বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী কাজী হাসিবুর রহমান হিমেলকে অপহরণের পরিকল্পনা করা হয় গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর। মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন গাড়িচালক আব্দুল মালেক। আর তার সহযোগী ছিলেন হিমেলদের পরিবারের দীর্ঘদিনের গাড়ি চালক সামিদুল ইসলাম। সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলা সামিদুল কৌশলে পারিবারিক আর্থিক ও সম্পত্তি সংক্রান্ত তথ্য জেনে নেয় এবং পেশাদার অপহরণকারী মালেকের নেতৃত্বে রাজধানীর উত্তরায় বৈঠক করে হিমেলকে অপহরণের পরিকল্পনা করা হয়।

অপহরণের প্রায় এক মাস পর ২৪ জানুয়ারি হিমেলকে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে উদ্ধার করে র‌্যাব। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয় মোট ৫ জনকে।

বৃহস্পতিবার (২৫ জানুয়ারি) র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব কথা বলেন। 

তিনি বলেন, গত ২৬ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ৯টায় রাজধানীর উত্তরা এলাকায় বসবাসকারী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী কাজী হাসিবুর রহমান ওরফে হিমেল ব্যক্তিগত প্রয়োজনে শেরপুর যাওয়ার সময় পথিমধ্যে অপহরণের শিকার হন। পরে পরিবার একাধিকবার হিমেলের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন নম্বরে কল করে বন্ধ পায়। অনেক যোগাযোগ করেও তার মা তহুরা বিনতে হক ছেলের সন্ধান না পেয়ে রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। গত ২৮ ডিসেম্বর গাজীপুরের বাসন এলাকায় পরিত্যক্ত অবস্থায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী হিমেলের গাড়িটি উদ্ধার করে।

পরে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি অপহৃত হিমেলের মায়ের হোয়াটসঅ্যাপে ফোন করে অপহরণের বিষয়টি জানায় এবং ২ কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। মুক্তিপণ আদায়ের লক্ষ্যে তারা হিমেলকে পাশবিক কায়দায় নির্যাতনের ভিডিও পাঠায়।

পরে হিমেলের মামা বাদী হয়ে রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় গত ৬ জানুয়ারি একটি অপহরণের মামলা দায়ের করেন। মা তহুরা ছেলেকে উদ্ধারে র‌্যাবের কাছেও অভিযোগ দায়ের করেন।

এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৩ জানুয়ারি র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা, র‌্যাব-১, র‌্যাব-৯ ও র‌্যাব-১৪ এর দল সুনামগঞ্জের তাহিরপুর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে অপহরণকারী চক্রের মূলহোতা ও পরিকল্পনাকারী মো. আব্দুল মালেক (৩৫), তার অন্যতম সহযোগী ও পরিকল্পনাকারী চালক সামিদুল ইসলামকে (৩০) গ্রেপ্তার করে। পরে তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গত রাতে অপহৃত ভিকটিম হাসিবুর রহমান ওরফে হিমেলকে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর থেকে উদ্ধার করা হয়। এসময় গ্রেপ্তার করা হয় রনি নাবালকে (৪১)।

তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গত রাতে রাজধানীর উত্তরা থেকে রাসেল মিয়া (৩৪) ও বিল্লাল হোসেন (২৪) নামে চক্রের আরও দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযানে উদ্ধার করা হয় ১টি বিদেশি পিস্তল, ২ রাউন্ড গুলি ও ২টি ওয়াকি-টকি সেট।

স্থানীয় সূত্রের বরাত দিয়ে কমান্ডার মঈন বলেন, হিমেলের বাবা ব্যাটারি বিক্রয়ের ব্যবসা পরিচালনা করতেন। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজির (আইইউবিএটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী হিমেল। বাবা ৪ মাস আগে মারা যাওয়ায় পড়াশুনার পাশাপাশি ব্যবসায় নামে হিমেল।

এরমধ্যেই গত ২৬ ডিসেম্বর সকালে রাজধানীর উত্তরার বাসা থেকে ব্যবসায়িক প্রয়োজনে শেরপুর যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে অপহরণের শিকার হন হিমেল।

কমান্ডার মঈন বলেন, গ্রেপ্তারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, অপহরণ চক্রের মূলহোতা গ্রেপ্তার মালেক এবং অন্যতম পরিকল্পনাকারী চালক সামিদুল। সামিদুল ভিকটিম হিমেলের বাসায় ৪ বছর ধরে গাড়ি চালক হিসেবে চাকরি করতেন।

জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গ্রেপ্তার মালেক ভিকটিম হিমেলের মাকে একটি বিদেশি হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে ফোন করে ভিকটিমকে অপহরণের বিষয়টি জানিয়ে ভিকটিমের পরিবারের কাছে প্রথমে ২ কোটি টাকা মুক্তিপণ হিসেবে দাবি করে এবং তার ছেলেকে পাশবিক কায়দায় নির্যাতনের ভিডিও পাঠায়। পর্যায়ক্রমে এক কোটি তারপর ৫০ লাখ তারপর ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ হিসেবে দাবি করে।

