প্রথমদিন আশা আশ্বাস আর আস্থার বাণী শোনালেন মন্ত্রীরা
প্রত্যাশার চেয়ে বেশ দ্রুততম সময়ে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যরা। রোববার (১৪ জানুয়ারি) ছিল নতুন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের প্রথম কর্মদিবস। এদিন তারা যার যার মন্ত্রণালয় ও বিভাগে যান। কর্মকর্তা-কর্মচারী ও গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
গত ৭ জানুয়ারি দেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ১০ জানুয়ারি নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা শপথ নেন। ওইদিন বিকেলে ৩৬ সদস্যের মন্ত্রিসভা গঠন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরদিন ১১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় শপথ নেন নতুন সদস্যরা। এরপর তাদের দায়িত্ব বণ্টন করেন প্রধানমন্ত্রী।
বিজ্ঞাপন
শপথ গ্রহণের পর প্রথম কর্মদিবস ছিল রোববার। সকালে নিজ নিজ মন্ত্রণালয় ও বিভাগে যান মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের স্বাগত জানান।
পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাদা আলাদাভাবে আলাপ করেন নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যরা। তারা নিজেদের সামনের দিনের পরিকল্পনা তুলে ধরেন। শোনান নানা আশার বাণী। নতুন করে দেন নানা আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি। অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোরতার বার্তাও উঠে আসে কারো কারো কথায়।
সিন্ডিকেট, মজুতদারি চলবে না
মজুতদারদের শক্ত হাতে দমন করা হবে বলে নিজের প্রথম কর্মদিবসেই হুঁশিয়ারি দেন নতুন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম (টিটু)। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বড় বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করার যথেষ্ট টুলস রয়েছে। কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় কাজ করব না, জনগণের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করব।
আহসানুল ইসলাম বলেন, আজকের দরদামকে বেইজ ধরে আমরা কাজ করতে চাই। মজুতদারদের শক্ত হাতে দমন করব। কৃত্রিম সংকট যারাই করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। সিন্ডিকেট থাকতে পারবে না। পুঁজিবাজারে সিন্ডিকেট করতে দিইনি, এখানেও আমি সিন্ডিকেট করতে দেব না। স্বচ্ছভাবে যারা ব্যবসা করবে তাদের সহযোগিতা করা হবে। আর যারা কৃত্রিমভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করবে তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অন্যদিকে মজুতবিরোধী অভিযান জোরদার করার কথা জানিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণ করে তিনি বলেন, ধান চালের অবৈধ মজুতবিরোধী অভিযান জোরদার করবে সরকার।
খাদ্যমন্ত্রী বলেন, দেশে ধান উৎপাদন ভালো হয়েছে। আমাদের খাদ্য মজুতও ভালো। বাজারে প্রচুর সরবরাহ রয়েছে। তবে মিলাররা প্রতিযোগিতা করে ধান কেনায় প্রতিনিয়ত চালের দাম বাড়ছে। এ অশুভ প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে খাদ্য মন্ত্রণালয় দ্রুত পদক্ষেপ নেবে। মজুতবিরোধী আইন এরই মধ্যে পাস হয়েছে। দ্রুত বিধি প্রণয়ন করে তা মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করা হবে।
আরও পড়ুন
ফ্লোরে শুয়ে আর চিকিৎসা নিতে হবে না
প্রতিটি হাসপাতালে গিয়ে কী কী সমস্যা আছে জেনে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করার কথা জানিয়েছেন নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন। তিনি বলেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমি চেষ্টা করব। এটা করতে পারলে ঢাকা শহরে মাটিতে শুয়ে (ফ্লোরে) চিকিৎসা নিতে হবে না।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি জিরো টলারেন্স-এ থাকবেন বলে আশ্বাস দেন।
রমজানে ১ম পদক্ষেপ
ধারাবাহিকভাবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন নতুন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। তিনি বলেন, চ্যালেঞ্জ থাকবে। একবারে সব করা সম্ভব নয়। অনেক কারেকশন করতে হবে। সব উন্নয়ন প্রক্রিয়াতেই কারেকশন দরকার আছে। রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকে প্রথম অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা জানান তিনি।
আরও পড়ুন
প্রকল্প বাস্তবায়নে নয়ছয় নয়
প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে কোনো ছাড় না দেওয়ার বিষয়ে কঠোর বার্তা দেন নতুন পরিকল্পনামন্ত্রী মেজর জেনারেল অব. আব্দুস সালাম। তিনি বলেন, দুর্নীতি এখন জাতীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয়ে গেছে। এটার বৈশিষ্ট্যের ওপর হাত দেওয়া যাবে না, তবে জিহাদ অব্যাহত থাকবে। শতভাগ নিশ্চিত থাকেন, কোথাও ছাড় দেওয়া হবে না। পরিকল্পনা মন্ত্রী হিসেবে আমি শতভাগ দায়িত্ব পালন করব। প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে কোনো ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। কাজ সময় মতো শেষ করতে হবে।
