ করে আসছিল।

২০২৩ সালের ১৮ নভেম্বর রাজধানীর মিরপুরের পল্লবী এলাকায় একই কৌশলে মাদ্রাসা পড়ুয়া এক শিশুকে অপহরণের ঘটনায় দায়ের করা মামলা তদন্তে নেমে তাদের সন্ধান পায় ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) মিরপুর বিভাগের পল্লবী জোনাল টিম।

প্রায় তিন মাসের চেষ্টায় গোয়েন্দা পুলিশের কৌশলের কাছে হার মেনে তারা দুজনেই গ্রেপ্তার হয়েছেন। প্রথমে প্রমি আক্তারকে গ্রেপ্তার করা হয়। আর সর্বশেষ রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় অভিযান চালিয়ে মোস্তফা কামালকে গ্রেপ্তার করা হয়। স্ত্রী প্রমি গ্রেপ্তারের দুই মাস পর গত ২৮ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার হন মোস্তফা কামাল।

গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, স্বামী-স্ত্রীর এই অপহরণকারী চক্র দীর্ঘদিন ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে সক্ষম হয়। তাদের অপহরণের হাত থেকে রক্ষা পায়নি পরিবারের সদস্যরা।

গোয়েন্দা পুলিশের মিরপুর বিভাগের পল্লবী জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) রাশেদ হাসান জানান, অপহরণ চক্রের মাস্টারমাইন্ড মোস্তফা কামাল ও তার স্ত্রী প্রমি মিলে দীর্ঘ দিন ধরে অপহরণ করে আসছিলেন। তারা বিভিন্নভাবে মানুষের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে আবার কখনো ফ্ল্যাট বাসায় সাবলেট হিসেবে উঠে টার্গেট করা শিশুদের অপহরণ করেন। এমনকি তাদের অপহরণের তালিকায় পরিবারের সদস্যরাও আছে। এছাড়াও মোস্তফার বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগও রয়েছে।

মিরপুরের পল্লবী এলাকার বায়তুল রাসুল (সা.) মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ইয়াসিন আরাফাত নামে ৯ বছরের এক শিশুকে অপহরণের ঘটনার দীর্ঘ তিন মাস পর গ্রেপ্তার হন তারা।

এ বিষয়ে এডিসি রাশেদ বলেন, মিরপুরে পল্লবী থানার সেকশন ৭ নম্বর এলাকায় ইয়াসিনের পরিবার একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকে। এই ঘটনার ৫ মাস আগে মোস্তফা কামাল ও প্রমি সাবলেট ভাড়ায় ওঠেন। তারা আগে থেকে টার্গেট করে বাসা ভাড়া নেয়। এই সময়ে পরিবারটির সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে অপহরণ পরিকল্পনা সাজায়।

গত বছরের ২৮ নভেম্বর খেলনা কিনে দেওয়ার কথা বলে শিশু ইয়াসিন আরাফাতকে অপহরণ করে। এরপর রাজধানীর ভাটারা, বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন এলাকায় স্থান পরিবর্তন করে। অপহরণের পুরো প্রক্রিয়ায় মোস্তফাকে সহযোগিতা করে তার স্ত্রী প্রমি। অপহরণের পর তারা ভাটারা এলাকার একটি বস্তিতে বাসা ভাড়া নিয়ে অবস্থান করছিল। এই সময়ে নানা কৌশলে শিশুটিকে তাদের সঙ্গে রাখে। আর অন্য দিকে শিশু ইয়াসিনের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে হুমকি ধমকি দিয়ে ১ লাখ ১৭ হাজার টাকা আদায় করে। তবে টাকা আদায় করলেও শিশু ইয়াসিনকে ফেরত দেয়নি অপহরণকারীরা।