গ্রেপ্তাররা পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণের টাকা না পেলে হাত-পা কেটে ফেলা ও হত্যার হুমকি দেয়। গ্রেপ্তার মালেক বিভিন্ন সময় অপহৃত হিমেলের মাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাসহ প্রাণনাশের হুমকি দেয়। পরে হিমেলের মা অপহরণকারীদের মুক্তিপণের টাকা দিতে সম্মত হয়।

অপহরণকারীরা গত ২৩ জানুয়ারি সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে আসতে বলে। বিষয়টি তিনি র‌্যাবকেও অবহিত করেন। পরে গত ২৩ জানুয়ারি অপহৃত হিমেলের মা নেত্রকোণায় পৌঁছালে গ্রেপ্তার মালেক ও সামিদুল তাকে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে আসতে বলে। তখন র‌্যাবের একটি দল সুনামগঞ্জের তাহিরপুর থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে। এসময় র‌্যাবের এক কর্মকর্তাসহ দুজন আহত হয়।

মালেক ও সামিদুলের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হিমেলকে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে পাহাড়ি টিলা এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়। সেসময় অপহরণ চক্রের সদস্য রনিকে গ্রেপ্তার করা হয়। এসময় অপহরণ চক্রের দুই সদস্য পালিয়ে যায়। গ্রেপ্তার মালেকের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গত রাতে রাসেল ও বিল্লালকে রাজধানীর উত্তরা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ভিকটিম হিমেলকে উদ্ধারকালে শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন ও মানসিক বিপর্যস্ত অবস্থায় পাওয়া যায়।

গ্রেপ্তারদের সম্পর্কে কমান্ডার মঈন বলেন, গ্রেপ্তার মালেক পেশায় একজন গাড়ি চালক। সে গাড়ি চালানোর পেশার আড়ালে একটি সংঘবদ্ধ অপহরণ চক্রের নেতৃত্ব প্রদান করতো। ধনী পরিবারের সদস্যদের টার্গেট করে মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায় করে থাকে মালেক। মুক্তিপণ দিতে অস্বীকৃতি জানালে তারা পৈশাচিক নির্যাতনের ভিডিও ধারণ করে আত্মীয়-স্বজনের কাছে পাঠিয়ে মুক্তিপণ আদায় করতো। তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় অপহরণ, অস্ত্র আইন, বিস্ফোরক আইন, ডাকাতি-ছিনতাই ও খুনসহ ১৪টির অধিক মামলা রয়েছে। এসব মামলায় ৮ বছরের বেশি সময় কারাভোগ করেছেন তিনি। সর্বশেষ ময়মনসিংহের একজন অধ্যাপকের ছেলে অপহরণের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় ৩ বছর কারাভোগ করে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ছাড়া পায়।

গ্রেপ্তার সামিদুল পেশায় একজন গাড়ি চালক, তিনি মালেকের অন্যতম সহযোগী ছিল। দীর্ঘদিন ধরে ভুক্তভোগী হিমেলের পরিবারের গাড়ি চালকের দায়িত্বে থাকায় তাদের বিশ্বস্ত হয়ে ওঠে এবং ব্যাংকিং বিভিন্ন আর্থিক লেনদেন ও ব্যাংকে সঞ্চিত অর্থ সম্পর্কেও তার ভালো ধারণা ছিল। হিমেলের বাবার মৃত্যুর পর মালেকের নেতৃত্বে হিমেলকে অপহরণপূর্বক মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায়ের পরিকল্পনা করেছিল।

রনি পেশায় একজন অটো চালক। সে গ্রেপ্তার মালেকের অন্যতম প্রধান সহযোগী। ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা ও সুনামগঞ্জের সীমান্তবর্তী এলাকাসমূহ তার সুপরিচিত ছিল। মালেকের নির্দেশনায় বিভিন্ন সময় অপহৃত ভিকটিমদের সীমান্তবর্তী পাহাড়ি ও দুর্গম এলাকাসমূহে আটকে রাখতো এবং নির্যাতন করতো বলে জানা যায়। অস্ত্র ও ডাকাতিসহ ২টি মামলায় ৬ বছরের অধিক সময় কারাভোগ করেছে রনি।

রাসেল ও বিল্লাল পেশায় গাড়ি চালক। তারা মালেকের সহযোগী। রাসেল ময়মনসিংহ থেকে ফিরে এসে রাজধানীর উত্তরায় অবস্থান করে ভিকটিম হিমেলের মা এবং তার পরিবারের সদস্যদের গতিবিধি অনুসরণ করার দায়িত্ব পালন করে। তারাও একাধিক মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করেছে। গ্রেপ্তারদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলেও জানায় র‌্যাবের এই কর্মকর্তা।

জেইউ/এসএম