আবারও আলোচনায় গরুর মাংস। ক্রেতাদের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার পর ৬৫০ টাকা কেজি বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেই সিদ্ধান্ত এক মাসও টিকল না। রাজধানীর বাজারে এখন গুরুর মাংসের দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৭০০ টাকায়।

গত ৬ ডিসেম্বর ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতি ও বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সম্মিলিত বৈঠকে ৬৫০ টাকায় মাংস বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়। ৭ ডিসেম্বর থেকে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ওই দামে রাজধানীর বাজারে মাংস বিক্রি হয়। তারপর আবার দাম বাড়াতে শুরু করেন ব্যবসায়ীরা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর বাজারে প্রথমে দু’একদিন ৬৮০ টাকা কেজিতে মাংস বিক্রি হয়। তারপর ১০ জানুয়ারি থেকে ৭০০ টাকা কেজিতে গরুর মাংস বিক্রি শুরু করেন ব্যবসায়ীরা। যদিও বিষয়টি নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন ব্যবসায়ী ও খামারিরা।

মাংস ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতি বলছে, গরুর দাম বেশি। সে কারণে নির্ধারণ করা দাম গরুর মাংস বিক্রি করলে লোকসান গুনতে হচ্ছে। যে কারণে তারা দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছে।

অন্যদিকে খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশন বলছে, হঠাৎ এমন কিছু হয়নি, যার কারণে মাংসের দাম বাড়াতে হবে। ব্যবসায়ীরা তাদের একক সিদ্ধান্তে দাম বাড়িয়েছেন। খামারিরা চান না গরুর মাংসের দাম বাড়ুক।

গত নভেম্বরে ঢাকার খিলগাঁওয়ের খলিল গোস্ত বিতানসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় ৫৯৫ টাকা কেজি দরে গরুর মাংস বিক্রি করা হয়। শুরুতে বিষয়টি নিয়ে খলিল অন্য মাংস ব্যবসায়ীদের তোপের মুখে পড়েন। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোড়ন সৃষ্টি করে। নড়েচড়ে বসে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরও। পরে তাদের মধ্যস্থতায় ব্যবসায়ী ও খামারিদের বৈঠক হয়। সেখানে এক মাসের জন্য দাম কমিয়ে গরুর মাংস ৬৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একইসঙ্গে প্রতি মাসে বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতি ও বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশন একসঙ্গে বসে দাম নির্ধারণ করবে বলেও সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু মাস ঘুরতেই সেসব সিদ্ধান্ত ভেস্তে যায়।

বুধবার (২৪ জানুয়ারি) সকালে সরেজমিনে রাজধানীর নিউমার্কেটের বনলতা কাঁচা বাজার মার্কেটের মাংসের দোকান ঘুরে দেখা যায়, সব দোকানের মূল্য তালিকায় লেখা রয়েছে গরুর মাংস ৭০০ টাকা কেজি। তবে চর্বি ছাড়া মাংসের কেজি ৭৫০ টাকা।

নূর মোহাম্মদ মাংস বিতানের মালিক কিরণ বলেন, সমিতির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৭০০ টাকায় চর্বিসহ মাংস বিক্রি করছি। আর চর্বি ছাড়া মাংস বিক্রি করছি ৭৫০ টাকায়।

তিনি বলেন, ৬৫০ টাকা কেজিতে মাংস বিক্রি সম্ভব হয়েছিল কারণ, তখন গরুর দাম কম ছিল। এখন গরুর দাম অনেক বেড়েছে। তাই মাংসের দামও বাড়াতে হয়েছে। তবে দাম কমার পর মাংসের চাহিদা ও বিক্রি দুটোই বেড়েছিল বলেও জানান তিনি।

যা বলছে মাংস ব্যবসায়ী সমিতি

মাংসের দাম বাড়ানো নিয়ে ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মর্তুজা ঢাকা পোস্টকে বলেন, নির্বাচনের আগে ব্যবসায়ীদের চাপাচাপির কারণে আমরা একসঙ্গে বসে ৬৫০ টাকা কেজিতে গরুর মাংস বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু এতে আমাদের ব্যাপক লোকসান হয়েছে। দোকানিদের ৫ লাখ, ৬ লাখ টাকা করে লোকসান দিতে হয়েছে। তারপর আমরা নিজেরা বসে আবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এখন গরুর মাংস ৭০০ টাকা কেজিতে বিক্রি করা হবে।

তিনি বলেন, সামনে যদি গরুর দাম কমে ও গরুর সংখ্যা বাড়ে তখন আবার দাম কমিয়ে দেব। আবার যদি বাড়ে তাহলে বাড়াতে হবে। তখন তো কমার কোনো সম্ভাবনা নেই।

