জাহাঙ্গীরনগরে ধর্ষণকাণ্ডের মূল হোতা মামুন
গার্মেন্টসকর্মী থেকে মাদক কারবারি, অপকর্মে শিক্ষার্থীদের বন্ধু!
রাজধানীর অদূরে সাভারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের ঘটনা এখন সারা দেশের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পর বেরিয়ে আসতে শুরু করে অন্তরালের কালো অধ্যায়। বিভিন্ন সময় মাদক, ধর্ষণসহ নানা অপরাধের ঘটনা ঘটেছে এ ক্যাম্পাসে।
সম্প্রতি ধর্ষণকাণ্ডের পর একাধিক অভিযানে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে র্যাব ও পুলিশ। আজ বৃহস্পতিবার এ নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে র্যাব।
বিজ্ঞাপন
তাদের হাতে আটক হওয়া আসামিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র্যাব জানায়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দম্পতিকে ডেকে এনে স্বামীকে আবাসিক হলে আটকে স্ত্রীকে ধর্ষণের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন ওই দম্পতির পূর্বপরিচিত মামুনুর রশিদ মামুন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ নন, বহিরাগত। কিন্তু তার দ্বিতীয় আবাসস্থল ছিল জাবি ক্যাম্পাস। সেখানেই নিয়মিত যাতায়াত ছিল তার। চলাফেরা ছিল মাদকাসক্ত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে।
এ প্রসঙ্গে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, মামুন প্রায় ২০ বছর আগে জুরাইন এলাকায় গার্মেন্টসকর্মী হিসেবে চাকরি শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি আশুলিয়া এলাকায় এসে চাকরির পাশাপাশি মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত হন। মাদক ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু মাদকসেবী শিক্ষার্থীর সঙ্গে তার সখ্য তৈরি হয়। ২০১৭ সাল থেকে তিনি পুরোপুরি মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন।
আরও পড়ুন
তিনি আরও বলেন, মামুন ২০১৭ সাল থেকে জাবি ক্যাম্পাসের সিনিয়র প্রভাবশালী শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায় ক্যাম্পাসে মাদক কারবার করে আসছেন। ক্যাম্পাসে আগেও নারী নিপীড়ন, ধর্ষণসহ শ্লীলতাহানির ঘটনায় জড়িয়েছে।
জানা যায়, মাদক কারবারি মামুন কক্সবাজার থেকে ইয়াবা এনে বিক্রি করতেন। তার ইয়াবা বিক্রির হটজোন জাবি ক্যাম্পাস, বিশেষ করে ক্যাম্পাসের বটতলা। তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় মাদক সংক্রান্ত ৮টি মামলা রয়েছে। এসব মামলায় একাধিকবার কারাভোগও করেছেন তিনি।
ঘটনার দিন যা হয়
র্যাব বলছে, পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ৩ ফেব্রুয়ারি বিকেলে মামুন ওই তরুণীর স্বামীকে ফোন করে বলেন— মোস্তাফিজুর রহমান নামে এক বড় ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে তার থাকার ব্যবস্থা করেছেন। ওই বড় ভাইয়ের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে বলেন মামুন। মামুনের কথা মতো সন্ধ্যার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের ৩১৭ নম্বর কক্ষে দেখা করেন তিনি। সেখানে মামলার অন্য আসামি মুরাদ, সাব্বির হাসান, সাগর সিদ্দিক ও হাসানুজ্জামানের সাথেও পরিচিত হন তিনি।
মামুন এরপর কৌশলে ভুক্তভোগীর স্বামীকে বলেন, বাসায় থেকে যাওয়া তার (মামুন) কাপড়গুলো তার স্ত্রী যেন একটি ব্যাগে করে মীর মশাররফ হোসেন হলের সামনে নিয়ে আসেন। এরপর রাত ৯টার দিকে মামুনের ব্যবহৃত কাপড় নিয়ে হলের সামনে উপস্থিত হন ওই তরুণী। এ সময় মামুন ও মোস্তাফিজ ওই তরুণীর স্বামীকে ৩১৭ নম্বর রুমে নিয়ে যেতে বলেন।
এই সুযোগে ভুক্তভোগী তরুণীকে হলের পাশে নির্জন স্থানে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয় ও ভয়ভীতি দেখিয়ে বাসায় চলে যেতে বলা হয়। পরে মামুন ও মোস্তাফিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের রুমে গিয়ে স্ত্রী চলে গেছে বলে তার স্বামীকেও বাসায় চলে যেতে বলে।
বেশিদিন এক স্থানে থাকতেন না মামুন
র্যাব জানিয়েছে, মাদক বিক্রির সুবাদে মামলার ১ নম্বর আসামি সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাফিজুর রহমানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও কয়েকজন ছাত্রের সাথে মামুনের সখ্য তৈরি হয়। একই এলাকায় বসবাসের সুবাদে পরিচয় হয় ভুক্তভোগী তরুণীর স্বামীর সাথে।
ভুক্তভোগীর স্বামীর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়সহ আশপাশের এলাকায় মামুন মাদক সরবরাহ করতেন বলেও জানতে পেরেছে র্যাব।
এ প্রসঙ্গে কমান্ডার মঈন বলেন, বেশিদিন এক স্থানে থাকতেন না মামুন। মাদক কারবারের কারণে কিছুদিন পূর্বে গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন তিনি। তার থাকার জায়গা নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হয়। তখন তিনি ওই দম্পতির সাথে একটি বাসায় সাবলেট থাকেন।
