লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণে ১৫-২০ লাখ টাকার ঘুষ গ্রহণ, স্বাস্থ্য অধিদফতরকে তদন্ত করতে বলেছে দুদক

করোনাকালে হাসপাতালে মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের (কারিগরি জনবল) ঘাটতি মেটাতে জরুরি ভিত্তিতে আড়াই হাজার পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এমন একটি সিদ্ধান্ত বিতর্কের মুখে ফেলেছে নিয়োগ পরীক্ষার দুর্নীতি! অভিযোগ উঠেছে, ২০২০ সালে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পদে বেশ কয়েকজন পরীক্ষার্থীকে লিখিত পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর দিতে বড় অঙ্কের ঘুষ লেনদেন হয়েছে। নিয়োগ কমিটির সদস্যদের কাছ থেকে মিলেছে এমন বোমা ফাটানো তথ্য।  

বিভিন্ন মাধ্যমে পাওয়া অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে টনক নড়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)। তবে নিজেরা অনুসন্ধান না করে স্বাস্থ্য অধিদফতরকেই তদন্ত করে প্রকৃত ঘটনা জানাতে বলেছে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক বরাবর গত ১৪ এপ্রিল পাঠানো এক চিঠিতে নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগ যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত ঘটনা দুদকের কাছে উপস্থাপনের জন্য বলা হয়েছে।

২০২০ সালে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পদে বেশ কয়েকজন পরীক্ষার্থীকে লিখিত পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর দিতে বড় অঙ্কের ঘুষ লেনদেন হয়েছে। নিয়োগ কমিটির সদস্যদের কাছ থেকে মিলেছে এমন বোমা ফাটানো তথ্য

এ বিষয়ে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মোজাম্মেল হক খানের কাছে জানতে চাইলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য অধিদফতরকে অভিযোগ যাচাই-বাছাই করে দেখার জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে। তারা প্রাথমিক তদন্ত করে আমাদেরকে অভিযোগের সত্যতা সম্পর্কে জানাবে। তাদের জবাব যদি সন্তোষজনক না হয়, তখন দুদক তার আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। আমাদের গোয়েন্দা বিভাগও এ বিষয়ে নজরদারি করছে।

মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের নিয়োগ বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ

অন্যদিকে, দুদকের চিঠি ও নিয়োগ দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিষয়টি আমাদের পরিচালক (প্রশাসন) ভালো বলতে পারবেন। আমি এ বিষয়ে অবগত নই।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) ও নিয়োগ কমিটির প্রধান শেখ মো. হাসান ইমামকে ফোনে এ বিষয়ে জানার জন্য অনেকবার চেষ্টা করা হয় কিন্তু তার জবাব পাওয়া যায়নি। তবে হাসান ইমাম গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, কমিটির সদস্যরা যেসব অভিযোগ করেছেন, তা আমি স্বাস্থ্যসেবা সচিব ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে জানিয়েছি। ৮০ নম্বরের মধ্যে যখন একাধিক পরীক্ষার্থী ৭৯ পান, তখন সেটা ভাবনার বিষয়।

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অপর এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, মেডিকেল টেকনোলজিস্টসহ কয়েকটি পদের পরীক্ষায় দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। যতটুকু জানি তদন্ত শুরু হয়েছে। যার নেতৃত্ব দিচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে বিস্তারিত বলার সময় এখনও আসেনি।

করোনাকালে সরকারি হাসপাতালে কারিগরি জনবলের ঘাটতি মেটাতে স্বাস্থ্য অধিদফতর ২০২০ সালের ২৯ জুন একটি বিজ্ঞপ্তি দেয়। বিজ্ঞপ্তি অনুসারে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ১৫টি পদে মোট দুই হাজার ৬৮৯ জনকে নিয়োগ দেওয়ার তথ্য জানানো হয়।

