বাসে ঝুলে, গরমে ঘেমে, জ্যাম ঠেলে যাতায়াতকে নিয়তি হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন রাজধানীর মিরপুর ও উত্তরাবাসী। তাদের সেই কষ্টে এক টুকরো আশার আলো দেখিয়েছিল মেগাপ্রজেক্ট মেট্রোরেল। ২০১৩ সালে পরিকল্পনা গ্রহণের পর ২০২২ সালে এসে চলাচল শুরু হয় বহুল কাঙ্ক্ষিত সেই মেট্রোরেলের। এরপর সবচেয়ে বেশি দিন বদলের কথা ভেবেছিলেন মিরপুরবাসী। কিন্তু তাদের সেই আশায়ও এখন গুড়ে বালি। মেট্রো চালু হলেও তাদের ভোগান্তি আর নিঃশেষ হয়নি। শুধু বদলেছে ভোগান্তির জায়গাটা।

একাধিক যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মেট্রোরেলের চলাচল শুরুর পর থেকে অফিস সময়ে যাত্রী ঠাসা হচ্ছে বাহনটিতে। অনেক স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠাও দায় হয়ে গেছে যাত্রীদের জন্য। মেট্রোরেলে সব এলাকার মানুষ স্বাভাবিক চলাচল করলেও বেগ পোহাতে হয় কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া ও আগারগাঁওয়ের বাসিন্দাদের। যাত্রীদের স্টেশনে থেকেও ট্রেন মিস করার মতোও ঘটনা ঘটেছে।

এ অবস্থায় তারা দাবি জানিয়েছেন— মেট্রোরেলের হেডওয়ে (এক ট্রেন থেকে অন্য ট্রেন স্টেশনে থামার মধ্যবর্তী সময়) আরও কমিয়ে আনার। একই সঙ্গে কোচ বাড়ানোর কথাও তারা জানিয়েছেন।

বিষয়টি নজরে এসেছে মেট্রোরেল পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল)। যাত্রী চাহিদা বাড়ায় প্রয়োজনে আরও কোচ সংযোজনের কথাও ভাবছে প্রতিষ্ঠানটি।

কমিউনিকেশন বেইজড ট্রেন কন্ট্রোল (সিবিটিসি) সিস্টেমে দুটি ট্রেইলার কোচসহ মোট ছয়টি কোচ নিয়ে চলাচল করছে মেট্রোরেল। ট্রেইলার কোচের প্রতিটিতে সর্বোচ্চ ৩৭৪ জন এবং বাকি চারটি কোচের প্রতিটিতে সর্বোচ্চ ৩৯০ জন যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা রয়েছে। সেই হিসাবে প্রতিটি মেট্রো দুই হাজার ৩০৮ জন যাত্রী পরিবহন করতে পারছে। এ অবস্থার মধ্যে প্রতিটি ট্রেনে আরও ২টি যাত্রীবাহী কোচ সংযোজনের সক্ষমতা রয়েছে।

এ ছাড়া, পুরো পথে সাড়ে ১৩ ঘণ্টা মেট্রোরেল চালানোর জন্য যে হেডওয়ের কথা জানানো হয়েছিল, সেটিও মাঝেমধ্যে বেড়ে যাচ্ছে। যাত্রীরা প্রায় সময়ই অভিযোগ জানাচ্ছেন— ১০ মিনিটের হেডওয়ে মাঝেমধ্যে ১৫ থেকে ২০ মিনিটও হয়ে যায়।

আরও পড়ুন

সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ইশরাত জাহান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি এখন নিয়মিত মেট্রোরেলে চড়ে বাসা থেকে অফিসে যাতায়াত করি। আগে নিয়মিত অফিসের স্টাফ বাসে যেতাম। সে সময় অন্তত দেড় ঘণ্টা সময় লাগত। এখন যেতে ১৭-১৮ মিনিটের মতো সময় লাগে। যানজটের শহরে মেট্রোরেল ভোগান্তি কমিয়েছে। তবে, মেট্রোরেলের হেডওয়ে যদি আরও কমিয়ে আনা যায় তবে ভালো হয়। কারণ, অফিস টাইমে ট্রেন প্রায়ই যাত্রী ঠাসা থাকে। এতে ট্রেন মিস হয়ে গেলে আরও ১০ থেকে ১২ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়।