ধর্ষণের দায় এড়াতে পারে না জাবি কর্তৃপক্ষ
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেছেন, স্বামীকে আটকে রেখে গণধর্ষণের ঘটনার দায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে না। কারণ সেখানে বিভিন্ন সময় মাদক, ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় বহিরাগতদের প্রবেশের দায় কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা আগামী প্রজন্মকে জাহাঙ্গীরনগর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করার স্বপ্ন দেখি। এমনকি যারা মাদক কারবার, চোরাচালানসহ অবৈধ ব্যবসা করেন সেই সব ব্যক্তিরাও খারাপ হলেও অভিভাবক হিসেবে নিজের সন্তানকেও বিদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করান। আমরা চাই আমাদের সন্তানরা লেখাপড়া করুক এবং সুশিক্ষায় শিক্ষিত হোক।
কমান্ডার মঈন বলেন, সম্প্রতি গণধর্ষণের ঘটনায় গ্রেপ্তারদের দেওয়া বক্তব্য অনুযায়ী বিষয়টি খুবই অ্যালার্মিং। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এখনই আরও কঠোর হতে হবে। কারণ আমরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছি, ক্যাম্পাসে মাদকসহ বিভিন্ন অবৈধ কাজ হয়। এসব ঘটনা প্রতিরোধে সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয়ের বিষয় রয়েছে। তারা যদি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন সহযোগিতা চান, আমরা অবশ্যই সহযোগিতা করব। আমরা মনে করি, দেশের ভবিষ্যৎ সম্পদ, জাতির আগামীদিনের ভবিষ্যতকে এভাবে নষ্ট হতে দিতে পারি না।
মামুনের মতো মানুষরা শিক্ষার্থীদের নষ্ট করছে
নারী ধর্ষণের প্রধান মামুনের মতো লোকজন শিক্ষার্থীদের নষ্ট করছে বলে মন্তব্য করেছে র্যাব।
এ প্রসঙ্গে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেছেন, মামুনের মতো লোকেরাই নিজেদের স্বার্থে, নিজেরাই অপকর্ম করার জন্য শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করছে। আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা যারা আছে তাদের এমন করে বিপথে নেওয়ার দায়দায়িত্ব আমাদের সবল স্টেক হোল্ডারদের নিতে হবে। অভিভাবক, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, শিক্ষক সমাজ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং গণমাধ্যমকে এর দায় নিতে হবে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে খন্দকার মঈন বলেন, শিক্ষার্থীদের অপরাধে জড়ানোর বিষয়ে আগেই সতর্ক হওয়া দরকার ছিল। আমরা সবাইকে খারাপ বলব না। কারণ যারা এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে তারাই তো আগামী দিনে দেশ পরিচালনা করবে। তাই আমি মনে করি, শুধু এখন না সবসময় তাদের নজরদারিতে রাখা উচিত। কারণ শিক্ষার্থীদের বয়স অনেক কম।
আরও পড়ুন
পঞ্চম দিনেও উত্তাল জাবি ক্যাম্পাস
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) স্বামীকে আটকে গৃহবধূ ধর্ষণের ঘটনায় প্রধান অভিযুক্তসহ একাধিক গ্রেপ্তারের পরও আজ উত্তাল ছিল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।
সন্ধ্যার পর অভিযুক্তদের বিচারের দাবিতে মশাল মিছিল করেছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। গতকাল চতুর্থ দিনেও বিক্ষোভ, সমাবেশ ও মানবন্ধনে উত্তাল ছিল ক্যাম্পাস।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো হলো- ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত ও পলায়নে সহযোগিতাকারীদের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মীর মশাররফ হোসেন হল প্রাধ্যক্ষ, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের প্রাধ্যক্ষ ও হল প্রশাসনের বিরুদ্ধে অপরাধীদের পলায়নে সাহায্য করার অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত কমিটি গঠন করা, সব আবাসিক হল থেকে অছাত্রদের বের করা এবং ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা শাখার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া, যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল কার্যকর করা, যৌন নিপীড়নে অভিযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ আ্যন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান জনির বিচার নিষ্পত্তিসহ সকল অপরাধের বিচার দ্রুত নিষ্পত্তি করা।
উল্লেখ্য, গত শনিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) রাত সাড়ে ৯টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলে স্বামীকে আটকে রেখে গৃহবধূকে হল-সংলগ্ন জঙ্গলে নিয়ে ধর্ষণ করে এক ছাত্রলীগ নেতাসহ কয়েকজন। এ ঘটনায় মামলা দায়ের করেন ভুক্তভোগী নারীর স্বামী। মামলার আসামি মামুনুর রশিদ ওরফে মামুন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোস্তাফিজুর রহমান এবং অন্যদের গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এমজে