দরজায় কড়া নাড়ছে অমর একুশে বইমেলা। অধিবর্ষের (লিপইয়ার) কারণে ২৯ দিনব্যাপী সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বসবে বাঙালির প্রাণের এই মেলা। সে লক্ষ্যেই চলছে জোর প্রস্তুতি।

অমর একুশে বইমেলাকে মূল্যায়ন করা হয় বাঙালির প্রাণের মেলা হিসেবে। কেননা, ইতিহাস ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটানো বইমেলায় উপন্যাস, কবিতা, ভ্রমণ, সাহিত্যের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের বইয়ের পাতায় আত্মার খোরাক খুঁজে নেন বিভিন্ন বয়সী পাঠক। পাশাপাশি লেখক, কবি, সাহিত্যিক শিক্ষাবিদ ও সংস্কৃতিমনা মানুষের উচ্ছ্বাস আর অংশগ্রহণে বড়সড় মিলনমেলায় পরিণত হয় বইমেলা প্রাঙ্গণ।

যদিও এ বছর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলার আয়োজন ঘিরে শুরুতে তৈরি হয়েছিল নানা সংশয়। কারণ ফেব্রুয়ারিতে সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরে সাংস্কৃতিক বলয় তৈরি করার পরিকল্পনা ছিল। তবে তা পিছিয়ে ১ মার্চ থেকে করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফলে ১ ফেব্রুয়ারি বইমেলা শুরু হবে আর ২৯ ফেব্রুয়ারির পরই মেলার স্টল ভাঙাসহ যাবতীয় কাজ শেষ করতে হবে। সেজন্য এ মুহূর্তে বইমেলার আয়োজনে নানান কার্যক্রম চলছে বেশ জোরেশোরে।

শনিবার (২০ জানুয়ারি) সকালে সরেজমিনে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘুরে দেখা যায়, বিস্তর জায়গা নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে বই মেলার বিভিন্ন স্টল। মাটিতে গর্ত করে বসানো হয়েছে বাঁশের খুঁটি। বানানো হচ্ছে স্টল। বৃষ্টির দুর্ভোগ এড়াতে স্টলের ওপরে দেওয়া হয়েছে টিন। নির্মাণ শ্রমিকরা পার করছেন ব্যস্ত সময়। মাঠের মাঝখানে, পাশে এবং অন্যান্য জায়গায় বসে বইয়ের জন্য কাঠ দিয়ে তাক নির্মাণসহ অন্যান্য কার্যক্রম করছেন কাঠমিস্ত্রিরা। পুরো মাঠ জুড়েই হাতুড়ি বাটালের টুনটুন ও ঠুকঠাক শব্দ।

তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রতিদিন ৩০-৩৫ জন মিস্ত্রি স্টল তৈরিসহ অন্যান্য কাজ করছেন। আজমল হোসেন নামের এক শ্রমিক বলেন, আমরা এখানে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করি। বাঁশের খুঁটি লাগানোর কাজ শেষ। এখন অন্যান্য কাজ করছি। প্রত্যেকটা কাজের জন্যই আলাদা আলাদা মিস্ত্রি কাজ করছেন। কেউ কাঠের কাজ, কেউ বইয়ের তাক নির্মাণের, কেউ টিনের আবার কেউবা ভেতরের ডেকোরেশনের।

নাছির নামের আরেক শ্রমিক বলেন, বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে আর উদ্যানে আমরা কাজ করছি। প্রতিদিনই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করতে হচ্ছে। আমার কাজ স্টলের উপরে টিন লাগানো। স্টলের উপরে সামিয়ানা বা ত্রিপল দিলে সেগুলো পুরো মাস জুড়ে টেকসই হয় না। সেজন্য স্টলের উপরে টিন দেওয়া হচ্ছে। যাতে করে বৃষ্টি এলেও বই নষ্ট হয়ে না যায়। অধিকাংশ কাজই শেষ। নিচে বাসের ফ্রেমিং শেষ হয়েছে, এখন দ্রুত গতিতে উপরে ছাড় দেওয়ার কাজ চলছে।