প্রতিবছর ২০ লাখ কর্মসংস্থান হবে
সরকারের বর্তমান মেয়াদে কর্মসংস্থানের ওপর জোর দেওয়া হবে জানান জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। তিনি বলেন, কর্মসংস্থান তৈরিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাবে। মানুষকে কাজের মধ্যে সম্পৃক্ত করাই আমাদের লক্ষ্য।
ফরহাদ হোসেন বলেন, আমরা কর্মসংস্থান তৈরি করার কথা বলেছি। প্রতিবছর ২০ লাখ কর্মসংস্থান হবে। সেক্ষেত্রে জনপ্রশাসনের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। সরকারি পদগুলো পূরণ করাসহ বেসরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর শূন্যপদগুলো পূরণ করা। বেসরকারিভাবেও যাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, সেক্ষেত্রে আমরা কাজ করব। এক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বৈদেশিক সম্পর্কে বৈরিতা কেটে যাবে
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, পূর্ব-পশ্চিমের সব দেশের সঙ্গে কাজ করবে নতুন সরকার। তিনি বলেন, ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ এ নীতি মেনেই আমরা চলব। সবাই আমাদের উন্নয়ন সহযোগী। সবার সঙ্গেই কাজ করতে চাই।
সরকার বিদেশিদের কাছ থেকে বিশেষ কোনো চাপে নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি। নির্বাচন নিয়ে আমেরিকাসহ পশ্চিমাদের সঙ্গে যে বৈরিতার একটা ভাব দেখা যাচ্ছে তা কেটে যাবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
তিনি বলেন, পূর্ব-পশ্চিমের সব রাষ্ট্র আমাদের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহ ব্যক্ত করেছে। তারা সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে।
দক্ষতা ও আন্তরিকতা দিয়ে জ্বালানি সংকট মোকাবিলা
নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহে অবদান রাখতে কর্মকর্তাদের আহ্বান জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহে যার যার অবস্থান থেকে দায়িত্বশীল অবদান রাখুন। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে জ্বালানি ও বিদ্যুতের চ্যালেঞ্জ বাড়বে। দক্ষ হাতে ও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করলে সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সামনের দিনগুলো আরো উন্নত ও ভালো হবে।
সিন্ডিক্যাট ‘ক্র্যাশ’ করার পদ্ধতি বের করতে হবে
সিন্ডিকেট ভাঙার পদ্ধতি বের করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন নতুন কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুস শহীদ। তিনি বলেন, সিন্ডিকেট সব জায়গায় থাকে। তাদের কীভাবে ক্র্যাশ (ভেঙে) করতে হবে, সেটার পদ্ধতি বের করতে হবে। কাউকে গলা টিপে মারার সুযোগ নেই আমাদের। কর্মের মাধ্যমে এগুলো কন্ট্রোল করতে হবে। সিন্ডিকেট অবশ্যই দুর্বল হয়ে যাবে।
অন্যদের অন্য যত আশার বাণী
যাত্রীসেবা, লাগেজ হ্যান্ডেলিং সেবার উন্নতি করার আশ্বাস দিয়েছেন নতুন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান। আর নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী জানিয়েছেন, দেশের মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাটাই এবার বড় চ্যালেঞ্জ।
নতুন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী জানিয়েছেন, বিদেশে দক্ষ বাংলাদেশি কর্মী পাঠানো এবং রেমিট্যান্সে আনার দিকে নতুন সরকার জোর দেবে। অন্যদিকে বস্ত্র ও পাট খাতের সমৃদ্ধি অর্জনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেওয়ার কথা জানিয়েছেন নতুন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক।
সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবেন বলে মন্তব্য করেছেন নতুন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রহমান। ভূমিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ জানিয়েছেন, কাজ করার ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতি থেকে নিজে পরিচ্ছন্ন থাকবেন এবং মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিচ্ছন্ন থাকার আহ্বান জানাবেন।
চলমান উন্নয়নমূলক কাজ শেষ করে যেতে পারাই বড় চ্যালেঞ্জ বলে মন্তব্য করেছেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা বলেছেন, মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সবার সহযোগিতায় পার্বত্য চট্টগ্রামের ধর্ম, বর্ণ, জাতি গোষ্ঠীসহ সব সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্প্রীতির বন্ধনে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাব।
পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী জানিয়েছেন, আগামী সাতদিনের মধ্যে একশ দিনের পরিকল্পনা দিতে চান তিনি। বলেন, আমরা চাই এটা যেন এক নম্বর মন্ত্রণালয় হয়।
এসএসএইচ