লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাউরো ভিয়েরা বাংলাদেশ সফরে আসছেন। আগামী ৮ এপ্রিল ব্রাজিলিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় পা রাখবেন। আর এটি হবে দেশটির প্রথম কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফর। মাউরো ভিয়েরার এ সফরে সার্বিক সহযোগিতা সংক্রান্ত চুক্তি করতে আগ্রহী বাংলাদেশ। পাশাপাশি ব্রাজিলের সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও কৃষি খাতে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করার প্রস্তুতি নিচ্ছে ঢাকা।

ঢাকা ও ব্রাসিলিয়ার একাধিক কূটনৈতিক সূত্র থেকে এসব তথ্য জানতে পেরেছে ঢাকা পোস্ট। ঢাকার একটি কূটনৈতিক সূত্র বলছে, আগামী ৮ এপ্রিল এক দিনের সংক্ষিপ্ত সফরে ঢাকায় আসবেন ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ওইদিন ঢাকায় বেশ ব্যস্ত সময় পার করতে হবে তাকে। কেননা, ওই দিনই দ্বিপক্ষীয় বৈঠকসহ বেশ কয়েকটি কর্মসূচীতে অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে ব্রাজিলিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর।

ঢাকার এক কূটনীতিক ব্রাজিলিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, প্রথম কোনো ব্রাজিলিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় আসতে যাচ্ছেন। এটি দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে বেশ বড় ভূমিকা রাখবে। দুই দেশের সম্পর্ক আরও এগিয়ে যাবে। বিশেষ করে, বিশ্বের নবম অর্থনীতির দেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে এ সফর বেশ ফলপ্রসূ হওয়ার সুযোগ থাকবে।

অপরদিকে ব্রাসিলিয়ার একটি কূটনৈতিক সূত্র বলছে, ব্রাজিলিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরে দেশটির সঙ্গে সার্বিক সহযোগিতা সংক্রান্ত চুক্তি হবে। বাংলাদেশ এ চুক্তি করতে বেশ আগ্রহী। কারণ, এটি না করা গেলে ব্রাজিলের সঙ্গে অন্য কোনো চুক্তি করতে পারছে না বাংলাদেশ। মূলত এ চুক্তি করেই অন্য চুক্তিতে যাওয়ার রীতি ব্রাজিলের।

ব্রাজিলের সম্মতিতে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরে বাংলাদেশের সঙ্গে এ চুক্তির করার বিষয়ে সম্মতি রয়েছে ব্রাসিলিয়ার। সেই লক্ষ্যে উভয়পক্ষ কাজ করছে। এছাড়া ভিয়েরার সফরে বাংলাদেশ ও ব্রাজিল প্রতিরক্ষা এবং কৃষি ক্ষেত্রে দুটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করতে চায়। 

জানা গেছে, ৮ এপ্রিল ব্রাজিলিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরের প্রথম কর্মসূচী শুরু হবে ধানমন্ডির ৩২ নাম্বারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানানোর মধ্য দিয়ে। পরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ ও ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জি-২০ চেয়ার হিসেবে ব্রাজিলের অগ্রাধিকার নিয়ে বক্তব্য দেবেন ভিয়েরা।

এছাড়া হাছান মাহমুদের আমন্ত্রণে ইফতার ও নৈশভোজে অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে ব্রাজিলিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর। সময় সাপেক্ষে বাংলাদেশের একটি ব্যবসায়ী প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাত করতে পারেন তিনি।

এদিকে, মঙ্গলবার (১৯ ফ্রেবুয়ারি) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ব্রাজিলিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফর নিয়ে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সভাপতিত্বে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়। সেখানে ব্রাজিলিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর নিয়ে সংশ্লিষ্টদের করণীয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।

সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দুইপক্ষের মধ্যে ২ দশমিক ৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাণিজ্য হয়েছে। বাংলাদেশ হচ্ছে ব্রাজিলের দ্বিতীয় বৃহত্তম তুলা এবং চিনি, সয়াবিন ও সয়াবিল তেলের তৃতীয় বৃহত্তম আমদানিকারক দেশ। বাংলাদেশ ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্রাজিল থেকে ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের চিনি ও চিনিজাত দ্রব্য, ৪৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের তুলা, ৬৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সয়াবিন এবং ৩৮৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সয়াবিন তেল আমদানি করেছে।

অন্যদিকে, ওই অর্থবছরে ব্রাজিল বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, কার্পেট ও গৃহস্থালি পণ্য, সিরামিকস, আসবাব এবং চামড়া পণ্য আমদানি করেছে।

বাংলাদেশ ব্রাজিলে তৈরি পোষাক খাতের যে পণ্য রপ্তানি করে তাতে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। ঢাকা চেষ্টা করছে এই শুল্ক কমিয়ে ৫ থেকে ১০ শতাংশে নিয়ে আসতে। এ ছাড়া ব্রাজিলের বাজারে অশুল্ক বাধা, বিভিন্ন ধরনের কর, বিমান ও জাহাজে পণ্য রপ্তানিতে করসহ একাধিক জটিলতা রয়েছে। যেখানে ঢাকা ব্রাসিলিয়া থেকে তুলা আমদানিতে ব্রাজিলকে ছাড় দিয়ে থাকে।

ঢাকা আশা করছে, ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আসন্ন সফরে এই বাধাগুলো দূর হবে এবং দুইপক্ষের মধ্যে বাণিজ্য যোগাযোগ আরো নিবিড় হবে। বাংলাদেশ ব্রাজিলে তৈরি পোষাক পণ্য, পাট এবং ওষুধের বাজার ধরতে চায়। পাশাপাশি ব্রজিলের সঙ্গে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি অথবা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করার প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে বাংলাদেশ। ব্রাজিলিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আসন্ন সফরের মধ্য দিয়ে এটি সামনে এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ হবে।

ঢাকার এক দায়িত্বশীল কূটনীতিক বলেছেন, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দক্ষিণ আমেরিকার আঞ্চলিক বাণিজ্য জোট মারকসুরের সঙ্গে বাংলাদেশ পিটিএ/এফটিএ সংক্রান্ত আলোচনা গুরত্ব দিতে চায়। মারকসুরের সঙ্গে যুক্ত না হতে পারলে আমাদের এফটিএ করতে সমস্যা হচ্ছে, মার্কে এক্সসেস পাওয়া যায় না। পাটের উপর এন্টিডামপিং কর অনেক বেশি, এটা কমানো জরুরি। এ ছাড়া ব্রাজিল ৮ বিলিয়ন ডলার ওষুধ নেয় দেশের বাহিরে থেকে। আমরা চাইব, তারা যেন আমাদের এখানে যেসব নামিদামি কোম্পানি আছে তাদের যেন যুক্ত করা যায়।

প্রসঙ্গত, গত বছরের অক্টোবরের শুরুতে ব্রাসিলিয়ায় বাংলাদেশ ও ব্রাজিল দ্বিতীয় যৌথ পরামর্শক সভা করে। সেখানে ঢাকার হয়ে নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন। এর আগে, তৎকালীন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম ব্রাজিল সফর করেন। ওই সফরে প্রতিমন্ত্রী সরকারি পর্যায়ে ভিসামুক্ত যাতায়াতে সমঝোতা স্মারক সই করে। 

এনআই/এমটিআই