রাশেদ হাসান আরও বলেন, ঘটনার পর থেকে অপহরণকারীদের গ্রেপ্তার করতে মাঠে নামে গোয়েন্দা পুলিশ। তবে বারবার স্থান পরিবর্তন করায় তাদের গ্রেপ্তার করতে বেগ পেতে হচ্ছিল। এমনকি গোয়েন্দা পুলিশের তৎপরতা টের পেয়ে রাস্তায় শিশুটিকে ফেলে পালিয়ে যায় তারা।

তিনি বলেন, শিশুটিকে উদ্ধার করলেও আমরা থামিনি। দীর্ঘদিন এই চক্রের পেছনে লেগেছিলাম। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ধারাবাহিক অভিযান চালিয়েছি। বেশ কয়েকবার আমাদের ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যায়। 

মোস্তফাকে ধরতে অভিযানের পর অভিযান

গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ভাটারা থানার আওতাধীন নদ্দার নাসিরটেক এলাকায় অভিযান চালানো হয়। কিন্তু স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে সটকে পড়েন মোস্তফা কামাল। পরে কুমিল্লার উদ্দেশে পালানোর সময়ে সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড ও মেয়র হানিফ ফ্লাই ওভারের যাত্রাবাড়ী টোল প্লাজা অভিযান চালানো হয়। তখনও পুলিশের উপস্থিতি টের যাত্রা বাতিল করেন তারা।

গোয়েন্দা তথ্য ও প্রযুক্তির সহায়তায় ১১ ডিসেম্বর ভাটার থানার ছোলমাইদ এলাকায় অভিযান চালায় গোয়েন্দারা। ওই বার মোস্তফার স্ত্রী প্রমি গ্রেপ্তার হলেও পালাতে সক্ষম হন মোস্তফা। পরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা থানার শিমরাইল সাতপাড়া এলাকায় ভোর রাতে অভিযান চালিয়ে মোস্তফা কামাল গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হই।

মোস্তাফার বরাত দিয়ে গোয়েন্দা পুলিশের এডিসি রাশেদ বলেন, প্রযুক্তিগত নানা বিষয়ে দক্ষ মোস্তফা একটি ফোন ও সিম একবারের বেশি ব্যবহার করে না। আর বারবার স্থান পরিবর্তন করে। ফলে অপহরণের পর তাকে গ্রেপ্তারে বারবার অভিযান চালিয়েও ব্যর্থ হতে হয়েছে। তার কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ সিম উদ্ধার করা হয়েছে। সবই বেনামি। এছাড়া তাদের দুজনের জাতীয় পরিচয়পত্রও ভুয়া। সার্ভারে না থাকলেও তারা অন্যের তথ্য ব্যবহার করে কম্পিউটারের দোকান থেকে জাতীয় পরিচয় পত্র বানিয়ে ব্যবহার করে আসছিল। শিশু ইয়াসিনকে অপহরণের পর তারা শিশুকে নিয়ে কমলাপুর এলাকাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় রাস্তায় রাস্তায় অবস্থান করেছে। পরে ভাটারা এলাকার একটি বস্তিতে বাসা ভাড়া নেয়। যদিও তারা একটি বাসায় বেশি দিন অবস্থান করত না।

তিনি বলেন, এই স্বামী-স্ত্রীর পেশা অপহরণ করা। যদিও মোস্তফার দাবি এক সময়ে ব্যবসা করতেন। তবে আমরা এমন কোনো প্রমাণ পাইনি। এমনকি তারা দুজনে মিলে প্রমির বড় ভাইয়ের মেয়েকে অপহরণ করেছিল। সেই মেয়েকে জিম্মি করে দুই লাখ টাকা আদায় করেছে। দুজনের বিরুদ্ধে একাধিক অপহরণ মামলা রয়েছে। মোস্তফার বিরুদ্ধে পবিত্র কোরআন ছিঁড়ে রাস্তায় ফেলে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এই ঘটনায় মামলা হলেও তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে গ্রেপ্তার করতে বেগ পেতে হয়। এমনকি সে কয়েকটি সংস্থাকে ওপেন চ্যালেঞ্জ করেছিল। যদিও পরে একটি সংস্থার হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিল।

জেইউ/এসকেডি