৬৫০ টাকা দরে বিক্রি করায় আপনার লোকসান হয়েছে কি না– এমন প্রশ্নে গোলাম মর্তুজা বলেন, আমার সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। আমি নিজেই তো টিকতে পারছি না। এখন ৭০০ টাকা কেজিতে বিক্রি করেও হচ্ছে না। তবে এর চেয়ে কম দামে মাংস বিক্রি করে কেউ যদি ব্যবসা ধরে রাখতে পারে, তাকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে সবাইকে বলা হয়েছে দাম ৭০০ টাকার মধ্যে দাম রাখতে।

উল্টো কথা বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের

গরুর মাংসের দাম বাড়ানোর বিষয়টি ব্যবসায়ীদের একক সিদ্ধান্ত বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. ইমরান হোসেন ঢাকা পোস্টেকে বলেন, গত ৭ ডিসেম্বর আমরা একসঙ্গে বসেছিলাম। তখন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরামর্শ ছিল– খামারি ও মাংস ব্যবসায়ীরা একসঙ্গে বসে যেন সহনশীল দাম নির্ধারণ করে। তখন আমরা বলেছিলাম, প্রতি মাসে একসঙ্গে বসে দাম সমন্বয় করব। কিন্তু সম্প্রতি দাম বাড়ানোর বিষয়ে তারা (মাংস ব্যবসায়ীরা) খামারিদের সঙ্গে বসেননি। নিজেরাই দাম বাড়িয়েছে। আমরা দাম বাড়ানোর বিপক্ষে।

তিনি বলেন, এই মুহূর্তে তো বাংলাদেশে নতুন কোনো ঘটনা ঘটেনি, যেটার কারণে দাম বাড়াতে হবে। গোখাদ্যের দাম বাড়েনি। আজ থেকে দুই-তিন মাস আগে যা ছিল এখনো তাই আছে। বরং দু’একটি ইনগ্রেডিয়েন্টের (উপকরণ/উপাদান) দাম কমেছে। এই মুহূর্তে দাম বাড়ানোর প্রশ্নই আসে না। তারপরও তারা আমাদের সঙ্গে না বসে, কোনো মতবিনিময় না করে নিজেরা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

মো. ইমরান বলেন, আমরা এর ঘোর বিরোধিতা করি। দাম বাড়ায় মাংস ব্যবসায়ীরা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হবেন। আমরা খামারিরা আজ থেকে দেড় মাস আগে যে দামে গরু বিক্রি করতাম, এখনো সেই দামেই গরু বিক্রি করছি। শুধু তাদের প্রফিট মার্জিন বাড়াতে তারা এ কাজ করেছে। এটাতে আমরা কোনোভাবেই বেনিফিটেড না।

তিনি বলেন, আমরা খামারিরা চাই না গরুর মাংসের দাম বাড়ুক। আমরা চাই, দাম মানুষের হাতের নাগালে থাকুক। যাতে মানুষ বেশি করে গরুর মাংস কেনে। আর স্বল্প লাভে আমরাও বেশি পরিমাণ গরু বিক্রি করতে চাই।

এক মাসে মাংসের দাম বেড়েছে ২.৯৯ শতাংশ : টিসিবি

দাম বাড়ার বিষয়টি উঠে এসেছে সরকারি সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পরিসংখ্যানেও। টিসিবি বলছে, গত এক মাসে গরুর মাংসের দাম বেড়েছে প্রায় ২.৯৯ শতাংশ। তাদের তথ্য বলছে, মঙ্গলবার (২৩ জানুয়ারি) ঢাকা মহানগরী ও এর আশপাশের এলাকায় গরুর মাংস সর্বনিম্ন ৬৮০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৭০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। এক সপ্তাহ আগে সর্বনিম্ন দাম ছিল ৬৫০ টাকা। আর এক মাস আগে সর্বনিম্ন দাম ছিল ৬৪০ টাকা। তাছাড়া এক বছর আগে এই দিনে গরুর মাংসের সর্বনিম্ন দাম ৬৮০ টাকা।

কম দামে গরুর মাংস বিক্রি করা নিয়ে ঢাকার বাইরেও ঘটেছে তুলকালাম কাণ্ড। মাংসের দাম নিয়ে বিরোধ থেকে ২০ জানুয়ারি রাজশাহীর বাঘায় প্রকাশ্যে ছুরিকাঘাতে মামুন হোসেন নামের এক মাংস ব্যবসায়ীকে হত্যা করেছে আরেক ব্যবসায়ী।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মামুন ও খোকন মামাতো-ফুফাতো ভাই। তারা পাশাপাশি দোকানে গরুর মাংস বিক্রি করেন। খোকন ৭০০ টাকা আর মামুন ৬৫০ টাকা কেজি দরে গরুর মাংস বিক্রি করছিলেন। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে ছুরি দিয়ে কুপিয়ে মামুনকে আহত করেন খোকন। পরে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে নেওয়ার পথে মামুনের মৃত্যু হয়।

আরএইচটি/এসএসএইচ