বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৩৬৩ দিনই থাকে অযত্নে-অবহেলায়। কেবল বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি একদিন করা হয় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। ফলে ২১ ফেব্রুয়ারি এই এক দিন থাকে ঝকঝকে-তকতকে। তারপর ফের দখল। আবারো ময়লা আবর্জনা, দোকানপাট আর অবৈধ দখলে মলিন হয়ে যায় মহান ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক ‘আমতলা গেট’। বছরজুড়ে এমন চিত্রই বজায় থাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের গেট সংলগ্ন এই প্রাঙ্গণের।

মঙ্গলবার (২০ ফেব্রুয়ারি) সকালে সরেজমিনে আমতলা গেট ঘুরে দেখা যায়, অন্যান্য সময়ের চেয়ে ভিন্ন এক অবস্থা এই এলাকার। অবৈধ দোকানপাট ও ময়লা আবর্জনার স্তূপ নেই। আমতলা গেটের সামনে ও আশপাশ থেকে সবকিছুই সরানো হয়েছে। ছিটানো হয়েছে ব্লিচিং পাউডার। গেটে করা হয়েছে চুনকাম। সাদা রঙের বড় গেটটির ওপরে কালো রঙের একটি ছোট ব্যানারে লেখা রয়েছে— ‘ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত আমতলার ঐতিহাসিক প্রাঙ্গণ। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এই দিনে ছাত্র সমাজ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মিছিল করে ১৪৪ ভঙ্গ করে।’

অথচ অন্যান্য সময়, গেটের একেবারে সামনে থেকে শুরু করে আশপাশে পসরা সাজিয়ে বসে কমপক্ষে ৩০-৪৫টির মতো ভাসমান দোকান। এসব দোকানে চা, পরোটা, ডিমসিদ্ধ, স্যুপ, সিগারেট, প্লাস্টিকের সামগ্রী, বালিশ, কম্বল, ফলের জুস, পাটি, ভাত, তরকারি, কিছু মেলামাইন-ইলেকট্রনিক সামগ্রী ও ওয়ানটাইম প্লেট বিক্রি করা। দোকানের ময়লা-আবর্জনা ও চায়ের দোকানের পানিতে তৈরি হয় স্যাঁতস্যাঁতে অবস্থা।

জানা গেছে, এই স্থানের নিয়ন্ত্রণ করে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। তাদের ছায়া ছাড়া এখানে কেউ দোকান নিয়ে বসতে পারেন না। অবশ্য সেজন্য প্রতিদিনই পরিশোধ করতে হয় নির্ধারিত পরিমাণের চাঁদা। দোকানভেদে ১০০ টাকা থেকে শুরু করে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয় সেই প্রভাবশালী মহলকে। তারাই ‘ম্যানেজ’ করে থানা-পুলিশ কিংবা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে। তাই উচ্ছেদ অভিযান কিংবা অন্যান্য নির্দেশনা অনেকটা থোরাই কেয়ার করেন তারা। চোর-পুলিশ খেলার মতো এসব অভিযানে তারা বেশ অভ্যস্থ হয়ে গেছেন।

যে কারণে ইতিহাসে অম্লান ঐতিহাসিক আমতলী গেট 

১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি (বাংলা ৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) মাতৃভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলেও এর সূচনা হয়েছিল অনেক আগেই। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে তৈরি হয়েছিল পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান। প্রায় দুই হাজার কিলোমিটারের অধিক দূরত্বের ব্যবধানে অবস্থিত পাকিস্তানের এই দুটি অংশের মধ্যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক এবং ভাষাগতসহ অসংখ্য মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান ছিল। তারপরও ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলা ইসলামী করণের অংশ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। পাশাপাশি বিকল্প হিসেবে আরবি হরফে বাংলা লিখন অথবা সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা আরবি করারও প্রস্তাব দেওয়া হয়। এমন ঘোষণায় বিক্ষোভে ফেটে পড়েন বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান/পূর্ব বাংলা) মানুষজন। বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে জন্ম হয় তীব্র ক্ষোভের। যার ফলে পূর্ব বাংলায় ভাষা রক্ষার আন্দোলন দ্রুত দানা বাঁধে। আর আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে। ফলে ঢাকা শহরে মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদি বেআইনি ও নিষিদ্ধ হয়ে যায়।

