পাসপোর্ট জালিয়াতি
কুলি থেকে কোটি টাকার বাড়ি-ফ্ল্যাট, রাজউকে প্লট রাজু শেখের
রাজু শেখের বাবা ছিলেন কারওয়ান বাজারের কুলি। টানতেন তরকারির বস্তা। অভাবের সংসারে খরচ জোগাতে নিজেও বাবার সঙ্গে করতেন কুলির কাজ। তবে হঠাৎ করেই বদলে যায় তার জীবন। কয়েক বছরের ব্যবধানে গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জে গড়ে তুলেছেন কোটি টাকা মূল্যের বাড়ি, উত্তরায় কিনেছেন ১৬০০ স্কয়ার ফিটের বিলাসবহুল ফ্ল্যাট এবং রাজউকে নিয়েছেন ৬ কাঠার প্লট।
শুনতে অনেকটা আলাদীনের চেরাগের দৈত্যের তিন ইচ্ছা পূরণের কাল্পনিক গল্প মনে হলেও এটিই সত্য। মূলত, দাগী অপরাধী, আসামি, অবাঙালি এবং রোহিঙ্গাদের জাল জন্ম নিবন্ধন, জাল জাতীয় পরিচয়পত্র এবং ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে রাজু শেখ বানিয়ে দিতেন পাসপোর্ট। নিতেন মোটা অঙ্কের টাকা। আর এভাবেই ধীরে ধীরে আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়েছেন তিনি। তবে এই কাজে রাজু শেখ একা নয় বরং তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিরাট এক চক্র।
বিজ্ঞাপন
ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) দীর্ঘ তিন মাসের কঠোর অনুসন্ধান শেষে এই চক্রের ২৩ সদস্যকে ধরতে সক্ষম হয়েছেন তারা। এর মধ্যেই রয়েছেন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষও। যারা পাসপোর্ট করার জন্য ঢাকায় এসেছিলেন।
গ্রেপ্তারদের মধ্যে রোহিঙ্গারা হলেন— উম্মে ছলিমা ওরফে ছমিরা, মরিজান ও রশিদুল। রোহিঙ্গা দালাল আইয়ুব আলী ও মোস্তাকিম। আনসার সদস্য দুজন হলেন, জামসেদুল ইসলাম ও মো. রায়হান।
দেশি দালালদের অন্যতম রাজু শেখ, অন্যরা হলেন— শাওন হোসেন ওরফে নিলয়, ফিরোজ হোসেন, তুষার মিয়া।
জিজ্ঞাসাবাদে রাজু শেখ
গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রাজু শেখের বাবার নাম শাহজাহান। তিনি কারওয়ান বাজারে তরকারির বস্তা টানতেন। অভাবের সংসারে পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে বাবার সঙ্গে তিনিও করতেন কুলির কাজ।
শেখ রাজুকে জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগের প্রধান অতিরিক্ত ডিআইজি মশিউর রহমান বলেন, গোপালগঞ্জে কোটি টাকা খরচ করে বাড়ি করেছেন রাজু শেখ, উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরে কিনেছেন ১৬০০ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাট। কিনেছেন পূর্বাচলের ৬ কাঠার একটি প্লটও।
আরও পড়ুন
পাসপোর্ট জালিয়াতি কার্যক্রমের ধারাবাহিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে রাজু বলেন, পাসপোর্ট অফিসের সামনেই আমাদের দোকান। সেখানে প্রতিদিন ১০-১৫ জন বাঙালি ফরম পূরণের জন্য আসেন। তখন কৌশলে দীর্ঘ সময় তাদেরকে এখানে বসিয়ে রাখি। এভাবে যখন ৯-১০ টি ফাইল জমা হয় তখন তাদের সঙ্গে ৩ জন রোহিঙ্গার ফাইল মিলিয়ে পাসপোর্টের জন্য জমা দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, কোনোভাবেই যেন ভেতরে কেউ বুঝতে না পারেন, সেজন্য বারবার এসব রোহিঙ্গাদের নাম-পরিচয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সবাইকে নির্দেশনা দেওয়া হয় যেন সবাই একসঙ্গে থাকেন। মানসিকভাবে শক্ত থাকার জন্য এবং কোনোভাবেই যেন এই সার্কেল থেকে বাইরে বেরিয়ে না আসেন, সেজন্য রোহিঙ্গাদের বারবার সতর্ক করে দেওয়া হয়।
জাল নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে স্বাক্ষর দেওয়ার জন্যও আগে-ভাগেই দেওয়া হয় ট্রেনিং। একইসঙ্গে ওই রোহিঙ্গার কথায় যেন চট্টগ্রাম অঞ্চলের আঞ্চলিকতার কোনো টান বা উপস্থিতি না আসে, সেটিও নিশ্চিত করা হয়।
প্রায় তিন বছর ধরে এভাবেই অসংখ্য রোহিঙ্গার হাতে বাংলাদেশের পাসপোর্ট তুলে দিয়েছেন রাজু শেখ।
মশিউর রহমান আরও বলেন, ২০১৬ সাল থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্ম নিবন্ধন এবং পাসপোর্ট জালিয়াতির কাজে জড়ান রাজু শেখ। এর মধ্যে গত ৩ বছর ধরে এসব বিষয়ে অবৈধ কার্যক্রমগুলোও করে আসছেন তিনি। অবৈধ কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে, দাগী আসামি কিংবা যারা বড় অপরাধ করেছেন, তাদের নাম পরিবর্তন করে পাসপোর্ট বানিয়ে দেওয়া। আবার বাংলাদেশের নাগরিক নয় এমন কেউ কিংবা কক্সবাজারের রোহিঙ্গাদেরও নাম পরিবর্তন করে জন্ম নিবন্ধন, জাতীয় পরিচয় পত্র এবং পাসপোর্ট বানিয়ে দেওয়া।
