সবাই আরেকটু সংযত হলেই পারতেন : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
‘মুভমেন্ট পাস’ ও ‘আইডি কার্ড’ নিয়ে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে চিকিৎসক, ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ কর্মকর্তার বাগবিতণ্ডা ইস্যুতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘সবাই আরেকটু সংযত হলেই পারতেন।’
সোমবার (১৯ এপ্রিল) রাতে ঢাকা পোস্টকে তিনি এ কথা বলেন। মন্ত্রী বলেন, ‘পুলিশ এবং ডাক্তার যেটি করেছেন, এটি ভুল বোঝাবুঝি। আমার মনে হয়, ভুল বোঝাবুঝির জন্যই এটি হয়েছে। সবাই আরেকটু সংযত হলেই পারতেন, এটি হলো আমার কথা।’
বিজ্ঞাপন
তিনি আরও বলেন, ‘আমার কাছে এখনও লিখিত কিংবা কোনোকিছু আসেনি। আমি যতটুকু ভিডিও দেখেছি ফেসবুকে; আমার কাছে মনে হলো দুই পক্ষই সংযত আচরণ করলে ভালো হতো। তাহলে এ ঘটনার অবতারণা হতো না।’
এর আগে করোনা রোধে সরকারের দেওয়া বিধিনিষেধের পঞ্চম দিন রোববার (১৮ এপ্রিল) এলিফ্যান্ট রোডে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সহকারী সচিব শেখ মামুনুর রশিদ ও নিউমার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এ কাইয়ুমের সঙ্গে বাগবিতণ্ডা হয় ডা. সাঈদা শওকত জেনির। ডা. জেনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এ বাগবিতণ্ডার মূল কারণ বিধিনিষেধে চলাচলে ‘মুভমেন্ট পাস’ ও ‘আইডি কার্ড’।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বিএমএ-এর চিঠি
ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)। সোমবার (১৯ এপ্রিল) বিএমএ সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ও মহাসচিব ডা. মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী স্বাক্ষরিত পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, করোনা পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশে চলমান লকডাউনে সম্মুখসারির যোদ্ধা চিকিৎসক ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা কর্মস্থলে যাতায়াতকালে দেশের বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা হয়রানি ও নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এ ধরনের ঘটনা ঘটায় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা আতঙ্কগ্রস্ত ও হতাশ হয়ে পড়ছেন।
এতে বলা হয়, রোববার রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোড এলাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সাঈদা শওকত জেনির গাড়ি আটকিয়ে পরিচয় জানতে চাওয়ার নামে একজন নারী চিকিৎসককে যেভাবে হেনস্তা করা হয়েছে তার খবর ও আংশিক ভিডিও বিভিন্ন সংবাদ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। নিজ গাড়িতে কর্মরত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের স্টিকার লাগানো এবং নিজের নামাঙ্কিত চিকিৎসক গাউন পরিহিত অবস্থায় নিজের পরিচয় দেওয়ার পরও তাকে আক্রমণাত্মকভাবে জেরা করে উত্যক্ত ও হেনস্তা করার খবর দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। চিকিৎসকের এতগুলো পরিচয় দেওয়ার পরও কেবলমাত্র মুভমেন্ট পাস ও প্রাতিষ্ঠানিক আইডি কার্ডের নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন আচরণ কোনোভাবেই কাম্য নয়।
আইডি কার্ড প্রসঙ্গে চিঠিতে বলা হয়, সচিবালয়, পুলিশ কিংবা সাংবাদিক লেখা স্টিকারযুক্ত কোনো গাড়ি কোথাও আটকানো বা থামানো হয়েছে বলে এখন পর্যন্ত নজির নেই। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ চিকিৎসকই প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সঙ্গে জড়িত। তারা সরকারি বা বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন না। ফলে তাদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক আইডি কার্ডও নেই।
চিঠিতে বলা হয়, ক্রমাগত এ ধরনের ঘটনার কারণে বিষয়টি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে অবহিত করার পরও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। দ্রুত এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করলে এবং রাস্তায় ক্রমাগত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের হয়রানি এবং নাজেহাল করতে থাকলে নানা ধরনের মানসিক চাপে বিপর্যস্ত চিকিৎসক ও স্বাস্থকর্মীরা তাদের কাজে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবেন এবং এর প্রভাব বর্তমান নাজুক স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় পড়তে বাধ্য।
গতকালের (চিকিৎসক-ম্যাজিস্ট্রেট-পুলিশ বাগবিতণ্ডা) ঘটনায় দ্রুত তদন্ত করে দোষীদের চিহ্নিত করে বিভাগীয় শাস্তির আওতায় আনা এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে বিএমএ।
দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার দাবি বিএসএমএমইউ-এর
এ ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) কর্তৃপক্ষ। এক প্রতিবাদলিপিতে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জোর দাবি জানিয়েছে তারা।
বিএসএমএমইউ প্রতিবাদলিপিতে উল্লেখ করে, গত ১৮ এপ্রিল বিএসএমএমইউ-এর রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগে কর্মরত সহযোগী অধ্যাপক ডা. সাঈদা শওকত কর্মস্থল থেকে দায়িত্বপালন শেষে নিজ আবাসস্থলে ফেরত যাওয়ার পথে লকডাউনে পুলিশের টহলদলের সদস্যদের সঙ্গে কথোপকথনের সচিত্র প্রতিবেদন কর্তৃপক্ষের নজরে আসে।