এরপর নানান ঘটনাপ্রবাহের শেষে চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি (৮ই ফাল্গুন ১৩৫৮)। পুলিশের ১৪৪ ধারার আদেশ অমান্য করে ছাত্র, প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী ও সাধারণ মানুষ মিলে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি আমতলা গেটের কাছে আসলেই পুলিশ ১৪৪ ধারা ভাঙ্গের অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। মুহূর্তেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন রফিক, সালাম, বরকত ও আব্দুল জব্বারসহ নাম না জানা অনেকেই। বাংলা ভাষাকে রক্ষার জন্য এই ত্যাগ বিশ্বের বুকে তৈরি করেছে অনন্য নজির। বাংলা ভাষা পেয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার সম্মান।

অবশ্য পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবেও বড় জায়গা দখল করে রেখেছে এই আমতলা প্রাঙ্গণ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থেও (পৃষ্ঠা-৯৬) উঠে এসেছে এই আমতলার ইতিহাস। তিনি লিখেছেন, ‘১৯৪৮ সালের মার্চের ১৬ তারিখ সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্রসভায় আমরা সবাই যোগদান করেছিলাম। হঠাৎ কে যেন আমার নাম প্রস্তাব করে বসল সভাপতির আসন গ্রহণ করার জন্য। সবাই সমর্থন করল। বিখ্যাত আমতলায় এই আমার প্রথম সভাপতিত্ব করতে হলো। অনেকেই বক্তৃতা করল।’ তবে এতকিছুর পরও অরক্ষিত, অবহেলিত এই ঐতিহাসিক ‘আমতলা গেট’।

সাধারণ মানুষজন বলছেন, ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সঙ্গে ঐতিহাসিক আমতলা গেট ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই এই স্থানের যথার্থ সংরক্ষণ এবং যত্ন সারা বছরই করা উচিত।

সামিউল ইসলাম নামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলেন, অনেক সময় নিজের কাছেই কষ্ট লাগে। এত গুরুত্বপূর্ণ স্থানটি প্রায় সারা বছর দখলে থাকে। শুধুমাত্র ২১শে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে এক থেকে দুই দিন দখল মুক্ত করা হয়। এটি হওয়া উচিত নয়। বরং সারা বছরই এর যথাযথ সংরক্ষণ করা উচিত। কারণ এটি আমাদের ইতিহাসের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা।

শারমিন সুলতানা নামের আরেকজন বলেন, আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের অন্যতম প্রেরণা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। এই ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই পরবর্তী সময়ে আমাদের স্বাধীনতার যাত্রা সুগম হয়েছিল। আর ভাষা আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হচ্ছে এই আমতলা গেট। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এটি সারা বছর দখলে থাকে। অথচ এটি সুন্দর একটি জাদুঘর কিংবা দর্শনীয় স্থান হতে পারে। যেখানে শিক্ষার্থী এবং ছোট বাচ্চারা এসে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবে। এই সুযোগ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের  করে দেওয়া উচিত। এটি সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা।

ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিলেন ঢামেক পরিচালক

ভাষা শহীদদের স্মৃতি বিজড়িত রক্তস্নাত স্থান আমতলা গেটের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে থাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রশাসন। বিষয়টি নিয়ে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুজ্জামান বলেন, আমরা চেষ্টা করছি এই স্থানটিকে সারা বছর দখলমুক্ত রেখে সুন্দর একটি অবস্থা বজায় রাখার জন্য। এটি যেহেতু ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক একটি স্থান, সেজন্য দখলমুক্তভাবে রেখে আমতলা গেটকে যেন সংরক্ষণ করা যায়, সেই চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

আরএইচটি/কেএ