রাজধানীর দুর্নীতি দমন কমিশন কার্যালয় | ছবি- ঢাকা পোস্ট

পদগুলো হলো- মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাবরেটরি, রেডিওগ্রাফি, ডেন্টাল, ফিজিওথেরাপি, রেডিওথেরাপি), মেডিকেল টেকনিশিয়ান (ইসিজি, এনেসথেসিয়া, ডায়ালাইসিস, বায়োমেডিকেল, ইটিটি, পারফিউশনিস্ট, সেমুলেটর, অর্থোপেডিক্স ও ইকো) ও কার্ডিওগ্রাফার। যেখানে মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের ৮৮৯টি পদ এবং মেডিকেল টেকনিশিয়ানদের এক হাজার ৮০০টি পদ ছিল। এর মধ্যে টেকনোলজিস্ট পদে ওই বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত লিখিত পরীক্ষায় দুই হাজার ৫২১ জন উত্তীর্ণ হন। কিন্তু যারা উত্তীর্ণ হন তাদের মধ্যে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ পরীক্ষার্থী খুব ভালো নম্বর পান। যেখান থেকেই মূলত সন্দেহের সূত্রপাত। শুধু তাই নয়, ঘটনা ফাঁস হয়ে গেলে কড়াকড়িভাবে মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্তের পাশাপাশি লিখিত পরীক্ষায় অনিয়মের অভিযোগে স্বাস্থ্য অধিদফতর নিয়োগ সংক্রান্ত কমিটির দুই সদস্যকে সরিয়ে দেয়। মৌখিক পরীক্ষায় ২০ নম্বরের মধ্যে ১০ পাওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়।

লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য প্রার্থীদের একটি অংশের কাছ থেকে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে। অথচ লিখিত পরীক্ষায় যেসব প্রার্থী ৮০ নম্বরের মধ্যে ৬০ থেকে ৭৯ পেয়েছেন, তারা মৌখিক পরীক্ষায় প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি। কিন্তু কম নম্বর পাওয়া প্রার্থীরা বরং ভালো করেছেন

অভিযোগের বিষয়ে দুদকসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের ওই নিয়োগে বড় অঙ্কের ঘুষ-বাণিজ্যের অভিযোগ তোলেন নিয়োগ কমিটিরই অপর দুই সদস্য। তারা হলেন- স্বাস্থ্য অধিদফতরের তৎকালীন উপ-পরিচালক (প্রশাসন) আ ফ ম আখতার হোসেন ও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিব শারমিন আক্তার জাহান। তারা দাবি করেন, লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য প্রার্থীদের একটি অংশের কাছ থেকে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে। অথচ লিখিত পরীক্ষায় যেসব প্রার্থী ৮০ নম্বরের মধ্যে ৬০ থেকে ৭৯ পেয়েছেন, তারা মৌখিক পরীক্ষায় প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি। কিন্তু কম নম্বর পাওয়া প্রার্থীরা বরং ভালো করেছেন।

দুর্নীতির এমন অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বলছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংশ্লিষ্টরা 

অভিযোগে আরও বলা হয়, মৌখিক পরীক্ষায় পাস করিয়ে দিতে নিয়োগ বোর্ডের এক সদস্যকে কোটি টাকা ঘুষ ও পদোন্নতির প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল। উত্তীর্ণদের মধ্যে বেশির ভাগ অনেক ভালো নম্বর পান। যেখানে কলম ধরার কোনো সুযোগ নেই। এত নম্বর পাওয়া খুবই অপ্রাসঙ্গিক।

এদিকে, গত ১২ এপ্রিল কারিগরি জনবল নিয়োগে অবিশ্বাস্য দুর্নীতির ঘটনায় দুদকের কার্যকর পদক্ষেপ দাবি করে বিবৃতি দেয় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ বিষয়ে বলেন, ‘করোনা অতিমারির প্রভাবে সাধারণ মানুষের জীবন এমনিতেই ওষ্ঠাগত, এর সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবার বেহাল দশা আর সেবার গুণগত মান নিয়ে সাধারণ মানুষের আস্থার ঘাটতি এ সংকটকে আরও ঘনীভূত করে তুলেছে। এ সময়ে হাসপাতালগুলোতে কারিগরি জনবল নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা স্বাস্থ্য খাতের প্রতি সাধারণ মানুষের বিশ্বাসের আরেকটি বড় ধাক্কা। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ উপলব্ধি এবং কঠোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি।’

এর আগে জরুরি প্রয়োজন দেখিয়ে ২০২০ সালের শুরুর দিকে এক দফায় ২০৩ জন টেকনিশিয়ান নিয়োগ দেওয়া হয়। তখনও কোনো পরীক্ষা নেওয়া হয়নি। রাষ্ট্রপতির বিশেষ প্রমার্জনায় ওই নিয়োগ সম্পন্ন করে স্বাস্থ্য অধিদফতর।

আরএম/জেডএস/এমএআর/