আর এসব ক্ষেত্রে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা জোগাড় করে দেয় চট্টগ্রাম, বান্দরবান, খাগড়াছড়ির এজেন্টরা। তাদেরকে নিয়ে আসা হয় রাজু শেখের কাছে। এরপর দোকান থেকে ফরম পূরণ করে পাসপোর্ট অফিসে বায়োমেট্রিক করার জন্য আনসার সদস্যের কাছে পাঠিয়ে দেন রাজু শেখ।
সেখানকার আনসার সদস্য বাকি অফিসিয়াল কাজগুলো করার ক্ষেত্রে সহায়তা করেন বলেও জানান তিনি।
ডিবি পুলিশের জেরায় জন্ম নিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত এমন আরেকজন জানান, জন্ম নিবন্ধনগুলো সব সময় আশরাফ নামে এক ব্যক্তি সরবরাহ করতেন। এক্ষেত্রে দুদিনের মধ্যে জন্ম নিবন্ধন নিতে চাইলে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা আর যদি ২ ঘণ্টার মধ্যে আর্জেন্ট নিতে চান পাঁচ হাজার টাকা দিতে হতো। বেশিরভাগ সময়ই রংপুর, শরীয়তপুরের, মাদারীপুর এবং রাজশাহীর বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের জন্ম নিবন্ধন করে দেওয়া হতো।
আর জাতীয় পরিচয়পত্র করার ক্ষেত্রে সব ফরম ফিলাপ করে নাম পরিচয় মুখস্থ করিয়ে তারপর রোহিঙ্গাদের কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হতো বলেও জানান তিনি।
আরও পড়ুন
ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগের একাধিক টিম ৩ মাসের অনুসন্ধান শেষে রাজধানীর আগারগাঁও, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী ও বাড্ডায় ধারাবাহিক অভিযান চালিয়ে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি বিপুল পরিমাণ পাসপোর্ট সংক্রান্ত ডকুমেন্টস, পাসপোর্ট এবং কম্পিউটারসহ ৩ রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষ, ১০ জন বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করে। পরে তাদের দেওয়া তথ্য এবং সংগৃহীত ডকুমেন্টস বিশ্লেষণ করে ২৫ ফেব্রুয়ারি দিন ও রাতে কক্সবাজার, টাঙ্গাইল এবং ঢাকায় ধারাবাহিক অভিযান চালিয়ে দুই আনসার সদস্যসহ রোহিঙ্গা ও বাঙালি দালাল চক্রের ৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তারদের হেফাজত থেকে মোট ১৭টি পাসপোর্ট, ১৩টি এনআইডি, ৫টি কম্পিউটার, ৩টি প্রিন্টার, ২৪টি মোবাইল ফোন এবং পাসপোর্ট তৈরির সংশ্লিষ্ট শত শত দলিলপত্র জব্দ করা হয়।
আগারগাঁও, মোহাম্মদপুর, উত্তরাতে ফিরে ফিরে কম্পিউটারের দোকান খুলে এ কাজে লিপ্ত গ্রেপ্তারকৃত অপর দালালরা হলেন— শাহজাহান শেখ, শরিফুল আলম, জোবায়ের মোল্লা, শিমুল শেখ, আহমেদ হোসেন, মাসুদ আলম, আব্দুল আলিম, মাসুদ রানা, ফজলে রাব্বি শাওন, রজব কুমার দাস দীপ্ত, আল-আমিন, মো. সোহাগ।
শক্তিশালী এই চক্রটি মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শিশু, নারী ও পুরুষদেরকে লক্ষাধিক করে টাকার বিনিময়ে জন্ম সনদ, এনআইডি ও পাসপোর্ট বানিয়ে দেয়।
ডিবি পুলিশের কাছে ১৩ বছর বয়সী রোহিঙ্গা কিশোরী উম্মে ছলিমা ওরফে ছমিরা বলেন, আমার খালা সৌদি আরবে থাকেন। আমিও তার কাছে টাকা পয়সা আয় করার জন্য যেতে চাই। সেজন্যই ঢাকায় পাসপোর্ট বানাতে এসেছি।
তবে এসব ঘটনার পেছনে আরও কেউ জড়িত আছে কি না সে বিষয়ে খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশীদ। তিনি বলেন, পাসপোর্ট জালিয়াতি কিংবা অবৈধভাবে পাসপোর্ট তৈরির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কেউ জড়িত আছেন কি না বিষয়টি আমরা তদন্ত করছি। আমার মনে হয় এভাবে হাজার হাজার পাসপোর্ট রোহিঙ্গারা নিয়ে যাচ্ছে, দাগী আসামিরা নিচ্ছে। অথচ কোনো কোনো ভেরিফিকেশন করা হয় না, তাদের ডাটাবেইজে তো দেশি নাগরিক ও রোহিঙ্গাদের সবার বিস্তারিত ডাটা রয়েছে।
দাগি আসামিদের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেক দাগি আসামিও এভাবে পাসপোর্ট করেছে। তাদের নাম পরিচয় ও আমরা তদন্তের স্বার্থে জানাচ্ছি না। গ্রেপ্তারদের আদালতে সোপর্দ করে আবেদন করা হলে পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে আরও যারা যারা জড়িত তাদের নাম পরিচয়ও জানা যাবে আশা করি।
আরএইচটি/জেইউ/এমএ/কেএ