ডা. সাঈদা শওকত দায়িত্ব পালন শেষে বিএসএমএমইউ-এর লোগো সংবলিত গাড়িতে আরোহিত অবস্থায় এলিফ্যান্ট রোডে পৌঁছার পর কর্তব্যরত পুলিশের টহলদল তাকে থামায়। পরিচয় চাওয়া হলে তিনি তার চিকিৎসক ও বিএসএমএমইউতে কর্মরত বলে পরিচয় জানান। পক্ষান্তরে, টহলদলের পক্ষ থেকে তার চিকিৎসক পরিচিতিকে ‘ভুয়া’ বলা হয় এবং অসৌজন্যমূলকভাবে তাকে গাড়ি থেকে নামতে বলা হয়। ওই সময় তিনি তার নাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো সংবলিত অ্যাপ্রন পরিহিত অবস্থায় ছিলেন।
অ্যাপ্রন বিশ্বব্যাপী চিকিৎসকদের পরিধেয় পেশাগত পোশাক হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ তাকে ‘ভুয়া’ চিকিৎসক হিসেবে অভিহিত করেন। এর প্রেক্ষিতে ডা. সাঈদা শওকত বিক্ষুব্ধ হন এবং পুলিশের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় লিপ্ত হন, যার খণ্ড সচিত্র প্রতিবেদন সামাজিক মিডিয়ায় প্রচার হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সঙ্গে রমনার ডেপুটি পুলিশ কমিশনার এবং নিউমার্কেট থানার ওসির মৌখিক আলোচনা হয়েছে।
দেশের এই করোনা প্রাদুর্ভাবের ক্রান্তিকালে বিএসএমএমইউসহ দেশের সব হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীরা জীবন বাজি রেখে রোগীর জীবন রক্ষার কাজে নিবেদিত রয়েছেন। ইতোমধ্যে বেশ কিছু চিকিৎসক চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন এবং অসংখ্য স্বাস্থ্যকর্মী প্রতিনিয়ত করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে দেশ সেবায় নিবেদিত চিকিৎসককে অপমান ও অপদস্থ করার কারণে চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে, যা দেশব্যাপী চিকিৎসাসেবা ব্যাহত করার শঙ্কা সৃষ্টি করেছে।
এমতাবস্থায়, এই ঘটনার মাধ্যমে এক নারী চিকিৎসককে হয়রানি করার ঘটনার প্রতিবাদ জানাচ্ছে বিএসএমএমইউ এবং ভবিষ্যতে চলমান করোনা চিকিৎসার স্বার্থে স্বাস্থ্যকর্মীদের নির্বিঘ্নে চলাচল নিশ্চিত করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জোর দাবি জানাচ্ছে।
ডা. জেনির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি পুলিশের
এ ঘটনায় ডা. শওকত জেনিকেই দায়ী করেছে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। সোমবার (১৯ এপ্রিল) বিকেলে অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম এবং সাধারণ সম্পাদক ও নারায়ণগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল আলম স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো হয়।
এতে বলা হয়, করোনা সংক্রমণ রোধে সরকারি আদেশ বাস্তবায়নে চলমান কার্যক্রমে ১৮ এপ্রিল রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে মাঠ পর্যায়ে কর্মরত পুলিশ সদস্যদের প্রতি অসৌজন্যমূলক আচরণ, হয়রানি ও অসহযোগিতার কিছু চিত্র গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত হয়। যা বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। ওই স্থানে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের উপস্থিতিতে চেকপোস্ট চলাকালে ওই চিকিৎসকের (ডা. জেনি) কাছে তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য পরিচয়পত্র দেখাতে বলা হয়। এতে তিনি অত্যন্ত ন্যক্কারজনকভাবে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। যা একজন পেশাদার ও সচেতন নাগরিকের কাছ থেকে কোনোভাবেই কাম্য নয়।
তিনি শুধু ওই পুলিশ সদস্যদেরই অপমান করেননি, গোটা পুলিশ বাহিনীকেই কটাক্ষ ও হেয়প্রতিপন্ন করেছেন। যা মিডিয়ার চিত্রে প্রতীয়মান। শুধু তাই নয়, তিনি নিজ পেশার পরিচয় বাদ দিয়ে অপ্রাসঙ্গিক পরিচয় তুলে ধরে পুলিশ ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেছেন এবং জাতির সামনে পেশাজীবী সংগঠনগুলোকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর অপচেষ্টা করেছেন। গত ১৪ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা, চিকিৎসা সেবাসহ অন্যান্য কার্যক্রমে জড়িত সব কর্মকর্তা কর্মচারীদের দাফতরিক পরিচয়পত্র (আইডি কার্ড) আবশ্যিকভাবে ব্যবহারের নির্দেশনা থাকলেও তিনি তা অমান্য করেছেন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তার পরিচয় না দিয়ে নিজ মন্ত্রণালয়ের আদেশ লঙ্ঘন করেছেন।
তিনি কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের ‘তুই’ বলে সম্বোধন করেছেন এবং ‘আর আমি কী, সেটা এখন তোদের দেখাচ্ছি হারামজাদা’ বলে হুমকি দিয়েছেন।
বাংলাদেশে করোনা মোকাবিলায় এবং আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসায় মেডিকেল সার্ভিসে নিয়োজিত চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের অব্যাহত কার্যক্রমের জন্য বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন সর্বদা কৃতজ্ঞ। পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে পুলিশ সদস্যদের প্রতি ওই চিকিৎসকের এমন অপেশাদার ও অরুচিকর আচরণে বাংলাদেশ পুলিশের প্রতিটি সদস্য অত্যন্ত মর্মাহত। বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন ওই ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
নিজ মন্ত্রণালয়ের বৈধ আদেশ লঙ্ঘন এবং কর্তব্যরত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগের কাছে ওই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন জোর দাবি জানাচ্ছে।
এসএইচআর/এফআর