যাত্রী নুরুজ্জামান খান বলেন, যাদের অফিস মতিঝিল কেন্দ্রিক, তাদের মধ্যে উত্তরাবাসী সবচেয়ে আরামের অফিস করে থাকে। সবার জন্য সময় সাশ্রয়ী হলেও মিরপুরবাসীর জন্য একটু ভালোমতো দাঁড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই অফিস টাইমে। প্রচণ্ড ভিড় থাকে। মিরপুর-১০ স্টেশন থেকে প্রায় সকাল ৯টা ১০ মিনিটে ট্রেনে উঠি। সচিবালয় স্টেশনে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ঠিকমতো দাঁড়ানো যায় না। মিরপুর-১০ স্টেশন পর্যন্ত যাত্রীরা সবাই উঠতে পারলেও কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া ও আগারগাঁওয়ে অনেক যাত্রীই উঠতে পারে না। ফলে ট্রেনে চড়তে অনেকেরই বিলম্ব হয়। মেট্রোরেলের কোচ বাড়ানো গেলে হয়ত ওইসব এলাকার যাত্রীরা অন্তত ট্রেনে উঠতে পারবে।

কোচ বাড়ানোর বিষয়ে ডিএমটিসিএল কিছু ভাবছে কি না— জানতে চাইলে কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ আবদুর রউফ জানিয়েছেন, আমাদের কোচ বাড়ানোর চিন্তাও আছে। যে সিস্টেমে আছে, সেখানে প্রত্যেক রেকে আরও দুটি কোচ যুক্ত করতে পারব। এছাড়া নতুন কোচ প্রয়োজন হলে ভাবা হবে।

মেট্রোরেলের হেডওয়ে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা আমরা চিন্তা করছি। আমাদের টিম কাজ করছে। এক সপ্তাহ আমরা দেখেছি। এখন সার্ভে করে আমরা দেখব, মেট্রো ট্রেন চলাচলের মধ্যবর্তী সময়টা কতটা কমিয়ে আনা যায়। এখন যে ভিড় হচ্ছে তার কারণ হচ্ছে— নতুন অনেক মানুষ মেট্রোরেল ব্যবহার শুরু করেছেন। তারা একক টিকিট কেটে যাতায়াত করছেন। তাদের অনেকে এরই মধ্যে এমআরটি পাশ কিনে ফেলেছেন ও কিনবেন। গত তিনদিনে আমাদের এমআরটি পাশ কিনেছে প্রায় ২০ হাজার লোক। তারা কিন্তু আর লাইনে দাঁড়াবে না।

হেডওয়ে ঠিক না থাকা প্রসঙ্গে মোহাম্মদ আবদুর রউফ বলেন, প্রত্যেকটা ট্রেন তার যাত্রীর ওজন ক্যালকুলেট করে। ওই অনুযায়ী প্রত্যেক স্টেশনে অটো ব্রেক করে। এই সিস্টেমে সিগন্যালের কোনো মেসেজে টেকনিক্যাল ইস্যু হলে, স্টেশনে ট্রেনে ঢোকার জন্য যে দরজাগুলো আছে তার আগে অথবা পরে থেমে যায়। পরে সেটাকে ম্যানুয়ালি সঠিক জায়গায় সেট করতে হয়। তখন দুই তিন মিনিট লাগে। এটা অ্যাড্রেস করানোর জন্য আমাদের কন্ট্রাকটার, কন্সেন্টার আরও যারা আছে, তাদের সঙ্গে মিটিং হয়েছে। শিগগিরই এই সমস্যার সমাধান হবে।

প্রসঙ্গত, বর্তমানে উত্তরা-মতিঝিল-উত্তরা রুটে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সাড়ে ১৩ ঘণ্টা যাত্রী পরিবহন করছে মেট্রোরেল। ফলে আগের চেয়ে যাত্রীর পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে বৈদ্যুতিক এই বাহনে। রাজধানীর বাণিজ্যিক এলাকায় যাতায়াতে সময় বাঁচাতে মানুষ এখন বাসের চেয়ে বেছে নিয়েছে দ্রুতগতির এই গণপরিবহনকে।

এমএইচএন/এমজে