বাংলা একাডেমি সূত্রে জানা গেছে, এরই মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশেরও বেশি কাজ শেষ হয়েছে। আগামী ২৩ জানুয়ারি ডিজিটাল পদ্ধতিতে লটারির মাধ্যমে বরাদ্দ করা হবে স্টল। আর ১ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধনের মাধ্যমে পর্দা উঠবে অমর একুশে বইমেলার। তবে এবছর এককভাবেই মেলার আয়োজন করছে বাংলা একাডেমি। মেলা সফল করতে অন্যান্য বছর ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের সহায়তা নিলেও তাদের বিষয়ে অসহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে। সেজন্য এ বছর তাদের বাদ দেওয়া হয়েছে। মেলার আয়োজন সফল করতে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি, পুলিশ বিভাগ, মেট্রোরেল, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে সমন্বয়ে সভা করেছে বইমেলা পরিচালনা কমিটি।

বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব এবং বাংলা একাডেমির মানবসম্পদ উন্নয়ন ও পরিকল্পনা বিভাগের পরিচালক ডা. কে এম মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, মেলায় প্রতি বছর ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের নিয়ে অনেক অভিযোগ আসে। তাই এবার আমরা নিজেরাই সব তদারকি করছি। মেলার অবকাঠামোগত বিন্যাস গতবছরের মতই আছে। মেলার স্টলগুলো গুচ্ছ আকারে থাকবে না। আর প্যাভিলিয়ন ও স্টলের লাইনও আলাদা থাকবে। এতে করে মেলায় আগত দর্শনার্থী ও পাঠকদের স্টল খুঁজে পেতে সহজ হবে।

তিনি আরো বলেন, এবার শুধু মেলার পূর্ব প্রস্ততি ও পর্যবেক্ষণের জন্য আমরা ৭টা কোর কমিটি করেছি। এই কমিটি ভালোভাবে কাজ করে যাচ্ছে। গত মেলায় অনেক অভিযোগ ছিল। একটা প্রকাশনী নিয়ে অনেক অস্থিরতা ছিল, এবার সেটি নেই। এবারের মেলার আয়োজন সুন্দর করতে গত বছর বইমেলা শেষ হওয়ার পর থেকেই প্রস্তুতি নিয়েছি। পুস্তক সমিতি থেকে শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র সদস্য ও মন্ত্রণালয়সহ সবাইকে নিয়ে আমরা বইমেলার একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা প্রণয়ন করেছি। তাই আমরা প্রত্যাশা করছি, আগের তুলনায় এবারের বইমেলা অনেক সুন্দর হবে।

বইমেলার সদস্য সচিব আরো জানান, এবছরই প্রথমবার বাংলা একাডেমি থেকে ঢাকার ২৫টি স্কুলের প্রশাসনের কাছে তাদের শিক্ষার্থীদের বইমেলায় আনার জন্য চিঠি পাঠানো হয়েছে। একইসঙ্গে পাঠকদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য রাত ৮টা পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু রাখার জন্যও ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়ার হয়েছে।

প্রসঙ্গত, ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি চিত্তরঞ্জন সাহার হাত ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণে বইমেলার গোড়াপত্তন হয়েছিল। তিনিই ১৯৭৬ পর্যন্ত একাই বইমেলা চালিয়ে যান। ১৯৭৬ সালে অন্যরাও এই মেলার ব্যাপারে অনুপ্রাণিত হন। পরে ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমিকে মেলার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন। ১৯৭৯ সালে মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। অবশ্য এই সংস্থাটিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। পরে ১৯৮৩ সালে কাজী মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে বাংলা একাডেমিতে প্রথম ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র আয়োজন করেন। কিন্তু স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষা ভবনের সামনে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে ট্রাক তুলে দিলে দুজন ছাত্র নিহত হয়। ওই মর্মান্তিক ঘটনার পর সেই বছর আর বইমেলা করা সম্ভব হয়নি।

১৯৮৪ সালে সাড়ম্বরে বর্তমানের অমর একুশে গ্রন্থমেলার সূচনা হয়। সেই ৩২টি বইয়ের ক্ষুদ্র মেলা সময়ের পরিক্রমায় বাঙালির সবচেয়ে স্বনামধন্য বইমেলায় পরিণত হয়েছে। বাংলা একাডেমি চত্বরে স্থান সংকুলান না হওয়ায় ২০১৪ সাল থেকে বইমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। বইমেলায় কবিতা, উপন্যাস, গল্প, রচনা, ইতিহাস, বিজ্ঞান, মৌলিক বিজ্ঞান, বিভিন্ন ভাষায় বই ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে বিভিন্ন ধরনের বই পাওয়া যায়। আগামী ৩০ জানুয়ারি বেলা ১১টায় বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে অমর একুশে বইমেলা ২০২৪ এর সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা গেছে।

আরএইচটি/এসএম