রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে জীবনবাজি রাখা বীর সন্তানদের ফুলেল শ্রদ্ধা, ভালোবাসায় স্মরণ করেছে গোটা দেশ। একইসঙ্গে ১৯৫২ সালে মায়ের ভাষাকে রক্ষার জন্য যারা নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন, শ্রদ্ধা জানাতে তাদের কবরেও আসছেন মানুষজন। ফুল দিয়ে ও কবর জিয়ারত করে শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছেন তারা।

বুধবার (২১ ফেব্রুয়ারি) এমন চিত্রই দেখা গেছে রাজধানীর আজিমপুর কবরস্থানে।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, আজিমপুর পুরাতন কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন ভাষা শহীদ আবুল বরকত, আব্দুল জব্বার এবং শফিউর রহমান। কবরস্থানের দক্ষিণ গেইট দিয়ে প্রবেশ করে কিছুদূর এগিয়ে গেলেই চোখে পড়বে সাদা-কালো মার্বেল পাথরে বাঁধাই করা পাশাপাশি সমাহিত তিন ভাষা শহীদের কবর। কবরের ওপর বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের ফুলের ডালার শ্রদ্ধার্ঘ্য। ভাষা শহীদের পরিবার, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, আওয়ামী মৎস্যজীবী লীগ, বাংলাদেশ কৃষকলীগসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করা হয়েছে। কেউ কেউ শ্রদ্ধা নিবেদনের পর করছেন কবর জিয়ারতও। শহীদদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে তাদের জন্য দোয়া করছেন অনেকেই।

শ্রদ্ধা জানাতে আসা শিক্ষার্থী রুবাইয়া তাহসান বলেন, ভাষা আন্দোলন আমাদের বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত গর্ব ও গৌরবের বিষয়। বিশ্বের বুকে একমাত্র আমরাই মায়ের ভাষাকে রক্ষা করার জন্য জীবন দিয়েছি। এর চেয়ে বড় আত্মত্যাগ আর কোনো কিছু হতে পারে না।

ভাষা সৈনিকদের কবর জিয়ারত করতে দেখা গেল মাদ্রাসা শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলামসহ তার বন্ধুকে। তারা বলেন, আসলে ফুল দিলে ভাষা সৈনিকদের তেমন কোনো উপকার হয় না। বরং আমরা তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে এখানে কবর জিয়ারত করেছি। দেশের জন্য যারা জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের জন্য আমাদের দোয়া করা উচিত। তাদের এই আত্মত্যাগ আমাদের জন্য দেশপ্রেমের বড় উদাহরণ হয়ে থাকবে।

শরীফুল ইসলাম নামে আরেকজন বলেন, ভাষা শহীদদের কবরে আসার চেয়ে মানুষের মাঝে শহীদ মিনারে যাওয়ার আগ্রহটা বেশি। সেখানেও আবার সংগঠন এবং মানুষের আগ্রহ সেলফি আর ছবির প্রতি। যেসব ভাষা শহীদরা আমাদের মায়ের ভাষাকে রক্ষার জন্য তাদেরকে আজ গভীরভাবে স্মরণ করি। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আরও বৃহৎ আকারে এই ইতিহাস তুলে ধরা প্রয়োজন।

শফিউল হাসান নামে একজন বলেন, আমরা তরুণ প্রজন্মের অনেকেই জানি না ভাষা আন্দোলনে শহীদ হওয়া মহান ব্যক্তিদের জীবনী সম্পর্কে। এটা জাতি হিসেবে হতাশাজনক। আজকের এই দিনে সবাই যেমন শহীদ মিনারে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করছে ছুটছে তেমনি উচিৎ ভাষা শহীদদের জীবনী সম্পর্কেও জানা। আমি আজ প্রথমবার এখানে এসেছি। মানুষের কাছে শুনেছি আজিমপুর কবরস্থানে ভাষা শহীদের কবর রয়েছে। মূলত, এটি দেখার জন্য এখানে এসেছি।

অবশ্য এই তিন ভাষা শহীদ ছাড়াও আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছিল ভাষা শহীদ আব্দুস সালাম, অহিউল্লাহ ও আবদুল আওয়ালকে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের লাশ দাফনের খাতায় অহিউল্লাহর নাম পাওয়া গেলেও তার কবর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সালাম ও আওয়ালের কবরেরও নেই কোনো স্মৃতিচিহ্ন। ভাষা শহীদ রফিকের মরদেহও অতি গোপনে দাফন করা হয়েছিল কবরস্থানের অসংরক্ষিত এলাকায়। এরপর এই কবর ভেঙে ফেলে নতুন কবর বসানো হয়েছিল। আজও তার কবরটির কোনো চিহ্ন আবিষ্কার হয়নি।

প্রসঙ্গত, গতকাল ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা থেকেই কবরস্থানের উত্তর দিকের গেইট (নিউ মার্কেট সংলগ্ন) ও দক্ষিণ দিকের গেইট খোলা থাকে। ২০ তারিখ রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে ভাষা শহীদদের কবরে ফুল দেওয়া শুরু হয়। আজ (২১ ফেব্রুয়ারি) দিনভর চলে এই শ্রদ্ধা নিবেদন।

আরএইচটি/এমএ